১৪ আগস্ট, ২০২২ ১৪:৫৮

শ্রাবণের ধারায় মিশে রক্তস্রোত আর অশ্রুধারা

গুলশাহানা ঊর্মি

শ্রাবণের ধারায় মিশে রক্তস্রোত আর অশ্রুধারা

গুলশাহানা ঊর্মি

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ভোরের সূর্যটা জাগতিক নিয়মে চারপাশ আলোকিত করলেও বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে নিয়ে আসে এক ঘোর কালো অন্ধকার। এই দিন সূর্য ওঠা নতুন ভোরের নরম আলোয় সংগঠিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য, নির্মম ও বর্বরোচিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সেনাবাহিনীর একদল বেপরোয়া, বিপদগামী সদস্য সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকের বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু্’র হিমালয়সম সুউচ্চ বক্ষ। নিভে যায় বাংলার আকাশের সবচেয়ে দেদীপ্যমান, উজ্জ্বল, জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। নিভে যায় বাঙালির আশা-আকাঙ্খার বাতিঘর, বাঙালি জাতি হয়ে যায় অভিভাবকহীন-এতিম। আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের ভালবাসার মানুষ, আমাদের আস্থার জায়গা, আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে।

বাংলা শ্রাবণ মাসের শেষ পক্ষ হওয়ায় সেদিন ভোর থেকে প্রকৃতিও কাঁদছিল, বৃষ্টিধারা হয়ে যেন নিরবে অশ্রুপাত করছিল প্রকৃতি। ঘাতকের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত সারাবাংলা তখন নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। বাংলার পথে-প্রান্তরে লাখো মানুষ গুমরে আর্তনাদ করেছিলেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় শেখ সাহেব আর তাঁদের বঙ্গমাতাকে হারিয়ে। তাঁদের সেই বিলোপের সাথে একাত্ব হয়ে কেঁদেছে প্রকৃতি, পশু-পাখিও। পঁচাত্তর এর ১৫ই আগস্ট আর শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের রক্তস্রোতে। সেদিনের সেই শ্রাবণের ধারার সাথে মিশে গিয়েছিল অগণিত মানুষের অশ্রুধারাও।

সারাবিশ্ব সেদিন অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখেছিল একদল দেশদ্রোহী, পাষণ্ডের তাণ্ডবলীলা আর জীবনে অন্তিম মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন ভাবাতুর দু’চোখ দেখেছিলেন দানবের পৈশাচিকরূপ। বঙ্গবন্ধুর সে চোখে ছিলো অবাক বিস্ময়, অবিশ্বাস আর এই জাতির প্রতি অপার করুণা। পাকিস্তানি হানাদারগৌষ্ঠী জেলের মধ্যে বন্দি করে রেখেও যে সাহস দেখায় নাই, স্বাধীন বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে সেই সাহস দেখাচ্ছে একদল সামরিক সদস্য এ যেন সত্যি অবিশ্বাস্য ছিলো বঙ্গবন্ধুর কাছে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য সারাটা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়কে বিসর্জন দিয়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন সেই স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ যেন সত্যিই বড় বেমানান ও অবিশ্বাস্য লেগেছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি বঙ্গবন্ধুর সেই অবিশ্বাস্য চোখে-মুখে কী একটুখানি আফসোস বা করুণা হয়েছিল এই জাতির জন্য? একটুখানি অব্যক্ত ভাব কী প্রকাশ পেয়েছিল এই জাতি তাঁকে বুকে আঁকড়ে রাখতে পারল না বলে? কল্পনায় বঙ্গবন্ধুর সেই চোখ মনে পড়লে নিজেকে অপরাধী লাগে, ছোট লাগে। বঙ্গবন্ধুর সেই মুখ বা চোখের ভাষা অব্যক্ত-অপ্রকাশিত থেকে গেলেও আমরা যে জাতি হিসেবে চরম অকৃতজ্ঞ ও স্বার্থপর তা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল মূলত ‘৭৫ এর পরেই।

আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশেরই আজীবনের আফসোস আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি এবং আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্বচক্ষে দেখতে পারিনি। আগস্ট মাস এলেই মনটা বিষন্ন আর বিক্ষুব্ধ হয়ে থাকে। সবটা সময় অপরাধবোধ চারপাশ ঘিরে থাকে। একটা অব্যক্ত চাপা কষ্ট বুকে পাথর হয়ে চেপে থাকে। এ যে কেমন কষ্ট বা অপূর্ণতা তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এ যে কেমন বিক্ষুব্ধতা, কোনভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নিজের অজান্তেই ঘৃণা বর্ষিত হয় খুনীদের প্রতি, এ যেন ঘৃণা প্রকাশ করতেও ঘৃণা হয়। 

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর হাহাকার ও আর্তি ফুটে ওঠে লেখক-কবি-সাহিত্যিকের লেখায়। যদিও ‘৭৫ পরবর্তী কঠিন সময়ে সাহিত্যচর্চাও এতোটা সহজ ছিলোনা। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে শুধুমাত্র সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথই অবরূদ্ধ করা হয় না, সেই সাথে অবরূদ্ধ করা হয়েছিল মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধেরও পথ। কবি-সাহিত্যিকদের কলমের স্বাধীনতাও অবরূদ্ধ করা হয়। তারপরও থেমে থাকেনি কলম। লেখায় প্রকাশ পেতে থাকে আবেগ, অনুভূতি, প্রতিবাদ। কবি রফিক আজাদের একটি কবিতার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন-

এই সিঁড়ি
-রফিক আজাদ

এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-
বত্রিশ নম্বর থেকে
সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে
অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
মাঠময় শস্য তিনি ভালোবাসতেন,
আয়ত দু’চোখ ছিল পাখির পিয়াসী
পাখি তার খুব প্রিয় ছিলো-
গাছ-গাছালির দিকে প্রিয় তামাকের গন্ধ ভুলে
চোখ তুলে একটুখানি তাকিয়ে নিতেন,
পাখিদের শব্দে তার, খুব ভোরে, ঘুম ভেঙে যেতো।
স্বপ্ন তার বুক ভ’রে ছিল,
পিতার হৃদয় ছিল, স্নেহে-আর্দ্র চোখ-
এদেশের যা কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র
তার চোখে মূল্যবান ছিল-
নিজের জীবনই শুধু তার কাছে খুব তুচ্ছ ছিল :
স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে প’ড়ে আছে
বিশাল শরীর…
তার রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে,
সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ :
তার ছায়া দীর্ঘ হতে-হ’তে
মানিচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে!
তার রক্তে প্রিয় মাটি উর্বর হয়েছে-
তার রক্তে সবকিছু সবুজ হয়েছে।
এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-
স্বপ্নের স্বদেশ ব্যেপে
সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে
অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে॥


এই দেশটাকে, দেশের মানুষকে, দেশের সবুজপ্রান্তর, ধান, মাটি, শালিককে আপনার মতো করে আর কেউ ভালবাসবে না পিতা। আপনার জন্ম না হলে আমরা এখনও অন্য কারও দাসত্ব মেনে গোলামী করেই জীবন পার করতে হতো। আপনি না জন্মালে নিজস্ব ভাষা, ভূখন্ড, মানচিত্র, জাতীয় সংগীত হয়ত এতোদিন অধরাই রয়ে যেত আমাদের। আমাদের জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রে এবং গর্ব করার মত সকল অর্জনের সাথে আপনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন পিতা। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিনবছরে আপনার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার উপরেই দাঁড়িয়ে রচিত হচ্ছে আমাদের উন্নত-সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আপনি সারাটা জীবন দেখেছেন, যে বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন আপনার আদর্শের উত্তরসূরি হিসেবে শপথ করে বলছি সেই বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমৃত্যু নিজেকে নিয়োজিত রাখব। বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়া রক্তস্রোতের ঋণ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম অবশ্যই শোধ করব, আগামীর বাংলাদেশের কাছে এই আমার প্রতিজ্ঞা।

লেখক: বিসিএস (তথ্য), সংযুক্তিতে- প্রেস উইং, প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়। 

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর