৫ জুলাই, ২০২২ ০৯:৫৭

জি-৭ ও ন্যাটো সম্মেলন বিশ্বকে কি বার্তা দিল?

ড. মঞ্জুরে খোদা

জি-৭ ও ন্যাটো সম্মেলন বিশ্বকে কি বার্তা দিল?

দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সামিট হয়ে গেল। একটা জি-৭ এর ২৬-২৮ জুন জার্মানের বাভারিয়ায়। যার প্রধান বিষয় ছিল নিরাপদ বিশ্ব, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য ও সামরিক জোটের শক্তি বৃদ্ধি প্রভৃতি। অন্যটি ন্যাটো’র ২৯-৩০ জুন স্পেনের মাদ্রিদে। যার মূল বিষয় ছিল ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা, রাশিয়া-চীনকে মোকাবেলা করা, সামরিক ব্যায় বৃদ্ধি ও ন্যাটোর সম্প্রসারণ। শিল্পন্নোত ৭ দেশের জোট জি-৭ এবং ৩০টি দেশের সামারিক নিরাপত্তার জোট ন্যাটো। 

বছর দুই ভয়ংকর করোনায় সমগ্র বিশ্বই আতঙ্কে কুকড়ে ছিল। সে বিপদ অনেকটা কমলেও এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বের সকল দেশই সে দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেটা কাটিয়ে উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এ সংঘাত দু’দেশের মধ্যে হলেও তার প্রভাব বিশ্বের সর্বত্রই পরেছে। বিশ্বে সামরিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরী করেছে। এবং তা সহসাই বৃদ্ধিবৈ কমার কোন সম্ভবনা নেই। এই পরিস্থিতি স্নায়ুযুদ্ধের এক ভিন্ন যুগের সূচনা করেছে। সেটার পরিষ্কার বার্তা পাওয়া গেল এই জি-৭ ও ন্যাটো’র সম্মেলনের মধ্যদিয়ে। কি আলাপ হলো সেখানে? 

১। সে আলাপের একটি প্রধান এজেন্ডা ছিল অপ্রতিরোধ্য চীনকে ঠেকানো। তাদের অভিযোগ চীন দরিদ্র ও উন্নয়নশীলতে দেশগুলোতে উন্নয়নের নামে তাদের ঋণের জালে আটকে ফেলছে এবং এরা চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করতে হবে। সে কারণে, জি-৭ এর এই পরিকল্পনায় চীনের মাল্টিট্রিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প ঠেকাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে অর্থায়নে- পাঁচ বছরে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করা হয়। এবং চীনের পাল্টা ‘পার্টনারশিপ ফর গ্লোব্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট’ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়।

২। রাশিয়া বিশ্ব স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তাকে ঠেকাতে তাদের সামারিক শক্তি-সক্ষমতা, অস্ত্র মজুত ও সৈন্য সমাবেশ অনেক বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে ২০২৪ সালের মধ্যে এই দেশগুলোকে সামরিক খাতে তাদের জিডিপি’র কমপক্ষে ২ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। 

৩। জি-৭ সম্মেলনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্ক্রি বলেন, সামরিক সহায়তার পাশাপাশি প্রতিমাসে তাদের ৫ বিলিয়ন ডলার করে প্রয়োজন হবে। সামরিক সহায়তার সাথে এই সহযোগিতাও নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, যুদ্ধে পরাজিত হলে পুরো ইউরোপ রাশিয়ার থাবার মুখে পড়বে। এই শীত মৌসুমের পূর্বেই যুদ্ধ শেষ করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইউক্রেনের বিষয়ে ন্যাটো, জি-৭কে গুরুত্ব দিতে হবে।

৪। জি-৭ বৈঠকে নেতৃবৃন্দ ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের সহযোগিতা জোড়দার করার অঙ্গীকার করেন। এবং রাশিয়ার উপর কঠোর অবরোধের মাধ্যমে তাকে চাপে রাখার কৌশলের কথা ঘোষণা করেন। 

৫। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে ন্যাটো’র সৈন্য সংখ্যা দশগুন বাড়াবে। ৪০ হাজার থেকে সে সংখ্যা তিন লক্ষাধিক করা হবে। ২০১৪তে যা ছিল ১৩ হাজার। জোটের মহাসচিব ইয়েন্স স্টেfলটেনবার্গ বলেন, ‘যুদ্ধের জন্য ন্যাটো সর্বদা প্রস্তুত। ইউক্রেন যুদ্ধের পর লাতভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডে ন্যাটোর সৈন্যদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতিতে রাখা হয়েছে। মাদ্রিদে বাইডেন বলেন, পুরো ইউরোপের স্থল-সমুদ্র-আকাশ জুড়ে আমেরিকার সেনা উপস্থিতি বাড়ানো হবে।

৬। রাশিয়ার লাগেয়া রাষ্ট্র ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটো’র সদস্য করার প্রক্রিয়া মাধ্যমে এর সম্প্রসারণ ঘটানোর সিদ্ধান্ত। 

৭। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ বা বিরতির কোন সিদ্ধান্ত-পরিকল্পনা-তাগিদ ছাড়াই বৈঠকগুলো শেষ হয়। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর থেকেই ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ন্যাটোকে এখন আর নিছক একটি সামরিক জোট বলতে নারাজ অনেকে। একে অনেকে রাজনৈতিক জোটও বলে থাকেন। জাপান ছাড়া জি-৭ এর সকল রাষ্ট্রই ন্যাটোর প্রধান শক্তি ও নিয়ন্ত্রক। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের রক্ষক হচ্ছে ন্যাটো। সে কারণে জি-৭ ও ন্যাটোর আলোচনা আজ অভিন্ন।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্য-পণ্য সংকট ও ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি তৈরী হয়েছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে চীনের বিরুদ্ধে জি-৭ এর উদ্যোগ-পরিকল্পনা বিশ্ব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল করবে, সে প্রশ্ন সঙ্গত। চীনের সুলভ পণ্য না থাকলে বিশ্ব পরিস্থিতি ভয়াবহ হতো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধে বিশ্বে যে অবস্থা হয়েছে, চীনকে ঘিরে এমন দেশে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। পণ্য সংকট, মূল্যবৃদ্ধি ও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বেলজিয়াম, ব্রিটেন, স্পেন, জার্মানসহ ইউরোপের দেশে দেশে নিত্যদিন মিছিল-বিক্ষোভ হচ্ছে। তবে সেটা হলে পরিস্থিতি বিক্ষোভে আটকে থাকবে না আরো ভয়াবহ হবে। 

উত্তর কোরিয়া, ইরান, আফগান, ভেনিজুয়েলা, কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ দিয়ে রাশিয়াকেও সে পাল্লায় তোলা হয়েছিল। তার প্রভাব-পরিণতি কি হলো? রাশিয়া পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে বা নেয়ার ক্ষমতা-সামর্থ রাখে সে বিবেচনা না থাকা পশ্চিমা নেতৃত্বের বিচক্ষনতা ও দূরদর্শিতার অভাব। তাদের প্রচেষ্টা রাশিয়াকে দমাতে পারেনি বরং আরো ক্ষিপ্র করেছে। ইউক্রেনের প্রায় ৩০ ভাগ ভূমি তাদের দখলে চলে গেছে।   

জার্মান শীতে গ্যাস রেশনিং ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে থাকা ইউরোপের দেশগুলো তাদের সংকট মেটাতে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো চালুর কথা বলছে। পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে নিচ্ছে। জাপানের ফুকুশিমার পারমানবিক বিপর্যয়ের পর পর্যায়ক্রমে পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা করা হয়েছিল, সেখান থেকেও সরে আসার কথা হচ্ছে। 

ধনী দেশগুলোর পক্ষ থেকে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনে যে ক্ষতির স্বীকার হয়েছে, সে কারণে ২০২০ সালের মধ্যে তাদের ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি। কার্বণ নিঃসরণের পূর্বের অঙ্গীকারও পুরণ হয়নি। গত বছর গ্লাসগোতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ১.৫% কমানো এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।  অথচ রাশিয়াকে শায়েস্তা করাতে ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থ ঢালতে তাদের অর্থের অভাব হচ্ছে না। চীনকে ঠেকাতে বিশাল তহবিল গঠন করা হয়েছে। অথচ প্রাণ-প্রকৃতি-জলবায়ু রক্ষার তহবিলে টান পড়ছে।  

ইউরোপে শীত জেকে বসতে ক’মাস বাকি। পরিস্থিতি বলছে, শীতের আগে যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। সে সময় গ্যাস সংকট আরো তীব্র হবে। মূল্যবৃদ্ধির আরেক ধাক্কা আসবে, পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। এ পরিস্থিতিতে সদ্য সমাপ্ত জি-৭ ও ন্যাটো সম্মেলন বিশ্বকে শান্ত করতে কোন বার্তা দিতে পারেনি বরং উত্তপ্ত করেছে। বিশ্ব সামরিক ও রাজনৈতিক বলয়ে নয়া মেরুকরণকে স্পষ্ট করেছে। জি-৭ বনাম চীন-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব ভবিষ্যত বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কি হবে তা সময়ই বলবে।     

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর