৪ জুলাই, ২০২২ ১৭:৫৬

উপকূলের নারীদের পাশে দাড়াঁনোর চেষ্টায় দিলআফরোজ

জুলকার নাইন

উপকূলের নারীদের পাশে দাড়াঁনোর চেষ্টায় দিলআফরোজ

গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী ১৯টি জেলায় মাটি ও পানির লবণাক্ততা আশঙ্কাজনক দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে। উপকূলবর্তী শ্যামনগর থানার খড়িয়া গ্রামের লবণাক্ততার মাঝে বসবাসকারী কিশোর-কিশোরীদের উপর এর প্রভাব দেখার জন্য ২০১৭ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দিলআফরোজ খানমের গবেষণায় দেখা যায় লবণাক্ত পানির ভয়াবহ প্রভাব পড়ে উপকূলীয় কিশোরীদের উপর বিশেষত তাদের মাসিককালীন সময়ে। 

‘উপকূলের নারীরা সাধারণত পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন মাসিককালীন সময়ে কিন্তু এ কাপড় লবণ পানিতে বার বার ধোয়ার কারণে কাপড়টি শক্ত হয়ে যায়। এ কাপড় যখন পরবর্তী মাসিকের সময় ব্যবহার করা হয় তখন তা চুলকানি, র‌্যাশসহ নানা ধরনের সংক্রমণ তৈরি করে। বেশি সমস্যা দেখা দেয় এ কাপড় পড়ে যখন ৪/৫ কিলোমিটার হেঁটে তারা খাবার পানি সংগ্রহ করে। এছাড়াও নারী শিক্ষার্থীরা এ সমস্যার কারণে প্রত্যেক মাসেই ২/৪ দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে’- গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল জানাচ্ছিলেন দিলআফরোজ। 

গবেষণাটি সম্পন্ন করে তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আশা যায়, এ ভাবনা থেকেই ২০১৮ সালের ২০ জুলাই তার সমমনা আরও পাঁচজনকে নিয়ে ‘স্টেপস এহেড’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যা ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা অধিদফতর থেকে নিবন্ধন লাভ করে। পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমায় স্টেপস এহেড নানা ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই দিলআফরোজের পরিকল্পনায় প্রান্তিক নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। 

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ, বালিকা শিশু পরিবার, বরিশাল (উত্তর ও দক্ষিণ), সেফ হোম বরিশালসহ নানা সময়ে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া স্টেপস এহেড দুঃস্থ, এতিমখানা ও বস্তিতে বসবাসকারী কিশোরী, বেদে পল্লী ও পানের বরজে কাজ করা প্রান্তিক নারীদের মাঝে বিনামূল্যে ‘হাইজিন কিট’ বিতরণ করেছে। একটি হাইজিন কিটের মধ্যে মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষার সব উপকরণই থাকে যেমন: এক জোড়া আন্ডারওয়্যার, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, একটি সাবান ও এক বোতল লিকুইড এন্টিসেপটিক। 

বিনামূল্যে হাইজিন কিট বিতরণের পাশাপাশি স্টেপস এহেড ‘মিন্সট্রুয়াল হাইজিন ফ্রেন্ডলি টয়লেট’ স্থাপনেও কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টেপস এহেড এর সহযোগিতায় মেয়েদের চারটি টয়লেটে এই সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে ইমারজেন্সি সেনিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা, ন্যাপকিন চেঞ্জের জন্য চেঞ্জিং রুম স্থাপন, টয়লেট ডাস্টপ্যান স্থাপন, হ্যান্ড ওয়াশের পর্যন্ত ব্যবস্থা রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে বরিশাল সরকারি কলেজেও এ ধরনের সুবিধা সম্বলিত টয়লেট তৈরিতে সহযোগিতা করেছে স্টেপস এহেড। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাকে নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যেই স্টেপস এহেড এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ভবিষ্যতে স্কুল ও অন্যান্য কলেজ পর্যায়ে এ কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে সংগঠনটি। 

২০২০ সালে দিলআফরোজ স্টাডি কনসালটেন্ট হিসেবে ইউনিসেফ ও বরগুনা জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় বরগুনা জেলায় বসবাসরত স্কুল ও মাদ্রাসার কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা ও মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, অভ্যাস দেখার জন্য একটি বেইজলাইন স্টাডি পরিচালনা করেন। এ গবেষণার মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম পরিচালনার সময় তিনি দেখতে পান উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিভিন্ন স্থানে স্যানিটারী ন্যাপকিনের সরবরাহ থাকলেও দরিদ্র কিশোরীদের পক্ষে তা ক্রয় করে ব্যবহার করা সম্ভব না। 

