বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, সংস্কৃতি একটি সমাজের প্রাণ। এটি মানুষের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে, সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং একজন মানুষকে যথার্থ সামাজিক সত্তায় রূপ দেয়। একটি জাতি কতটা সভ্য ও উন্নত তা সংস্কৃতিই নির্দেশ করে।
শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ট্র্যাব) আয়োজিত ‘সাংস্কৃতিক সংকট: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও ট্র্যাব এক্সিলেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০২৫ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ট্র্যাব সভাপতি কাদের মনসুর। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদ, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও নাট্যকার ছটকু আহমেদ, এটিএন বাংলার উপদেষ্টা তাশিক আহমদ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির (বাচসাস) সভাপতি কামরুল হাসান দর্পণ, ট্র্যাব সাধারণ সম্পাদক সুহৃদ জাহাঙ্গীর, অভিনেতা মোশাররফ হোসেন, অভিনেত্রী ফারজানা ছবি, সংগীতশিল্পী নাদিয়া ডোরা, সুমন, শারমিন আহমেদ মিন্নী প্রমুখ।
কাদের গনি বলেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলার সংস্কৃতি আমাদের পরিচয় বহন করে। এদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মিলেমিশে নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। একে অপরের আনন্দ ভাগাভাগি করা এটাই আমাদের সংস্কৃতির বড় শক্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ—সব ঐক্যবদ্ধ শক্তির মূলে ছিল সংস্কৃতি।
তিনি অতীতের সাংস্কৃতিক চর্চার কথা উল্লেখ করে বলেন, একসময় পাড়া-মহল্লায় বা বটতলায় বসত বাউলদের আসর। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, পল্লীগীতি, জারি-সারি কিংবা আধ্যাত্মিক গান মানুষের প্রাণের খোরাক জুগিয়েছে। লালন, শাহ আবদুল করিম, আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলিম, রমেশশীলরা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু এখন সেই জায়গা দখল করেছে বিদেশি হেভি মেটাল ও বাণিজ্যিক গান।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিও বদলে গেছে। লোকনৃত্য, পালাগান বা কবিগানের জায়গা দখল করছে পশ্চিমা ও ভারতীয় প্রভাব। বর্তমানের দুষ্টু রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি ও ধর্মান্ধ রাজনীতি আমাদের গর্বিত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়িয়ে সমাজে বিভাজন তৈরি করছে।
কাদের গনি জানান, এখন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে সময় বেঁধে দেয়া হয়, যাত্রাপালা বা কবিগানের জন্য নিতে হয় অনুমতি। মাজার, যেগুলো একসময় লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক ছিল, সেগুলো ভাঙা হচ্ছে। অথচ মুসলিম সাধকরা এই ভূমিতেই ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিলেন।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আজকে করপোরেটরা পহেলা বৈশাখ, নৌকাবাইচসহ সব লোকজ উৎসব দখল করে নিয়েছে। এমনকি বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো আয়োজনও এখন লাখ টাকা খরচ ছাড়া হয় না। সংস্কৃতি এখন ক্ষমতাবানদের হাতে চলে গেছে, প্রাণশক্তি হারাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে নিছক আনুষ্ঠানিকতা।
নিজের শৈশবের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা ছোটবেলায় যাত্রাপালা, নাটক, মেলা উপভোগ করতাম। এখন গ্রাম থেকে এই সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা আর পাঠাগারে যায় না, গান শোনে না, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পড়ে না। অথচ এগুলো জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করার জন্য জরুরি।”
গানের শক্তির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গান মনের অন্ধকার দূর করে, ভোরকে সুন্দর করে তোলে। কিন্তু আজ সবাই কোচিং ও স্কুলে ব্যস্ত, সংস্কৃতি হয়ে গেছে অপশনাল বিষয়। সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, কিন্তু শিল্পী হতে চায় না। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কথা কেউ চিন্তা করে না।
বিডি প্রতিদিন/আশিক