শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

জনকের রক্তাক্ত ছবি

মঈনুদ্দিন কাজল

জনকের রক্তাক্ত ছবি

প্রায় প্রতিদিন ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়ির সামনে সে আসে, মফিজের মাথায় উসকু-খুসকু লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি। শ্যামবর্ণের লোকটির চেহারায় পঞ্চাশোর্ধ বয়সের ছাপ। পরনে কালো প্যান্ট ও গায়ে ধূসর রঙের জামা। পায়ে বাদামি রঙের জুতা।

ধীরগতিতে হেঁটে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’-এর সামনের রাস্তার বিশাল ফুটপাতে পায়চারি করতে থাকে সে, নিচের দিকে তাকিয়ে হেঁটে হেঁটে সামনে-পিছে যেতে যেতে কি জানি এক ভাবুক মন তার। সুন্দর ফুরফুরে বাতাস বইছে। আকাশ কিছুটা মেঘলা। আলো-আঁধারির খেলা প্রকৃতির ওপর আছড়ে পড়ছে। হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি লাফিয়ে পড়তেই পথচারিদের পায়ের আওয়াজ বেড়ে যায়। বৃষ্টির প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই মফিজের। সে চোখ না তুলেই হাঁটছে আপন মনে-তার গতিধারা একইরকম।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে টিকিট কিনে বত্রিশ নম্বরের বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে ঢোকার জন্য বেশ বড় লাইন। জাতির জনকের অসংখ্য ভক্ত ভিড় করেছে। বত্রিশ নম্বর বাড়ির সামনের প্রশস্ত রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাতের পাশেই টিকিট ঘরটি অবস্থিত। এর কয়েক গজ দূরেই রয়েছে একটি বইয়ের দোকান। চারদিকে কাচ দিয়ে ঘেরা দোকানটিতে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখা বিভিন্ন লেখকের বইয়ের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বই ও দেশাত্মবোধক গান ও মুক্তিযুদ্ধের গানের অডিও সিডি বিক্রি হচ্ছে। দুজন মেয়ে বিক্রেতা সবুজের ভিতর লাল সূর্য খচিত বাংলাদেশের পতাকা-সমৃদ্ধ গেঞ্জি গায়ে দেশপ্রেম শোভিত করে যেন দিগন্তে পাখা মেলে দিয়েছে।

মফিজের চলনে তখনো শীতলতা কাটেনি। সে অন্য মনস্ক হয়ে যেন উ™£ান্ত মানুষ, বৃষ্টি ভেজা কাকের মতো গুটিশুটি হয়ে নিচু করে রেুখেছে মাথা। এত কী ভাবে মফিজ? মহাসমস্যায় পড়েছে যেন সে। বড় ধরনের চিন্তাবিদ মফিজ। যে কেউ দেখলেই এ ভাবুক মানুষটাকে নিয়ে ভাবে সে যেন চিন্তারাজ্যেই ডুব তুলছে স্বপ্ন-প্রবাল।

একদল স্কুল ছাত্রছাত্রী বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জাদুঘর দেখার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাশে অবস্থিত ‘ডাব ভ্যানের’ পাশে বাস থেকে নামছে। ওদের শিক্ষকের নির্দেশ মতো লাইন ধরে স্মৃতি জাদুঘর চত্বরে ঢুকল। তাদের ট্যুর গাইড হিমানি মিস টিকিট সংগ্রহ করে জাদুঘরের ভিতর প্রবেশের আগেই শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করে জানতে চায় : আমরা এখানে কেন এসেছি?

শিক্ষা সফরে, উত্তর দিল একজন ছাত্রী।

আমরা কোথায় এসেছি?

বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর জাতির জনকের বাড়ি।

বলতো তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেয়েছেন?

সবাই চুপ, উত্তর দেয় না কেউ।

তার মানে তোমরা এর উত্তর জান না। তবে শোন, এই বলে হিমানি মিস ওদের উদ্দেশে বলেন : ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার সমাবেশে দেশপ্রেমিক শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পান।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই বত্রিশ নম্বরের সামনে দর্শনার্থী বাড়তে শুরু করে। অনেকে ভিতরে না ঢুকলেও লেকের সামনে গিয়ে বসে। লেকের উপরিভাগটি পাকা করা সিঁড়ি দিয়ে সাজানো অসংখ্য গাছ-গাছালি এলাকাটিকে সবুজ মনোরম করে তুলেছে। পুরো ধানমন্ডি লেক এলাকা জলরাশি এবং নৈসর্গিক সুন্দরে বেষ্টিত। দক্ষিণে রয়েছে ধানমন্ডি আট নম্বর ব্রিজ। তার পাশেই বিশাল চত্বর নিয়ে রবীন্দ্র সরোবর। সেখানে ছোট দোকানগুলোতে বৈকালিক চায়ের আড্ডা জমে ওঠে। রবীন্দ্র সরোবর থেকে ভেসে আসে : ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি/আকাশে বাতাসে উঠে রনি/বিশ্ব কবির সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ/জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ বাংলাদেশ’।

ধানমন্ডি লেক এলাকাটি বেশ বিস্তীর্ণ। বত্রিশ নম্বর থেকে দক্ষিণে রবীন্দ্র সরোবর পেরিয়ে দূর আর দূরে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড হয়ে রাইফেল স্কয়ারের উত্তর পাশ দিয়ে ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়কের পাশ ঘেঁষে লেকের দুই পাশে হাঁটার রাস্তায় বৈকালিক জগিংয়ে ব্যস্ত থাকে অনেকেই। বত্রিশের সামনে লেকের ওপর দিয়ে পদচারি সেতুর ওপর চলে আসে মফিজ। সে পশ্চিমে তাকিয়ে লেকের ভিতর অবস্থিত ঝরনার পানির দৃশ্য দেখে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সূর্যের আলোক রশ্মি লেকের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে এর সোনালি আভা বিকিরণ করছে। পানির স্বচ্ছ ধারা মৃদু বাতাস হালকা ঢেউয়ের সৃষ্টি করে ছোট ছোট ঢেউয়ের খেলায় মেতে ওঠে। বত্রিশ নম্বরের সামনে লেকপাড়ে অনেক ছেলেমেয়ে বসে লেকের দৃশ্য অবলোকন করে।

পদচারি সেতু থেকে নেমে এসে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ এ মূল ফটকের দিকে এগিয়ে যায় মফিজ। সে স্মৃতি জাদুঘরে ঢোকার জন্য হাঁটতে থাকে। অনেক দূর পর্যন্ত ভিতরে চলে যায়। গার্ড অন্যত্র ব্যস্ত থাকার ফাঁকে স্মৃতি জাদুঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে মফিজ। কিছু পরে গার্ড বুঝতে পারে যে একটি লোক তার দৃষ্টির অগোচরে বিনা টিকিটে ভিতরে চলে গেছে। গার্ড সামনে এগিয়ে বলেন :

আপনার টিকিট?

-টিকিট নেই মফিজ বলল।

-তাহলে বাইরে আসুন

-আমি বাইরে যাব না।

-এখানে কী করবেন?

-জাতির জনকের ছবি দেখব, স্মৃতি দেখব।

-টিকিট?

-নেই বললাম তো।

গার্ড ও মফিজের কথোপকথন একটু উচ্চ স্বরেই হচ্ছিল। দর্শনার্থীদের মধ্যে পরিবেশগত সৌন্দর্যহানি হচ্ছিল বিধায় কর্তব্যরত পুলিশ মফিজকে ধরে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। মফিজ বাইরে যেতে না চাইলে তাকে জোরপূর্বক বাইরে নিয়ে আসে পুলিশ। একজন পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করে লোকটি কে? কী হয়েছে?

-টিকিট না করে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল।

-তাই নাকি?

-এই লোকটাকে আগেও দেখেছি-মনে হয় সন্দেহজনক লোক।

-স্যার লোকটা সবসময় এখানে ঘোরাঘুরি করে।

-তবে তো ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত।

-সেটা ভালো হবে। সন্দেহজনক লোক।

-চলুন ভাই আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হবে।

-যেমন?

-আপনি কি করেন, কোথা থেকে এসেছেন ইত্যাদি।

-কোথায় যাব? মফিজ বলল।

-পুলিশ ফাঁড়িতে যাবেন, এইতো সামনে।

-আমার তো ক্ষিধা পেয়েছে সামনের দোকান থেকে চা খেতে যাই।

-পালানোর চেষ্টা করছেন? লাভ নেই।

-পালাব না।

-পুলিশ ফাঁড়িতে চলুন, সেখানে চা খাওয়াব।

-চলুন।

ফুটপাতে হার্ডবোর্ডের কয়েকটা টুকরা দিয়ে একটি সাময়িক ঘরের বেড়া। উপরে টিনের পরিবর্তে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। ঘরের সামনের দিক খোলা। ঘরের পেছনের অংশে ‘সান্তুর’ রেস্টুরেন্ট, সামনে মিরপুর রোড ও পান্থপথের রাস্তা সোজা চলে গেছে কলাবাগান হয়ে নিউমার্কেটের দিকে। এ ভাঙা পুলিশ ফাঁড়ির উল্টোদিকে নিউ মডেল স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো পুলিশ ফাঁড়ি নয়। সাময়িকভাবে পাহারা দেওয়ার জন্য একটা বসার জায়গা মাত্র। এখানে থামুন। মফিজকে বলল পুলিশ অফিসার।

-পুলিশ ফাঁড়িতে যাবেন না? এখানে কেন?

-এটাই পুলিশ ফাঁড়ি। অফিসার পুনরায় বলল।

-কী বলেন এটা পুলিশ ফাঁড়ি?

-জি

-তাহলে আমি সামনের টংঘর থেকে একটু চা খেয়ে আসি-মফিজ বলল।

-আবার পালানোর চেষ্টা, আপনাকে না বলেছি ফাঁড়িতে চা খাওয়াব।

-ঠিক আছে দাঁড়ালাম-মফিজ বলল।

প্রায় উন্মুক্ত পুলিশ ফাঁড়িতে দুজন অফিসার বসে আছেন। চারটি প্লাস্টিকের হাতলবিহীন চেয়ার ও একটি কাঠের লম্বা টুল দৃষ্টিতে এলো মফিজের। সে জানে এটা ফাঁড়ি নয়। ডিউটিতে আসা পুলিশ সদস্যরা এখানে সাময়িকভাবে বসে ডিউটি শেষে চলে যায়। একটি চেয়ারে বসে পুলিশ অফিসার ইফতেখার বললেন : আমার নাম ইফতেখার হোসেন। আপনার নাম কি।

-আমার নাম মফিজ।

-নাম শুনেই অন্য দুজন পুলিশ অফিসার হেসে ওঠে। সেই হাসিতে শব্দ না হলেও দাঁত দেখল মফিজ। সে একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

-ইফতেখার বললেন : বসুন মফিজ সাহেব। এই যে খালি চেয়ার।

-বসব কিন্তু চা? এই বলে মফিজ চেয়ারে বসে।

-চা পাবেন কিছুক্ষণের মধ্যে।

-অফিসারদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করলেন উনি কে?

উনি ‘ফিফটি ফোর’। এ কথা কানে আসতেই মফিজ বুঝতে পারল ফিফটি ফোরের অর্থ।

ইফতেখার হাত ইশারা করতেই লেকের পাড়ের টংঘর থেকে একটি পিচ্চি ছেলে দৌড়ে এলো।

-চার কাপ চা ও একটি বনরুটি নিয়ে আস।

-বনরুটি কার জন্য, মফিজ বলল।

-আপনার জন্য ইফতেখার বলল।

-খুব ভালো করেছেন আমার খুব ক্ষিধা পেয়েছে।

-জানি।

-আপনি তো অনেক বুদ্ধিমান।

-কীভাবে বুঝলেন।

-বুঝি বুঝি। আপনি যেভাবে আমার পেটের ক্ষুধা বুঝেছেন...।

চায়ে ভিজিয়ে বনরুটি খেল মফিজ। ভেজা রুটিতে মফিজের চা শেষ। একজন পুলিশ অফিসার মফিজের দিকে তাকিয়ে বলল আমি চা খাব না। মফিজ বলল তাহলে আমি খাই?

-জি আপনি খেতে পারেন।

-দুই কাপ চা খেয়ে মফিজ তৃপ্ত হলো। তার ক্ষুধা কেটে গেছে।

মফিজের চা খাওয়া শেষে পুলিশ অফিসার ইফতেখার মুখ খুললেন। বলুন আপনার পরিচয় মফিজ সাহেব।

মফিজ খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে আমি এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবার নাম আবুল হাসেম। আমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে ফেনীর চিথলিয়া যুদ্ধে শহীদ হন। অপরদিকে আমার মামার বাড়ি জগতপুরে বসবাস করা অবস্থায় রাজাকারের হাতে নির্যাতিত হয়ে আমার মা মৃত্যুবরণ করেন। তখন আমি ছোট, বাবা-মা দুজনকে হারিয়ে অনেক দুঃখ-কষ্টের মাঝে বড় হয়েছি। বড় হয়ে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও তাঁর ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস জেনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসায় নিজেকে নিবেদিত করি। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যা আমাকে খুবই ব্যথিত করে, সেই দুঃখ নিয়ে এইখানে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে প্রতিদিন আমি আসি ও এখানে এলে দুঃখ ও শোকের মাঝে পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে। জনকের রক্তাক্ত ছবি দেখে নীরব কান্নায় এখানে ঘুরে বেড়াই। আপনি আমাকে ‘৫৪’ ধারায় সন্দেহ করেছেন। এখন আমার জেলে যেতে ইচ্ছা করে।

পুলিশ অফিসার ইফতেখার আবেগ ধরে রাখতে পারেন না। তিনি চেয়ার থেকে ওঠে মফিজের দুহাত ধরে বলেন, আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ‘মফিজ’ আপনাকে অভিবাদন। আপনি একজন দেশপ্রেমিক মানুষ ও বঙ্গবন্ধু-ভক্ত। চলুন সামনে যাই। ইফতেখার ও মফিজ দুজনে সামনে গিয়ে দেখে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের চোখে অশ্রুধারা। ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ থেকে বেরিয়ে আসে ওরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর