শুক্রবার, ২০ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

আরেকটি একুশের গল্প

বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

আরেকটি একুশের গল্প

ছন্দ মিলিয়ে নাম রাখাটা অনেক শিক্ষিত-অশিক্ষিত পরিবারে ঘটে। অনেক সময় নামের অর্থের চেয়ে ছন্দটাই বড় হয়ে ওঠে। যেমন আব্দুলের ভাইয়ের নাম শাব্দুল, খাদিজার বোনের নাম লাকিজা- ইত্যাদি। তেমন একটা নাম রাখা হয়েছে বরকতের ভাই হরকতের। নাম সৃষ্টিকারী এখানে নামের অর্থ একেবারেই অবজ্ঞা করেছেন-স্রেফ ছন্দ মেলানোতেই ছেলেটা হরকত হয়েছে। ছোটবেলায় ‘বরকত হরকত স্কুলে যাও’, ‘বরকত হরকত ভাত খেয়ে যাও’-বলতে-শুনতে ভালোলাগত। তখন নামের অর্থ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। বড় হতে হতে হরকত তার নামের মতোই জীবনটাকে উপলব্ধি করল। এখন অনেকেই বলে, ও তো হরকত পাবেই, ওর নামই তো হরকত।

আসল গল্পে আসা যাক। দুপায়ে মশা-কামড়ানো জ্বালা নিয়ে হরকত যেখানে দাঁড়িয়ে আছে- সেটা সবুজ ঘাস বিছানো ছোট্ট একটা চত্বর। দুচারটা খেজুর গাছ ছড়ানো। কুয়াশা সরে সবে রোদ বেরিয়েছে। খেজুর পাতার ফাঁক দিয়ে একফালি রোদ ওর পায়ের কাছে এসে পড়েছে। এই পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পাখির কাকলি ওর শ্রবণেন্দ্রিয়কে নাড়া দিল না। নাড়া দিল তখন- যখন মোবাইলের বাজখাই মেসেজ টোনে তিনটে হলুদ পাখি পটাত পটাত করে উড়ে গেল। অন্য সময় সে মেসেজ মোটে দেখেই না। কারণ, ভালো কোনো মেসেজ তার আসেই না। শুধু অপারেটর কোম্পানিগুলোর অফার। আপনার এক পয়সা পার সেকেন্ড কলরেটের সময় আজ শেষ হবে, নতুবা পাঁচ টাকায় এক জিবি ইন্টারনেট- ইত্যাদি। অবশ্য সে মেসেজগুলোর একটা সুবিধে আছে। মেসেজগুলো বাংলায় থাকে। কিন্তু আজ একটি ইংরেজি মেসেজের জন্য তার অপেক্ষা এবং এই জনশূন্য এলাকাতে আগমন।

পাটীগণিতে কাঁচা ছেলে যেমন না বুঝে খালি অঙ্ক পড়ে, তেমন ইংরেজি মেসেজে শুধু চোখ বোলায় সে। দৃষ্টি শুধু এক জায়গায় আটকে থাকে। সাতের পরে দুই শূন্য। এর আগের মেসেজটিতেও ঠিক তাই হয়েছিল। সেটা ছিল মূল মেসেজ। সেখানে পাঁচের পর পাঁচটি শূন্য ছিল। অর্থাৎ পাঁচ লাখ। তাও আবার ডলার। হরকত কোনো লটারিতে অংশ না নিয়েও পাঁচ লাখ ডলারের লটারি পেয়েছে। ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া এক বালকের কাছ থেকে প্রথম ইংরেজি মেসেজের যে আবছা আবছা মানে সে জেনেছে, তাতে এরকমই দাঁড়ায়। এখন কথামতো টাকা পরিশোধ প্রক্রিয়ার একটি মেসেজ এসেছে। কিন্তু ওই সাতের পর দুই শূন্যটাই সে বুঝতে পারে। প্রায় গোটা বিশেক কড়া কড়া ইংরেজি শব্দের মধ্যে ওই একটি জায়গায় তার খটকা লাগে। পাঁচ লাখ থেকে সাতশ- তবে কি টাকা কমে গেল? ইংরেজি না বুঝলেও মেসেজে একটা ব্যাংকের নাম লেখা আছে- সেটা বোঝা যায়। কে ইউ কু, কে ইউ কু করতে করতে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের নামটা আবিষ্কার করতে পারল না। মন খারাপ নিয়ে ভাবে- ভালো একজন ইংরেজি জানিয়ের কাছ থেকে মেসেজটি পড়ে নিতে হবে।

হরকতের বাবার দুই ব্যাটারির একটা রেডিও আছে। একের ভেতর এক এই যন্ত্রটির ব্যবসা ইদানীং লোকসান গুনছে। ব্যাকডেটেড নির্মাতারা তবু বাপ-দাদাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য দুই একটি যন্ত্র বানাচ্ছে। তাতে মার্কনির আত্মার শান্তির সঙ্গে- একশ্রেণির গ্রামীণ মানুষের সকাল-সন্ধ্যা অবসর কাটানোর সুযোগ হয়। চাইনিজ নির্মাতারা একের ভেতর পাঁচ- অর্থাৎ মোবাইলের ভেতর রেডিও, টিভি, টর্চ লাইট, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি ঢুকিয়ে এসব নির্মাতাদের প্রায় বাজারছাড়া করে ফেলেছে।

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। হরকতের বাবা বারান্দায় বসে খবর শুনছে। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণের অনুষ্ঠানে জ্ঞানী-গুণী মানুষের বক্তব্য প্রচার হচ্ছে খবরের মধ্যে। দেশের প্রধানমন্ত্রী বললেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করলেই ভাষা শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বললেন, আদালতের ভাষায় বাংলাকে এখনো সম্পূর্ণরূপে অন্তর্ভুক্ত না করতে পারায় আমি লজ্জিত, তবে চেষ্টা চলছে। উঠোন দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে রেডিওর এই কথাবার্তা শুনল হরকত। এসব কথাবার্তা হরকত প্রতি বছর শোনে। কিন্তু এবার বেশ মনে ধরে গেল। আসলে তো তাই। আজ বাংলায় এই মেসেজটি পেলে লোকের কাছে ছোটাছুটির বিড়ম্বনা থাকত না।

হরকত মনে মনে ফণী মোক্তারকে খুঁজে পেল। একমাত্র ফণী মোক্তারই ইংরেজির ভালো তরজমা করতে পারবে। তার ওপর সে থাকে আদালতে, গ্রামে বেশিক্ষণ থাকে না, কাজেই এ গ্রামের মানুষের পক্ষে তার কাছ থেকে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ারও সুযোগ কম।

ফণী মোক্তার বাইরের ঘরের বারান্দায় খাটে বসে আছে। হাতে একটা কাগজ। আর তার হাঁটুর কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে খালি গায়ের কতকগুলো লোক। কারও মাথায় গামছা, কারও পায়ে কাদা। ফণী মোক্তারের টালির চাল। লাউগাছে চাল ঢাকা। একটা সাদাটে ছোট লাউ সিঁড়ির চাল বেয়ে ঝুলছে। বারান্দায় উঠতে গিয়ে লাউয়ের সঙ্গে ছোট্ট একটা মস্তক-সংঘর্ষ ঘটল হরকতের। হরকত মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে দেখল, ফণী কাকা রোবটের মতো ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তাকে, মুখে বিরক্তিভাব। ফণী কাকা আবার কাগজটা পড়তে থাকে।

-কাকা

-পরে খোকা, দেখছ না উনি আমাদের কাজ করছেন। মাথায় গামছা জড়ানো লোকটা নাকমুখ সিটকে বলল।

লোকটার নিষেধের তোয়াক্কা না করে হরকত আবার ‘কাকা’ বলে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল। ফণী মোক্তার ‘হুসুপ’ করে ঠোঁট থেকে গড়িয়ে আসা লালা মুছে বলল, রিট পিটিশন মোতাবেক রায়টা স্থগিত করা হয়েছে।

-তাই নাকি! মাথা থেকে একটানে গামছা খুলে লোকটি বলল, তাহলে এই এনডিন আমরা বেচতে পারব?

-অবশ্যই পারবে।

লোকগুলো উঠে পড়ল। গামছা মাথায় লোকটা চটের ব্যাগ থেকে দুটো শুকনো নারিকেল বের করে বারান্দায় রাখল। ফণী মোক্তার বললেন, নারকেল কী হবে? বিশটা টাকা দে, ভ্যানভাড়া দিতে হবে। লোকটা আরেকটা কালো লোকের দিকে তাকাতেই সে গাঁটি থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের করল। ফণী মোক্তার খপ করে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে পুরল।

-নারকেল দুটো থাক কাকা, নাড়ু করে খাবেন। বলতে বলতে গামছা মাথার লোকটা অন্যদের সঙ্গে চলে গেল।

বারান্দা ফাঁকা হতেই হরকত মোবাইলটা ফণী মোক্তারের চোখের সামনে ধরে বলল, কাকা, এই মেসেজটা কোনো দেশ থেকে এসেছে?

ফণী কাকা ভুরুকুঁচকে একবার দেখেই অন্যদিকে ফিরে বলল, মহা চিটারের দেশ থেকে।

-ম..!

হরকত হাঁ করে মনে মনে ‘মহা চিটারের দেশ’ খুঁজতে লাগল।

-বোঝো না? ফিলিপিন! বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা মেরেছে, এখন তোমারও মারতে চায়।

হরকত খুশি হলো না। জিজ্ঞেস করল, এখানে কি কোনো ব্যাংকের নাম আছে?

- আছে, কুংশ্রী ব্যাংক। বলেই মুচকি হেসে ওঠে মোক্তার বাবু।

-কাকা, যদি বিস্তারিতটা বাংলা করে দিতেন!

- আমার অত সময় নেই, বাইরে যেতে হবে। মোক্তার বাবু ভালো করেই জানে, নারিকেল কিংবা টাকা- হরকত কিছুই দিতে পারবে না।

অগত্যা একলা পথে ফেরে হরকত। ফণী কাকার কথাগুলো ভালোলাগে না। কেউ লটারি পেলে মনে হয় ওনার গা জ্বলে। ইদানীং কিছু মানুষের স্বভাব বড্ড বিগড়ে গেছে! গত বছর এক ওষুধের দোকানদারও তাকে প্রায় কাহিল করেছিল। জ্বর হয়েছিল হরকতের। মোটে সারে না। ডাক্তার এক বড় প্রেসক্রিপশন দিয়েছিল- ইংরেজিতে। প্রেসক্রিপশনের বাম পাশে মার্জিনের বাইরে ইংরেজিতে কীসব লেখা। সে জানে- এখানে রোগের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লেখা থাকে। ডাক্তার ইংরেজিতে কী লিখেছে তা ওষুধের দোকানদারের কাছে জানতে চেয়েছিল। দোকানদার ছোকরা ইংরেজি B I P- এই দুটি অক্ষরকে টেনে বড় করে মানে করল ‘বায়োপসি’। বলল, অ্যাই! তোমার তো ক্যান্সারের লক্ষণ! ডাক্তার বায়োপসির কথা লিখেছে। এই না শুনে হরকতের জ্বর আরও বেড়ে গেল। সে তো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। পরে কে একজন দোকানদারের গালে চাঁটি মেরে বলল, B P মানে ব্লাডপ্রেসার। সেখান থেকে হরকতের মনে প্রশ্ন- কেন ডাক্তাররা বাংলায় অন্তত রোগের বর্ণনা লিখবে না?

যাই হোক, হরকত হাঁটতে হাঁটতে তিন রাস্তার মোড়ে এলো। গ্রাম শেষ হয়ে বিলের শুরু হয়েছে এখান থেকে। ধুলো রাস্তাটা শিরদাঁড়ার মতো ভাগ করে দিয়েছে বিলের পিঠটাকে। সেই রাস্তা দিয়েই বিলের পিঠে হাঁটে হরকত। বিলের শরীরের শিহরণ হয়ে বাতাস বয়। শিরশির খোঁচা হয়ে সে বাতাসে ভাসে একুশের সুর। দূর গ্রামের গহবর গেয়ে যায়- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি। তারই দুরস্ত সুর শব্দ লতার আদরে জড়িয়ে ফেলে অন্যমনস্ক হরকতের মনোযোগ। হঠাৎ হাওয়ায় দোলা ফুলের মতো তার অন্তকরণকে নুইয়ে দেয় ত্যাগ ও মহত্ত্বের পায়ে।

সে ভাবে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উৎস হিসেবে ফিলিপিনাদের বাংলাভাষায় আগ্রহ থাকতে পারে। আবার ভাবে, বিদেশিরা কেন বাংলাতে মেসেজ দেবে? বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত-যাতে সমস্ত ভিন ভাষার মেসেজ আপনা-আপনি বাংলায় রুপান্তরিত হবে। সে যা দুয়েকটি ইংলিশ জানে, তাই ব্যবহার করে ফিলিপিনে মেসেজ পাঠায়- নো ইংলিশ, রাইট বাংলা। ঘণ্টাখানেক পরে সত্যিই বাংলায় মেসেজ এলো। সত্যজিতের সেই গান- ভাষা এমন কথা বলে বোঝে যে সবাই- মেশিনও বাংলা শিখে গেল। গুগল ট্রান্সসেলেটে করা বাংলা পড়ে সে। যা বোঝে তাতে খটকা লাগে। ৫০০০০০ ডলার কুংশ্রী ব্যাংক থেকে তার নামে ট্রান্সফার হবে। এজন্য খরচ বাবদ আগেই ৭০০ ডলার দিতে হবে। কেন? ৭০০ ডলার কেটে রেখেই বাকি টাকাটা পাঠাও না! এত দিনের উন্মত্ত আনন্দের ওপর সংযমের ধামা চেপে আনন্দ পায়। সিদ্ধান্ত নেয় চালাকিতে যাবে না।

আবার বাজখাই টোনে একটি মেসেজ আসে। এবার গুগল থেকে এসেছে মেসেজটা। ইংরেজিতে মেসেজ, কিন্তু লেখার আগে ত্রিভুজের মতো ছবি, তার ভেতরে লাল বিস্ময়সূচক চিহ্ন। হরকত বুঝতে পারে না। বিল ছাড়িয়ে গ্রামে উঠেই দেখা হয় নঈমের সঙ্গে। সে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজ করে। তোবড়ানো গালে মোটা মোটা দুটো চোখ। পোড়া হাঁড়ি মাজার পরে যেমন কিছু কালচে দাগ থাকে-তেমনি কালচে-তামাটে মুখ। শীতেও তার জামার বুক খোলা, বড় মাদুলি ঝুলছে গলার হাড়ের ওপর। তাকে মেসেজটা দেখাতেই শুকনো খেজুর ডাটার মতো আঙুল দিয়ে মোবাইলটা ধরে সে মন্তব্য করে, আরে! এতে তো প্রচণ্ড ভাইরাস! শিগগির মোবাইল বন্ধ রাখুন! অন্তত একমাস মোবাইল খুলবেন না! হরকতভাবে ফিলিপিনারা শয়তানি করেছে।

হরকত মোবাইলের লাল বাটন চেপে ধরল। আর টিং টিং শব্দে টাটা জানিয়ে মোবাইল ঘুমের দেশে চলে গেল। এখানেই ঘটল বিপদ। হরকত নন-রিমুভেবল ব্যাটারির মোবাইল ব্যবহার করে না। তিন তিনবার ব্যাটারি পাল্টে শেষে নকল এক ব্যাটারি লাগিয়েছিল। একমাস চার্জবিহীন অচল থাকার কারণে ব্যাটারি ফুলে-ফেঁপে-গলে মোবাইলের বারোটা বাজিয়ে দিল। কী আর করা! মোবাইল সারানোর লোভে সেই নঈমের দোকানে যায় হরকত। রাস্তার পাশে এক সারিতে একচালা টিনের কয়েকটি পাকা দোকান। শুধু নঈমের দোকানই বন্ধ। হরকত বন্ধ দোকানের সামনে নঈমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। শরীর মনে ক্লান্তি। মোবাইলের গায়ে থাকা ব্যাটারির তরলে এক সময় মোবাইলটাই হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যায়।

হরকত আর দাঁড়াতে পারে না। একটু বসার জায়গা খোঁজে। দোকানের সামনের রাস্তার পরেই ইউপি পরিষদ চত্বর। চত্বরের এক কোনায় একটি শহিদ মিনার। সেখানে ছড়িয়ে থাকা ফুল-মালার অংশ, বিভিন্ন লেখার প্ল্যাকার্ড বিগত একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি বহন করছে। হতক্লান্ত হরকত শহিদ মিনারের ঠান্ডা সানের ওপর ধুলায় শুয়ে পড়ে। সান শুষে নেয় তার শরীরের উত্তাপ। সান একটু একটু করে গরম হয়- তাজা রক্তের মতো গরম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর