বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আবারও সেই আলাদা পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এই দলটির সাম্প্রতিক কর্মসূচি, বিশেষ করে প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে জনমত তৈরির যে চেষ্টা, তা স্পষ্টভাবে জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থে চলমান জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে বিভ্রান্ত করার কৌশল এবং কালক্ষেপণের অংশমাত্র। বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক স্রোতোধারা বহমান, সেটি মূলত ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস। জুলাই সনদ এবং রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরির প্রচেষ্টা চলমান।
কিন্তু এই আলোচনার গতি ও গুরুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পুরনো কৌশলে নতুনভাবে রাজপথে নেমে এসেছে। এই কর্মসূচি আসলে কার বিরুদ্ধে এবং কেন, সেটি উপলব্ধি করতে তাদের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে বর্তমান অবস্থানের ধারাবাহিকতা বোঝার চেষ্টা করাটা অত্যন্ত জরুরি।
জামায়াতে ইসলামী আজ যেভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আক্রমণ করছে, তা মোটেই গণতন্ত্রের পক্ষে কোনো আন্দোলন নয়, বরং তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে জনমনে অসন্তোষ আছে, কিন্তু এই অসন্তোষকে জনগণের বৃহত্তর জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত করে সমাধান খুঁজতে হলে এক ধরনের ঐক্যের প্রয়োজন।
অথচ জামায়াতে ইসলামী সেই ঐক্যকে ভাঙার জন্যই প্রচারযুদ্ধে নেমেছে। তারা জনসাধারণকে বোঝাতে চাইছে যে এই আন্দোলন আসলে নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে, কিন্তু গভীরে তাকালে দেখা যায়, এটি জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। জামায়াত চায়, সমষ্টিগত আলোচনা ভেস্তে দিয়ে নিজেদের কৌশলকে সামনে এনে নিজেদের লক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠা করা। এ কারণেই তাদের আন্দোলন বর্তমান ঐক্যমুখী টেবিলের শান্তিপূর্ণ আলোচনার বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রক্রিয়া এখন জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে। জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে আলোচনার সূচনা হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী বাংলাদেশে সব পক্ষকে একসঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের পথচলা ও গন্তব্য নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু যখন এই সংলাপ পরিণতির দিকে, তখন হঠাৎ করেই জামায়াত রাজপথে নামল। এই নামাটা ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত পদক্ষেপ, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোচনার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা এবং বিভ্রান্তির জন্ম দেওয়া।
কারণ নিজেদের এজেন্ডা যেনতেন প্রকারে চাপিয়ে দেওয়াটা তাদের পুরনো কৌশল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা বারবার জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান—প্রতিটি মুহূর্তেই তারা প্রমাণ করেছে, তারা জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়াতে প্রস্তুত। মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা যেমন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দোসর হয়েছিল, তেমনি স্বাধীনতার পরও কখনোই তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বা জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনি। ১৯৮৬ সালে স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তারা প্রমাণ করেছে, গণতন্ত্র নয়, বরং ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণই তাদের নীতি।
১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনে নামা এবং পরে আবার ভিন্ন সুরে কথা বলা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের দ্বিমুখী চরিত্রকে প্রকাশ করে। এরপর ২০০৭ সালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে তারা জাতীয় রাজনীতিকে ভিন্ন পথে ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই দেখা গেছে, তারা জনগণের স্বার্থ বা জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে না থেকে বরং নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও জামায়াতে ইসলামী সেই পুরনো কৌশলেই ফিরেছে। যখন গোটা জাতি আওয়ামী ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন গণতান্ত্রিক পথ খুঁজছে, তখন তারা পিআর পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনের নামে জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে বিভ্রান্ত করছে। এ যেন তাদের পুরনো অভ্যাসেরই পুনরাবৃত্তি। জনমনে একটি সংশয় সৃষ্টি করা, রাজনৈতিক আলোচনার গতি বাধাগ্রস্ত করা এবং নিজেরা আলাদা একটি শক্তি হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা—এসবই এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য।
তাদের এই অবস্থান শুধু যে আলোচনার টেবিলকে দুর্বল করছে, তা-ই নয়, বরং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য একটি গুরুতর হুমকিও তৈরি করেছে। কারণ আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের অর্জনকে সফল করতে হলে যে ঐক্য দরকার, সেটিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে জামায়াত। তারা আবারও প্রমাণ করছে, তারা জাতীয় ঐক্য বা জন-আকাঙ্ক্ষার অংশ নয়, বরং একটি বহিরাগত শক্তি, যারা সব সময় দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে।
বাংলাদেশের জনগণ বারবার দেখেছে, জামায়াতে ইসলামী কখনোই নীতি, আদর্শ বা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে দাঁড়ায়নি। তাদের মূল লক্ষ্য সব সময়ই ছিল নিজেদের দলীয় অস্তিত্ব রক্ষা করা এবং সুযোগ পেলেই ক্ষমতার অংশীদার হওয়া। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই দলটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে নয়, বরং দুর্বল করতে কাজ করেছে। তাদের বর্তমান পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন কৌশল সেই ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা।
আজ যখন বাংলাদেশের রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তখন জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। তাদের আন্দোলন গণতন্ত্রের জন্য নয়, বরং গণতন্ত্রকে বিভ্রান্ত ও বিপন্ন করার জন্য। তাদের লক্ষ্য জনগণের মুক্তি নয়, বরং নিজেদের সংকীর্ণ এজেন্ডা। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ঐক্যবদ্ধ থেকে আলোচনার পথকে এগিয়ে নেওয়া এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যেমন মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিল, তেমনি আজকের আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনও সেই আকাঙ্ক্ষারই নতুন রূপ। জামায়াতে ইসলামী সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করছে। কারণ তারা সব সময়ই জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং ইতিহাসকে সামনে রেখে বলা যায়, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের কোনো সঙ্গী নয়। তারা বরং সব সময়ই এক বিভ্রান্তির উৎস, একটি বিরুদ্ধশক্তি, যার উদ্দেশ্য জাতির সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অস্তিত্বকে দুর্বল করা।
এ কারণেই একটি বিষয় সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কোনো সহযোগী শক্তি নয়, বরং একটি প্রতিবন্ধকতার নাম। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে এই বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে এবং বর্তমান আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই সত্য উপলব্ধি করে আগামীর পথ চলতে হবে বলে আমরা মনে করি।
লেখক : পিএসসি, জি (অব.), জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক