মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশে বাড়ছে ফ্রিজের বাজার

জয়শ্রী ভাদুড়ী

দেশে বাড়ছে ফ্রিজের বাজার

আধুনিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে রেফ্রিজারেটর। ছোট-বড় সব পরিবারেই এখন রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ একটি অতিপ্রয়োজনীয় যন্ত্র হয়ে উঠেছে। ফ্রিজই বর্তমানে শহুরে জীবনকে করে তুলেছে সহজ। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ফ্রিজের বিকল্প নেই। ফলে বড় হচ্ছে ফ্রিজের বাজার। ঈদ ঘিরে জমজমাট কেনাকাটা চলছে শোরুমে।

ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে শহর। গ্রামেও এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলে মোটামুটি সচ্ছল মানুষের ঘরে ঘরে ফ্রিজ। অনেকে একবারে অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে কিস্তিতে হলেও কিনছে ফ্রিজ। মানুষ এখন খাবারের উৎস থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্যাকেটজাত খাবারে আগ্রহ বাড়ছে ভোক্তাদের। এসব খাবার পথে বহনের সময় এবং বাসায় নেওয়ার পর ঠিক রাখতে হলে অবশ্যই সেগুলো ঠাণ্ডায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই কাজটাই করছে ফ্রিজ।

একটা সময় ছিল যখন দেশে ব্যবহৃত ফ্রিজগুলো আমদানি করা হতো। এখন সেই জায়গায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড। ফলে যেমন ফ্রিজ অনেক বেশি সহজলভ্য হয়েছে জনসাধারণের কাছে তেমনি বিস্তৃত হয়েছে এর বাজারও। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রতি বছর ৩০-৪০ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে। ফলে এ খাতে কর্মক্ষেত্রও বেড়েছে ব্যাপকহারে।

পরে ধীরে ধীরে দেশে ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে। অনেকেই এগিয়ে আসায় সরকারও যথাযথ নীতি সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে ফ্রিজের আমদানিনির্ভরতা কমছে। তাতেই পণ্যটির বর্তমান বাজারে দেশীয় কোম্পানিগুলোর রাজত্ব বাড়ছে। বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে পণ্যটি রপ্তানিও করছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া জনসাধারণের জন্য ইএমআই বা কিস্তিতে নেওয়ার সুবিধা নিয়ে আসায় এখন ঘরে ঘরে অনেক সহজলভ্য হয়ে উঠেছে ফ্রিজ।

২০২১ সালে প্রকাশিত মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) এক গবেষণা বলছে, দেশে ফ্রিজের বাজারের বেশির ভাগই দেশীয় ব্র্যান্ডের দখলে। বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক ধরে ফ্রিজের বাজার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। পণ্যটির ব্যবহার শহরের চেয়ে গ্রাম ও উপ-শহরগুলোয় এখন অনেক বেশি হারে বাড়ছে। মধ্য ও উচ্চবিত্তের দ্রুত বিকাশ, ছোট পরিবার ও নারী কর্মজীবীর সংখ্যা বেশি পরিমাণে বেড়ে যাওয়া, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে উপ-শহরীকরণ প্রক্রিয়া, কম খরচে দেশীয় ফ্রিজ কেনার সক্ষমতা এবং ফ্রিজ বিক্রেতাদের ক্রেতাবান্ধব শর্তাবলি (যেমন কিস্তিতে ক্রয়, ওয়ারেন্টি ইত্যাদি) ফ্রিজ মার্কেট প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করছে।

এমডব্লিউবির ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে দেশে প্রায় ৩২ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। তথ্য বলছে, বর্তমানে ফ্রিজের বাজারের আকার প্রায় ৬৮ কোটি ডলারের। চলতি বছর তা বেড়ে ৮৮ কোটি ডলার বা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।

সাধারণত ক্রেতারা ফ্রিজ কেনার সময় দাম, স্থায়িত্ব, বিদ্যুৎ সাশ্রয়, কম্প্রেসার, বিক্রয়োত্তর সেবা, নকশা ও আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। অন্যদিকে ফ্রিজ থেকে পানি বের হওয়া, কম্প্রেসারের বাড়তি শব্দ, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ, বেশি বরফ জমা, নির্দিষ্ট সময় পরপর কম্প্রেসারের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া নিয়ে অভিযোগ করতেও দেখা যায় অনেককে। তবে এমডব্লিউবির গবেষণা বলছে, অপেক্ষাকৃত কম দামে মোটামুটি ভালো মানের ফ্রিজ তৈরিতে সক্ষম হওয়ার কারণেই দেশীয় ব্র্যান্ডের ফ্রিজগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

যদিও ফ্রিজের এ রমরমা বাজারে কিছুটা ভাটা দেখা গিয়েছিল গত দুই বছরের করোনা সংক্রমণের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সময়ে। সে সময় ফ্রিজ বিক্রি কিছুটা কমে গেলেও প্রতি বছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে পণ্যটির বাজার বড় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

দেড় দশক আগে ওয়ালটন দেশে ফ্রিজের উৎপাদন শুরু করে। এর আগ পর্যন্ত পণ্যটি আমদানিনির্ভর ছিল। ওয়ালটন আমদানি করা ফ্রিজের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে পণ্যটি সরবরাহ করায় সেটি অনেকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। তখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিশ্বখ্যাত একাধিক ব্র্যান্ড দেশে ফ্রিজ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। ফলে ধীরে ধীরে ফ্রিজে আমদানিনির্ভরতা কমছে। বর্তমানে পণ্যটির বাজারে দেশীয় কোম্পানিগুলোই দাপট দেখাচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিতেও মনোযোগ দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। 

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০১৪ সালে ফ্রিজের ব্যবসা শুরু করে। নরসিংদীতে তাদের কারখানায় দিনে দেড় হাজার ফ্রিজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ভিশন ও ভিগো ব্র্যান্ড নামে দেশে বাজারজাত করার পাশাপাশি ভারত ও নেপালে ফ্রিজ রপ্তানি শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

২০ বছর ধরে ফ্রিজের বাজারে ক্রেতাদের আগ্রহ ধরে রেখেছে মিনিস্টার মাই ওয়ান গ্রুপ। মিনিস্টার নিজের পণ্যের নকশা ও উন্নয়ন নিজেরাই করে থাকে। গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে রয়েছে তাদের বিশাল দক্ষ কর্মীবাহিনী। গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ও ময়মনসিংহের ত্রিশালে সবুজ অরণ্যে সুবিশাল পরিসরে মিনিস্টার গ্রুপের দুটি কারখানা রয়েছে এবং রাজধানী ঢাকায় রয়েছে মিনিস্টারের করপোরেট অফিস। মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইর সহসভাপতি এম এ রাজ্জাক খান রাজ বলেন, ‘আমরা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা করেছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বাজার, পুঁজি, কারিগরি দক্ষতাসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধা রয়েছে।’ ফ্রিজের বাজারে ক্রেতাদের পছন্দের অন্যতম ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে যমুনা। যমুনা ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলস লিমিটেডের পরিচালক (মার্কেটিং) সেলিম উল্যা সেলিম বলেন, ‘গত এক যুগে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাতে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। বর্তমান সরকারের গৃহীত শিল্পবান্ধব নীতিমালা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও উদ্যোক্তাদের দেওয়া নানা সুবিধার ফলে এ খাতে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। একসময় এ খাত ছিল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এক যুগের ব্যবধানে সে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। দেশীয় ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাতে ক্রমবর্ধমান বিকাশের ফলে আমদানি ব্যয় অনেক কমেছে, পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।’

দেশীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে অন্যতম ওয়ালটন। ১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে ওয়ালটন ইলেকট্রনিক্সের বাজারে যাত্রা শুরু করে। ২০০৫ সালের শেষ দিকে তারা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব জমিতে কারখানা গড়ে তোলে। সেই কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড স্যামসাং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দেশে ফ্রিজ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে বেশকিছু ইলেকট্রনিক্স প্রতিষ্ঠান। ক্রমবর্ধমান ফ্রিজের বাজার ধরতে তারা নিচ্ছে নানামুখী উদ্যোগ। চীনা ব্র্যান্ড কনকা দেশে উৎপাদন করছে ইলেকট্রো মার্ট। সোনারগাঁয়ে স্থাপিত কারখানায় কনকার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড হাইকোর ফ্রিজও উৎপাদন করছে। বিশ্বখ্যাত কেলভিনেটর, এলজি, ইলেকট্রোলাক্স ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটরের একমাত্র অনুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে পণ্য বাজারজাত করে র‌্যাংগ্‌স ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড। কয়েক বছর আগেও গরমের মৌসুম এলেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসির বিক্রি বাড়ত। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফ্রিজও। এবার ঈদ কাছাকাছি হওয়ায় এবং এ সময়ে গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ফ্রিজের বিক্রি অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ফ্রিজের বাজারে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান র‌্যাংগ্‌স ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড পণ্যের গুণগত মানে নজর দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। রেফ্রিজারেটরের ক্ষেত্রে এর গুণগত মান বাহ্যিক আকর্ষণীয় ডিজাইন, সহজ ব্যবহার পদ্ধতি, বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং পরিবেশবান্ধব যন্ত্রাংশ নিশ্চিতে কাজ করছে র‌্যাংগ্‌স।

সর্বশেষ খবর