গ্রামীণ দরিদ্র কিশোরীদেও কাছে কিভাবে সহজে এবং সুলভে স্যানিটারী ন্যাপকিন পৌঁছে দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবনার এক পর্যয়ে তিনি ‘রি ইউজএবল ক্লোথ প্যাড’ নিয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায়  প্রান্তিক নারীদের কাছে বিনামূল্যে মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুবিধা পৌঁছে দেয়ার জন্য স্টেপস এহেড সম্প্রতি ‘রিইউজএবল ক্লথ প্যাড তৈরির কার্যক্রম শুরু করেছে। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত এ ধরনের প্যাড সহজলভ্য ও সুলভ নয় এবং বাংলাদেশে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এ ধরনের প্যাড উৎপাদনও করা হয় না। তবে এ ধরনের প্যাড ব্যবহারের পরিবেশগত ও আর্থিক সুবিধা অনেক। স্টেপস এহেড এর এই কার্যক্রম সম্পর্কে দিলআফরোজ বিশ্বাস করেন “রি ইউজএবল প্যাডের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের মধ্যে মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিপ্লব আনা সম্ভব হবে। অগণিত দুঃস্থ ও দরিদ্র নারী মুক্তি পাবে মাসিক সংক্রান্ত গাইনোকোলোজিক্যাল রোগ এর হাত থেকে এবং নির্বিঘ্ন করা যাবে প্রান্তিক নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি”। বর্তমানে স্টেপস এহেড তার নিজস্ব ইনোভেশন ল্যাবে কয়েক ধরনের ‘রিইউজএবল ক্লথ প্যাড’ বিশেষভাবে ডিজাইন করেছে এবং ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহযোগীতায় সাশ্রয়ী, কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব এ প্যাড তৈরির কাজ চলছে। 

প্রান্তিক নারীদের মাঝে মাসিকালীন স্বাস্থ্য সুবিধা সহজলভ্য করার জন্য স্টেপস এহেড কয়েকটি পণ্যের ডিজাইন তৈরি করেছে তাকে বলা যায় “টহরয়ঁব ঝড়পরধষ ওহহড়াধঃরড়হ”। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হিডেন হ্যাঙ্গার। এ পণ্যটি প্রান্তিক নারীদের মাসিকের সময় ব্যবহার্য কাপড়কে সরাসরি সূর্যালোকের মাধ্যমে শুকিয়ে জীবাণুমুক্তকরণের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইনকৃত। স্টেপস এহেড এর এই ইনোভেশনটি ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর জার্মান এম্বাসী আয়োজিত প্রতিযোগীতায় ‘জার্মান কোঅপারেশন কর্তৃক বিশেষভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়।
 
২০১৯ সালে দিল আফরোজ খানম উচ্চ শিক্ষার্থে সুইডিস ইন্সস্টিটিউট স্কলারশিপ নিয়ে সুইডেন গমন করেন। সুইডেন এর বিখ্যাত লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নকালে তিনি স্টেপস এহেড এর দুইটি আইডিয়া নিয়ে ‘লুন্ড ইউনিভার্সিটি ভেঞ্চার ল্যাব’ প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করেন। সি সোর এবং হোম ফ্যাক্টরী এ আইডিয়া দুটি লুন্ড ইউনিভার্সিটি কর্তৃক আয়োজিত ভেঞ্চার ল্যাব প্রতিযোগীতায় “মেন্টরশীপ” প্রাপ্ত হয় যা পরবর্তীতে এ আইডিয়া বাস্তবায়নে সহায়ক হয়। উপকূলবর্তী প্রান্তিক নারীদের অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার জন্য এ আইডিয়াগুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে স্টেপস এহেড। 

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলে বসবাসরত নারীদের কাজের সুযোগ খুব কম। তাই তাদেরকে সাবলম্বী করে তোলার জন্য স্টেপস এহেড বেছে নিয়েছে উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির দুটি বিখ্যাত পণ্য শীতল পাটি ও গামছা (দুটিই এও প্রোডাক্ট)। শীতল পাটির ঐতিহ্য হারিয়ে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই এ পণ্যটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার করতে প্রয়োজন এর বহুমুখীকরণ। “শীতল পাটি বহুমুখীকরণ প্রকল্প” নামে দিলআফরোজের নেতৃত্বে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে স্টেপস এহেড। এ পর্যন্ত তারা ১৭টি পণ্য ডিজাইন করেছে শীতলপাটি দিয়ে এবং ঢাকার একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকারী হিসেবে এসব পণ্য সরবরাহ করছে যার মাধ্যমে উপকূলে বসবাসকারী প্রান্তিক নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব হবে বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। 

এছাড়াও স্টেপস এহেড অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা প্রদান করছে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতে। এ পর্যন্ত সাঁইত্রিশ (৩৭) জন আর্থিক অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীকে ‘শিক্ষা সহায়তা’ প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষা সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে উপকূলীয় জেলায় বসবাসকারী শিক্ষার্থীদেরকে প্রাধান্য দেয় স্টেপস এহেড। ধীরে ধীরে এ কার্যক্রম আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে যা স্বল্প পরিসরে হলেও সাসটেইনএবল ডেভলপমেন্ট গোল অর্জনে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছে। সমাজ উন্নয়নে স্টেপস এহেডের বিভিন্ন কার্যক্রম জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। 

সর্বশেষ ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর সংগঠনটি “জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২১” অর্জন করে “ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ইনোভেশন” ক্যাটাগরিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ পুরস্কার গ্রহণের পর স্টেপস এহেড নিয়ে দিল আফরোজের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এ সংগঠনটির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবিত উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে আরো ফলপ্রসূ কাজ করতে তিনি বদ্ধপরিকর।

সর্বশেষ খবর