জেলাভিত্তিক পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ৪ বছরের কোর্স শেষ করেও চাকরির বাজারে ঢুকতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘পিপলএনটেক’। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইটি ইনস্টিটিউট ‘পিপলএনটেক’ রাজধানী ঢাকার গ্রীণরোডে (গুডলাক সেন্টার, ১৫১/৭ গ্রীণরোড) সম্প্রসারণ করেছে সকল কার্যক্রম। সেখানেই চলছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর এসব উদ্যমী সন্তানদের ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট’র (প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড জব প্লেসমেন্ট) কাজ। এজন্যে টেকনিক্যাল থেকে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক বরাদ্দ মাথা পিছু সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকাতেই কোর্স দিচ্ছে পিপলএনটেক। সাথে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে।
৩ মাসের এসব কোর্স দিতে ন্যূনতম ফি লাগে ৪০ হাজার টাকা। সে স্থলে নেয়া হচ্ছে ৮ হাজার টাকা করে। অর্থাৎ পিপলএনটেক’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ইঞ্জিনিয়ার আবু হানিপ এ দায়িত্বটি কাঁধে নিয়েছেন মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে।
‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট’র এই কর্মসূচি তথা ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট’র জন্য প্রথম বছরে এসেছিলেন ২০০ জন। চলতি দ্বিতীয় বছরে এসেছেন ৪০০ জন। এরা এসেছেন ভোলা, বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, রংপুর, চাপাইনাববগঞ্জ, যশোর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, শরিয়তপুর প্রভৃতি জেলা থেকে।
বিশেষ এ সেবামূলক কার্যক্রমে রয়েছে : এ+, ২০০-১২৫ : সিসিএনএ রাউটিং এ্যান্ড সুইচিং, সার্টিফাইড নেটওয়ার্ক এসোসিয়েট, আরএইচ১২৪ : রেড হ্যাট লিনাক্স সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেশন-১, ২ এবং ৩, ৭০-৭৪০: ইন্সটলেশন, স্টোরেজ এ্যান্ড কম্প্যুটার উইথ উইন্ডোজ সার্ভার ২০১৬, ৭০-৭৪১: নেটওয়ার্কিং উইথ উইন্ডোজ সার্ভার ২০১৬, প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ সি/সি++, জাভা স্ট্যান্ডার্ড এডিশন, এ্যান্ড্রয়েড এ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট, ১ডিও-৫২০:সিআইডব্লিউ-ওয়েব ডিজাইন স্পেশালিস্ট, পিএইচপি এ্যান্ড মাই এসকিউএল উইথ লারাভেল (ওয়েব ডেভেলপমেন্ট), ৭০-৪৮৩: প্রোগ্রামিং ইন সি#, ৭০-৪৮৪: এ্যাসেন্সিয়াল্্স অব ডেভেলপিং উইন্ডোজ স্টোর এ্যাপস উইজিং সি#, ৭০-৪৮৬: ডেভেলপিং এএসপি, নেট, এমভিসি ৬ কোর ওয়েব এ্যাপ্লিকেশন, ৭০-৭৬১: কুয়েরিং ড্যাটা উইথ ট্র্যাঞ্জেট-এসকিউএল ২০১৬, ৭০-৭৬২: ডেভেলপিং এসকিউএল ড্যাটাবেস২০১৬, ওরেক্যল ১২সি ডিবিএ, অটো সিএডি ২ডি এ্যান্ড ৩ ডি, ক্রিয়েটিভ গ্রাফিক ডিজাইন এ্যান্ড আউটসোর্সিং : ফটোশপ এ্যান্ড ইলাস্ট্রেটর (ক্রিয়েটিভ ক্লাউড), ৩ডি ম্যাক ফান্ডামেন্টাল, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন এবং ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং।
ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার সন্তান শ্রাবণী আকতার লিথি যশোর পলিটেকনিক্যাল থেকে ৪ বছরের কোর্স শেষ করে এসেছিলেন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট’ ডিপ্লোমা নিতে। এলাকার পরিচিতজনেরা তাকে উদ্বুদ্ধ করেন। লিথি এ সংবাদদাতাকে বললেন, পিপল এন টেক থেকে কোর্স নিতে এসে আমার দীগন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সেটি করার পর এই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি পেয়েছি। এখন কাজের পাশাপাশি ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’ শিখছি। এছাড়া আউটসোর্সিং জবও করছি।
লিথি জানান, সারাদেশেই পিপলএনটেকের এই বিশেষ সহযোগিতার কথা প্রচারিত হচ্ছে। এজন্যে কোন বিজ্ঞাপণের প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ, যারা আসছেন কোর্স নিতে তারাই পরিচিতজনদের উৎসাহিত করছেন। স্কিল ডেভেলপমেন্টের এই কোর্স গ্রহনের পর সকলেই আস্থাবান হচ্ছেন নিজের কর্মজীবন নিয়ে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর এসব ছাত্র-ছাত্রীকে কোর্স গ্রহণকালীন ঢাকায় অবস্থানের সহযোগিতাও দিচ্ছে পিপলএনটেক।
বিশ্বমানের দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ার এ কার্যক্রম সম্পর্কে ‘পিপলএনটেক’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার আবু হানিপ বললেন, গ্রামাঞ্চলের গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাই সাধারণত: এসএসসি পাশের পর পলিটেকনিকে যায়। সেখানে তারা চার বছরের কোর্স গ্রহণকালে শুধু থিউরিটিক্যাল জ্ঞানলাভে সক্ষম হন। ব্যবহারিক কিছুই শিখতে পারেন না। অথচ চাকরির জন্যে দরকার ব্যবহারিক তথা প্র্যাকটিকেল জ্ঞান। তা না হলে দক্ষ কর্মী হিসেবে দাবি করা যায় না। চাকরির বাজারে প্রবেশ করাও কঠিন।
হানিপ উল্লেখ করেন, আউটসোর্সিংয়ে উপযোগী করতে বিনা ফি-তে ইংরেজী কোর্সও দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যেসব কোর্স সম্পাদনে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা দরকার, সে স্থলে নিচ্ছি ৮ হাজার টাকা করে। শুধু তাই নয়, পারিবারিক কিংবা অন্য কোন কোটায় অভিবাসী মর্যাদায় যুক্তরাষ্ট্রে যেতে আগ্রহীরাও আমার ইন্সটিটিউটে কোর্স নিচ্ছেন। ঢাকায় কোর্স গ্রহণের পর গত দু’বছরে যুক্তরাষ্ট্রে অবতরণের পরই কমপক্ষে একশত জন আইটি সেক্টরে চাকরি পেয়েছেন। আর যারা চাকরি পাননি তাদেরকে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বিনা ফি-তেই প্রস্তুতি কোর্স অব্যাহত রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে।
জেলাভিত্তিক টেকনিক্যাল স্কুল থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যেও চাকরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে পিপলএনটেক থেকেই। আর এভাবেই ‘আন্তর্জাতিক বাজারের উপযোগী দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরীর ক্ষেত্রে অভাবনীয় এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে পিপলএনটেক’-অভিমত সুধীজনের।
উল্লেখ্য, গ্রীণরোড এবং পান্থপথের কর্ণারে সুপরিসর স্থানেও জায়গা না হওয়ায় নিকটস্থ ধানমন্ডিতে তার সম্প্রসারণ ঘটানো হচ্ছে। আরও উল্লেখ্য, দেড় দশকেরও অধিক সময় যাবত কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী সংলগ্ন ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যভিত্তিক ‘পিপলএনটেক ইন্সটিটিউট’ থেকে সংক্ষিপ্ত কোর্স গ্রহনের পর এ যাবত ৬ সহস্রাধিক উদ্যমী বাংলাদেশী উচ্চ বেতনে মার্কিন আইটি সেক্টরে চাকরি পেয়েছেন। এরমধ্যে নারীর সংখ্যাও অনেক এবং ইতিমধ্যেই অনেকে বিভিন্ন কোম্পানীর নেতৃত্ব লাভ করেছেন।
আবু হানিপ উল্লেখ করেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রে বহুজাতিক এ সমাজে প্রত্যাশিত বেতনে চাকরি না পেয়ে অডজবে লিপ্ত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেরই আজ আমেরিকান স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে মাতৃভূমি বাংলাদেশেও রেমিটেন্স প্রেরণের হার কয়েকগুণ বেড়েছে।
জানা গেছে, পলি টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট কোর্স প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন হাইটেক পার্ক এবং সোনালী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইবিএল, আকিজ গ্রুপসহ খ্যাতনামা কোম্পানীর চাকরি উপযোগী কোর্স দেয়া হচ্ছে। ঢাকায় বর্তমানে ৬০টি বিষয়ে কোর্স প্রদান করা হচ্ছে ১৫ শতাধিক ছেলে-মেয়েকে। পলিটেকনিকের মত অন্য কোর্স গ্রহণকারিদের জন্যেও বৃত্তির ব্যবস্থা থাকায় প্রতি মাসে ঢাকার এই ইন্সটিটিউট পরিচালনায় আবু হানিপকে ভর্তুুকি দিতে হচ্ছে গড়ে ৫ লাখ টাকা করে।
এ প্রসঙ্গে আবু হানিপ এনআরবি নিউজের এ সংবাদদাতাকে বলেন, আমি সবকিছু ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি না। প্রিয় মাতৃভূমি আমাকে অনেককিছু দিয়েছে। এবার রিটার্নের পালা। দক্ষ জনশক্তি গঠনের এ কার্যক্রমে আমি ভ’ষণ খুশী হই, যখোন জানি যে তারা উচ্চ বেতনে চাকরি পেয়েছেন। সেখানই আমার তৃপ্তি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে অবতরনের পর প্রথম নামমাত্র বেতনে রেস্টুরেন্টে চাকরি করেছি। ট্যাক্সি চালাতেও হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির উচ্চতর ডিগ্রি থাকা সত্বেও। সে সব কঠিন দিনগুলোর কথা একমুহূর্তের জন্যে ভুলতে চাই না।
উল্লেখ্য, দেড় দশকের ব্যবধানে পিপলএনটেক’র ক্যাম্পাস ভার্জিনিয়া থেকে নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়ায় বিস্তৃত হয়েছে। অনলাইনেও ক্লাস নিচ্ছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা।
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম