১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ১৪:০৮

ইতিহাস ঐতিহ্যে বর্ষবরণ

নাসরিন আক্তার

ইতিহাস ঐতিহ্যে বর্ষবরণ

ছবি: জয়ীতা রায়

উৎসব প্রিয় বাঙালি বাংলা ঋতুচক্রের নানা আবহে সারা বছর ধরেই কোন না কোন উৎসব পালন করে থাকেন। বাঙালির চিন্তা চেতনা ও মননে উৎসব যেন একাকার হয়ে মিশে আছে। তেমনি একটি উৎসব হলো - আমাদের পহেলা বৈশাখ। বাঙালির পহেলা বৈশাখ হলো গ্রাম্য জীবনের সাথে নগর জীবনের একটি সেতু বন্ধন। শান্ত স্নিগ্ধ গ্রামীণ জীবন আর ব্যস্ত নগর জীবনকে এই নববর্ষই একত্র করে আমাদের জাতীয়তাবোধে। 

জাতি, ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে বাঙালি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে শুধু বাঙালি জাতিই নয় বাংলা ভাষাভাষী, আদিবাসী, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষকে এই পহেলা বৈশাখ একই ছায়ায় নিয়ে আসে। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরির বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর হয় আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিলো 'ফসলি সন' পরে 'বঙ্গাব্দ' বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আর আকবরের সময় কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উৎযাপন শুরু হয়।

তখন বাংলা নববর্ষ শুরুটি কিন্তু ১সাল দিয়ে শুরু হয়নি। প্রথম শুরুটি ছিলো ৯৬৩ সাল। হিজরি বছরটিকে ঠিক রেখেই নতুন একটি বর্ষপঞ্জী চালু করা হয়। বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সালের মৌলিক পার্থক্য হলো - হিজরি সাল চাঁদের হিসেবে আর খ্রিস্টীয় সাল ঘড়ির হিসেবে চলে। ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে, হিজরি সালের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায়, নতুন চাঁদের আগমনে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে সূর্যদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।

বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এর কৃতিত্ব সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কের আর মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেন। মূলত খাজনা আদায়ের সুষ্ঠুতা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌরসন বা আরবি হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।

আকবরের সময় কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। প্রত্যেক বাংলা মাসের শেষের দিনের মধ্যে প্রজারা খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতেন এবং পরের দিন ভূমির মলিকরা প্রতিবেশীদের নানা রকম মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো। যা আজকের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তখনকার সময় এই দিনের একটি প্রধান ঘটনা ছিলো হালখাতা তৈরি করা।

বাংলা সনের মূল নাম ছিলো 'তারিখ-এ-এলাহী'। এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে

"তারিখ-এ-এলাহী'' প্রবর্তন করেন মুঘল সম্রাট আকবর। 'তারিখ- এ-এলাহী'র বারোমাসের নাম ছিলো- কারবদিন, আর্দি, বিসুরা, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ও ইস্কান্দার মিজ।

পরবর্তীতে এই বারো মাসের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়- বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। কিন্তু কারো পক্ষেই এটা বলা সম্ভব নয় কখন কিভাবে এই নামগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। অনুমান করা হয় বর্তমান ১২টি মাস নক্ষত্রের নাম নিয়ে নামকরণ করা হয়। 

বিশাখা থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থ থেকে জৈষ্ঠ্য, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবনী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন আর চিত্রা থেক চৈত্র।

বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে বাংলা দিনপঞ্জিকাকে সংশোধিত করা হয়। নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন এই ছয় মাস ৩১ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস ছাড়া বাকি পাঁচ মাস ৩০দিন পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের কেবল অধিবর্ষের বছর ৩০ দিনে হবে। 

নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ওতোপ্রতো ভাবে মিশে আছে। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৪ই এপ্রিল দিনটি নির্ধারিত করা হয়েছে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।

নানা আয়োজনে আর উপাচারে সাজানো হয় বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে। বাংলা নববর্ষে ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হলো -
 " শুভ নববর্ষ "। বৈশাখী মেলা, ইলিশ পান্তা, হালখাতা, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, কুস্তি মঙ্গলশোভা যাত্রা, বর্ষবরণের অনুষ্ঠান এমনি নানা আয়োজনে বাংলার মানুষ মেতে ওঠে এই দিনে।

পহেলা বৈশাখের আয়োজনের একটি প্রধান উপাদান পান্তা ইলিশ। গ্রামীণ সাধারণ জীবন ধারার একটি নিত্যদিনের নাস্তা হলো এই পান্তা ভাত। আর এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বছরের প্রথম দিনে নানা রকম ভর্তা, কাঁচামরিচ, কাঁচা পেঁয়াজ আর জাতীয় মাছ ইলিশ সহযোগে খাওয়া হয় এই পান্তা ভাত।

১৯৮৩ সালে চৈত্রের কোন এক বিকেলে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সাংবাদিক বোরহান আহমেদ। উনি রমনার বটমূলে পান্তা ইলিশ চালুর প্রস্তাব দেন। আর তারপর থেকেই রমনার বটমূলের একটি প্রধান অংশ হয়ে ওঠে এই ইলিশ পান্তা।

নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণ করার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হালখাতা। আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি এটি। পুরোনো হিসেবের খাতা বন্ধ করে নতুন হিসেবের খাতা খোলার আনন্দ আয়োজন, সঙ্গে আপ্যায়ন ও আনুষ্ঠানিকতার নামই হালখাতা।

শহর ও গ্রামের নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বৈশাখী মেলা। নানারকম কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন মিষ্টি, নাগরদোলা এমনি নানা উপাচারে সাজানো থাকে এই মেলা। ধারণা করা হয় ১৮৬৪ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে প্রথম বারের মতো এই মেলার আয়োজন করা হয়। আর ১৯৭৭ সালে সাহিত্য পত্র 'সমকাল' এর সহযোগিতায় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে প্রথম বৈশাখী মেলার আয়োজন করা ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যক অঙ্গ হলো 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'।

১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ। এটির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে নানা রকম মুখোশ ও ভাসমান প্রতিকৃতি যা শক্তি ও শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অশুভকে দূরে সরানোর প্রতীক।বিভিন্ন জ্ঞানের উপাদান, নানা রকম পেশাজীবী মানুষের প্রতীক।

১৯১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'কে  "মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" হিসেবে ঘোষণা করেন।
 
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রাণের উৎসব এই বাংলা নতুন বছরের বর্ষবরণ। বাঙালির চিন্তা চেতনা ও মননে লালিত হয়ে আসছে এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। আকাশ সংস্কৃতির যুগে এই বর্ষবরণ যেন আমাদের আগামী প্রজন্মকে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সবভুলে আপামর বাঙালী এক হয়ে যায় এই দিনে।


লেখক: শিক্ষক, শাহ্ জাফর টেকনিক্যাল কলেজ, বোয়ালমারী।
 


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর