৯ মার্চ, ২০২৩ ১৭:৩৪

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা

মোহাম্মদ এ. আরাফাত

করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর পথে, ঠিক তখনই শুরু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। ফের সংকটে পড়া বিশ্বের সেই আঁচ এসে পড়ে বাংলাদেশেও। তবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও নিজেদের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। নানা সময়ে সমালোচকরা আর্থিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিলেও, দেশটিতে সংকটের ঝুঁকি প্রায় শূন্য।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাবিষয়ক ‘রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিক্স’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে এসব কথা লিখেছেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ. আরাফাত।

নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রমাণ করে যে দেশটির অর্থনীতি সঠিক পথেই রয়েছে। অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেশটির উন্নতি ত্বরান্বিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

সরকারের নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া। বর্তমান সরকার এরইমধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি নিঃস্ব পরিবারকে থাকার ঘর তৈরি করে দিয়েছে। পদ্মা সেতুসহ অবকাঠামোগত খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিতে অবদান রাখছে। সরকার দ্রুত পরিবহনব্যবস্থা মেট্রোরেল এবং বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ করেছে। এছাড়াও ডিজিটাল অবকাঠামো ও টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থাসহ উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

এই উন্নতিগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু মোট আয় ১৯৯০ সাল থেকে আট গুণ বেড়েছে। ২০২২ অর্থবছরে রফতানি রেকর্ড ৫২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় হয়েছে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, মধ্যবিত্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। শুধু এশিয়ায় নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এর একটি স্ট্যান্ডআউট অর্থনীতি রয়েছে। সম্প্রতি মাথাপিছু মোট আয়ে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের ডিরেক্টর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জেফ্রি শ্যাস ২০২১ সালে ঘোষণা করেছেন, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি করেছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে একটি উল্লেখ্যযোগ্য দিক হলো নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নারীদের ভর্তির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে। এর ফলস্বরূপ, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যেটি ১৯৯৬ সালে ছিল ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, লিঙ্গ মজুরি ব্যবধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বনিম্ন। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের স্কলার ড্যানিয়েল রুন্ডে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রমাণ করে যে নারীর ক্ষমতায়ন কাজ করে।’

শিক্ষা যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি নীতির কারণে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। এ পদক্ষেপ দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের শিক্ষিত কর্মীবাহিনী দেশটির আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করছে। তবে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ এর বিপর্যয় মোকাবিলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে। তবে এই পদক্ষেপও অর্থনীতির গতিকে সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। অর্থনীতিকে ইতিবাচক গতিপথে রাখাতে ব্যবসায়িদের জন্য এই ঋণ নেয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতি এ ধরনের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আস্থা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের ঋণের হার বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন।

আন্তর্জাতিক ঋণমাণ সংস্থা ও আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস সম্প্রতি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটে নেই, এছাড়া দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিও কম। ব্লুমবার্গ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভোক্তা অধিকার, উদ্ভাবন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রবৃদ্ধি-সমর্থক নীতির জন্য আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলার।

এটা ঠিক বাংলাদেশও ঝুঁকিমুক্ত নয়, সরকারেরও এ নিয়ে অনেক কাজ আছে। বাংলাদেশকে অবশ্যই দারিদ্র্যের হার কমানোর প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের জ্বালানি খরচ কমাতেও কাজ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে, তবে এখন আরও কিছু করা উচিত।

এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেকোনো মানদণ্ডে অসাধারণ সাফল্যের গল্প। এ কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে।

লেখক: চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর