যে কোনো পরিস্থিতিতেই আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কোনো ষড়যন্ত্রই এ নির্বাচন ঠেকানো কিংবা বিলম্বিত করার চেষ্টায় সফল হবে না। শিগগিরই বদলে যাবে রাজনীতির হিসাব। বিদ্যমান রাজনৈতিক চিত্র পাল্টে যাবে সহসাই। পিআরসহ বেশ কিছু দাবিতে যারা এখন জোটবদ্ধ হয়েছে, সেই জোটেও ভাঙন ধরতে পারে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গেও জোটবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে অনেকে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নতুন কৌশলও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার পাশাপাশি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ইতিবাচক অনেক ঘটনাই ঘটে যেতে পারে বলে বিভিন্ন দলসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা হলেও এখনো এ নির্বাচন নিয়ে মানুষের সংশয় কাটেনি। অনেকে মনে করেন নির্বাচন বানচাল, পেছানো কিংবা প্রলম্বিত করার জন্য কতিপয় দল ও মহল নানান রকমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে নির্বাচন যাতে পিছিয়ে যায়। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা এ নিয়ে ইতোমধ্যে শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। সংশয় প্রকাশ করছেন বিভিন্ন মহলের বিশেষ ব্যক্তিবর্গ। এমনকি খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও সম্প্রতি বলেছেন, কোনো কোনো মহল থেকে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা হচ্ছে। তবে নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হবে-এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন, আগামী ডিসেম্বরের আগেই পাল্টে যাবে দেশের রাজনীতির চালচিত্র। এখন যে চিত্র বিদ্যমান তা আর তখন থাকবে না। বিশেষ করে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনীতির অন্দরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। আজ যারা পিআরের দাবিতে মাঠে আছে, তাদের একটি অংশ তখন পিআরের পরিবর্তে সরাসরি ভোটের পুরোনো পদ্ধতিতেই নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও কোনো না কোনো আদলে নির্বাচনি জোট করতে পারে। বর্তমানে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি।
জানা গেছে, চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যে কটি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে এনসিপি। দলটি এখনো জোট গঠন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও এত দিন ধারণা করা হচ্ছিল, ডানপন্থি কোনো দলের সঙ্গেই জোটবদ্ধ হতে পারে এনসিপি। কিন্তু দলটির নতুন কৌশল পাল্টে দিতে পারে এ ধারণা। কারণ আগামী নির্বাচনে জোট কীভাবে তৈরি হবে, কে কার সঙ্গে জোট করবে, কার সঙ্গে গেলে বেশিসংখ্যক আসন লাভসহ দলের স্বার্থ রক্ষিত হবে তা নিয়ে চলছে নানান বিশ্লেষণ। বিশেষ করে কে কার সঙ্গে কোন এলাকায় কটা আসন ছাড় দেবে, সেসব বিষয়েও আলোচনা ও প্রক্রিয়া চলছে।
স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর রাজনীতিতে জাতীয় নির্বাচন ও জোট গঠন নিয়ে এ আলোচনা শুরু হয়। যা দিনদিন জোরালো হচ্ছে। জানা যায়, জামায়াত একসময় বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে এ জোট ভেঙে যায় গণ অভ্যুত্থানের আগেই। তাই এটা অনেকটাই স্পষ্ট, বিএনপির সঙ্গে আপাতত জোটবদ্ধ হচ্ছে না জামায়াত। তা ছাড়া বিএনপি ছাড়া ডানপন্থি ও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট করার জন্য এক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে জামায়াত। আগামী নির্বাচনে আটটি ইসলামিসহ বেশ কয়েকটি দল নিয়ে এ জোট তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে দলটি।
বিশ্লষকরা মনে করছেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যে দলই ক্ষমতায় যায়, তারাই চায় নিজেদের শক্তি আরও বৃদ্ধি করতে। যার কারণে ভিন্ন মতাদর্শের দলগুলোকেও তাদের সঙ্গে রাখতে চায়। এদিকে বিএনপি ৩০০ আসনে এককভাবে প্রার্থী দেওয়ার কথা বললেও নতুন নির্বাচনি জোট গঠন নিয়েও আলোচনা করছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ডানপন্থি দলের সঙ্গে বাম দলও থাকতে পারে বিএনপির এ জোটে। আলোচনায় রয়েছে কিছু ইসলামি দল এবং সংগঠন।
এদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘এনসিপি তার নিজস্ব রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাবে। কোনো দল যদি মনে করে তারা আমাদের সঙ্গে একমত তাহলে আসতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াতের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছে তাতে এনসিপি যোগ দেয়নি। কারণ আমরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি।’ জানা গেছে, এনসিপির নেতৃত্বেও একটি জোট গঠন হতে পারে। সেটি হলে রাজনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছু নেই। যে ফ্যাসিস্টের পতনের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আমরা এত বছর আন্দোলন করেছি; এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, এত জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে এখন দেখছি তাদেরই ফিরিয়ে আনার জন্য কতিপয় দল মাঠে নেমেছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকেই তারা আবারও পুনর্বাসনের পথ উন্মুক্ত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। এজন্য তাদের কেউ কেউ আগামী নির্বাচনও প্রলম্বিত করতে চায়। তবে দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণের প্রতিরোধের মুখে সব ষড়যন্ত্রই ভেস্তে যাবে। অতএব যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘কোনো ষড়যন্ত্রই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। আমরা যদি জনগণকে গণতন্ত্রের পক্ষে এবং ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, তাহলে কোনো ষড়যন্ত্রই সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ দেশের জনগণ নির্বাচিত সরকারের শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা অধীর আগ্রহে ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। জনগণের ভোটের অধিকার বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ‘জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করা একটি কালচারে পরিণত হয়েছে। যে দলই ক্ষমতায় যায় তারা চায় নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে। এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে নানান ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়। বিরোধী মত চাপে রাখতেও রাজনৈতিক জোটের শরিকরা ভালো ভূমিকা রাখে।’