বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের প্রসার শিশু-কিশোরদের কাছে নতুন এক জগৎ উন্মোচন করেছে। তবে সে জগৎ সব সময় নিরাপদ নয়। শিক্ষার পাশাপাশি গেমিং, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিনোদনে ঝুঁকে পড়া কিশোরদের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা। অতিরিক্ত গেমিংয়ে আসক্তির কারণে মানসিক রোগেও ভুগছে তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশু-কিশোরের বড় একটি অংশ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকে ‘রোবলক্স’, ‘মাইনক্রাফট’, ‘ফোর্টনাইট’ বা ‘কোগামা’র মতো গেমে। এর বড় অংশই স্মার্টফোন ব্যবহারকারী। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, এসব গেমের মাধ্যমে তারা অনলাইনে শিকার হচ্ছে অশ্লীল কনটেন্ট, সাইবার বুলিং এমনকি অপরাধী চক্রের ফাঁদেও পড়ছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, ২০২৪ সালে রোবলক্সে প্রতিদিন গড়ে ৮ কোটি ৫০ লাখ মানুষ গেম খেলে। এর প্রায় ৪০ শতাংশের বয়স ১৩ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এ গেম ও অনুরূপ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। মনোবিদরা মনে করছেন, এসব প্ল্যাটফর্মে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমে তীব্র হচ্ছে।
ঢাকার শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একবার অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়লে শিশু বা কিশোরকে সেখান থেকে বের করে আনা অত্যন্ত কঠিন। এতে তাদের ঘুম, পড়াশোনা, সামাজিক মেলামেশা ও মানসিক বিকাশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ ভিডিও গেমস অ্যাডিকশন স্ট্যাটিস্টিকস অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৮ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে ৮.৫ শতাংশ গেমার গেমিং ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিশুদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা, হঠাৎ রাগ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মহত্যার প্রবণতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে; যার পেছনে অন্যতম কারণ স্মার্টফোন ও অনলাইন গেমে আসক্তি। চট্টগ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রাকিব (ছদ্মনাম) সারা রাত ‘রোবলক্স’ খেলত। একদিন গেমের ভিতরেই তাকে একটি গ্রুপে ডাকা হয়, যেখানে চলছিল অশ্লীল দৃশ্য। এরপর তাকে হুমকি দেওয়া হয় স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দেওয়ার। আতঙ্কে পড়ে পড়াশোনায় মনোযোগ হারায় সে। পরিবারের অজান্তে এভাবেই কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে মানসিক যন্ত্রণায়। চট্টগ্রামের ঘটনা কেবল একটি উদাহরণ। অনলাইন গেম খেলার নেশা থেকে শুরু করে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে পরিচয় এবং অবশেষে ফিশিং ও হ্যাকিংয়ের এ ধাপে ধাপে পতন আজ দেশের অনেক কিশোরের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গেমিং আসক্তির কারণে ফ্রি ফায়ার, পাবজি, কল অফ ডিউটির মতো গেমে অস্বাভাবিক সময় ব্যয় করছে ১২-১৮ বছরের কিশোররা। ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের নামে অপরিচিতদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে; এদের অনেকে অপরাধী চক্রের অংশ। গেমিং কমিউনিটি বা সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে যুক্ত হয়ে কিশোররা পর্নোগ্রাফি, সহিংসতা, জুয়া ও বাজির মতো কনটেন্টে আসক্ত হচ্ছে। অনেক চক্র শিশুদের শেখাচ্ছে ফিশিং, হ্যাকিং, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ও অনলাইন প্রতারণা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাত জেগে গেম খেলার কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে শিশু-কিশোরদের। অর্থের লোভে কিশোররা হয়ে উঠছে প্রতারক বা হ্যাকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সাইবার অপরাধ দমনের জন্য। তবে অপ্রাপ্তবয়স্করা অপরাধে জড়িয়ে পড়লে পরিবার ও সমাজের জন্য তা আরও জটিল হয়ে ওঠে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে শাস্তির পাশাপাশি পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) ফয়েজ আহমদ তৈয়ব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাবজিসহ অনলাইন বিভিন্ন গেমিং সাইট বন্ধ নিয়ে কথা হয়েছিল। আমরা বলছি পাবজি যদি কনফার্ম করতে পারে তারা ১৮ বছরের নিচে কাউকে এ গেম খেলতে দেবে না তাহলে আমরা তা ওপেন করব না। গুগুল বা ম্যাক পেরেন্টাল ক্লাবের মাধ্যমে কন্ট্রোল করতে হবে। সরকার এ ক্ষেত্রে আইন করে কন্ট্রোল করতে পারবে না বলে আমার ধারণা। বাবা-মা যদি সচেতন না হন, তাহলে কোনোভাবেই এটা কন্ট্রোল করা যাবে না।’