শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
গল্প

একজন মিস্ত্রি

ইকবাল খন্দকার

একজন মিস্ত্রি

ছুটিতে আছে কাশেম। ছুটির মেয়াদ আপাতত তিন দিন। তবে আরও দুই দিন বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কাশেম কারও অধীনে চাকরি করে না। তাই তার ছুটিও কারও মর্জির ওপর নির্ভরশীল নয়। নিজের ছুটি সে নিজেই দেয়। তবে কারণ ছাড়া দেয় না। যখন দেখে মোটা অংকের টাকা হাতে চলে এসেছে, কদিন কাজ না করলেও চলবে- কেবল তখনই দেয়। ততদিনের ছুটি দেয়, যতদিন না হাতের টাকাটা শেষ হয়।

কাশেম একজন মিস্ত্রি। তালার মিস্ত্রি। বাসার পাশেই তার ছোট্ট একটা দোকান আছে। মাসে ১ হাজার টাকা ভাড়া দেয়। তবে দোকানে তার বসা হয় খুব কম। অধিকাংশ সময়ই তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় বাইরে বাইরে। কী করবে! তার পেশাটাই যে এমন। যেখান থেকে ডাক আসে, সেখানেই যেতে হয়। আবার অনেক সময় ডাক না এলেও যায়। চাবির গোছায় ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ তুলে অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁক ছাড়ে।

কাশেম মোটা অংকের টাকা পায় বিশেষ সমস্যা সমাধানের পারিশ্রমিক হিসেবে। তিন দিন আগে সে বিশেষ একটা সমস্যার সমাধান করেছিল তার দোকান-সংলগ্ন মহল্লার প্রভাবশালী এক নেতার বাসায়। যার শিশুসন্তান আটকা পড়েছিল বেডরুমে। বাইরে থেকে কোনোভাবেই লক খোলা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, চাবি ছিল বেডরুমের আলমারিতে। বাইরে থেকে বারবার বাচ্চাটাকে বলা হচ্ছিল কীভাবে কী করলে দরজা খুলবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। বাচ্চাটা ভয়ে কেবল চিৎকার করছিল।

বাচ্চার সাথে পাল্লা দিয়ে বড়রাও যখন চিৎকার করে কাঁদছিল, তখনই বাসায় ঢোকে কাশেম। দরদাম না করেই লেগে যায় কাজে। সাফল্য পেতে ৫ মিনিটও লাগে না। এবার নেতার স্ত্রী জড়িয়ে ধরেন শিশুসন্তানকে, আর নেতা জড়িয়ে ধরেন কাশেমকে। তারপর তিনি ১০টি ১ হাজার টাকার নোট তুলে দেন কাশেমের হাতে। কাশেম ইতস্তত করতে থাকলে নেতা বলেন- এখন আমার মানিব্যাগে ১ লাখ টাকা থাকলে তোমাকে ১ লাখ টাকাই দিতাম।

নেতার দেওয়া বকশিশের জোরেই এখন ছুটি কাটাচ্ছে কাশেম। আজ সে ঢাকার বাইরে যাবে। নারায়ণগঞ্জে তার এক বন্ধু আছে, ওখানে এক দুই দিন থাকবে। ঐতিহাসিক কিছু স্থানে ঘুরে বেড়াবে।  নৌকা ভ্রমণেরও ইচ্ছা আছে। হাতে টাকা থাকলে মানুষের মনে কত ইচ্ছা জাগে! আসলে টাকার ক্ষমতা অদ্ভুত। যার মনে এমনিতে শখ-আহ্লাদের ছিটেফোঁটা নেই, তার মনেও শখের জোয়ার বইয়ে দেয়। শখে শখে কত লোক একাধিক বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলে!

কাশেম যখন বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বন্ধুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় শীতলক্ষ্যার পাড়ে। একথা ওকথা বলার পর বন্ধু বলে- একটা বিষয় আপনের সাথে শিয়ার করতে চাইছিলাম। তবে বিষয়টা আপনে ক্যামনে নিবেন, সেইটা নিয়া টেনশন করতাছি। আপনে সাহস দিলে বলতাম চাই। আর সাহস না দিলে পেটের কথা পেটেই হজম কইরা ফালামু।

বন্ধু মতিনের কথায় রহস্যের গন্ধ পায় কাশেম। তাই সে রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মতিন বলে- কিরা কাইট্টা কইতে পারি, আপনের মতো ‘এক্সপাট’ মিস্তিরি আমি জীবনে দেখি নাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হইল, আপনে আপনের ক্ষমতাডা কাজে লাগাইতাছেন না। আরে, আপনের চেয়ে কম এক্সপাট হইয়াও কতজনে কতকিছু কইরা ফেলছে! এই এলাকার জাহাঙ্গীর মিস্তিরির কথাই ধরেন। তলে তলে সে ম্যালা সম্পদ কইরা ফেলছে। ক্যামনে করছে জানেন? গফুর বাহিনীর সাথে কাজ কইরা। গফুর বাহিনী কিন্তু লুটপাট আজকা থেকে শুরু করে নাই। বছর বিশেক ধইরা করতাছে। বড় বড় মার্কেটের খুব কম দোকানই বাকি আছে, যেইটা থেকে তারা মালামাল লুট করে নাই। তবে যখন জাহাঙ্গীরের সাথে হাত করে নাই, তখন কাজটা করতে তাদের খুব পরিশ্রম হইতো। দোকানের শাটার ভাঙা, তালা ভাঙা কি কম পরিশ্রমের কাজ?

কাশেমের চেহারায় এবার পরিবর্তন আসে। আর তা লক্ষ্য করে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে মতিন বলে- ব্যাপারট্টা মনে হয় বুঝতে পারছেন। তার পরেও আরেকটু খুইলা বলি। গফুর বাহিনী লুটপাট করার লাইগা যেই দোকানটা টার্গেট করে, সেইটার কাছে জাহাঙ্গীররে একবার নিয়া যায়। জাহাঙ্গীর ভালো কইরা সেই দোকানের তালাটা দেখে। তার পরে বাড়িতে আইসা মাপমতো চাবি বানায়া ফেলে। গফুর বাহিনী তার কাছ থেকে চাবিটা নেয়, আর আরামসে দোকানের তালা খুইলা লুটপাট করে। জাহাঙ্গীরের সাথে তাদের চুক্তি হইলো, লুটের মাল বেইচ্যা যা টাকা পাইবো, সে পাইবো এর তিন ভাগের এক ভাগ।

এই পর্যন্ত বলে আচমকা কাশেমের হাত চেপে ধরে মতিন। বলে- আপনে যেই এলাকায় থাকেন, এই এলাকায় গফুর বাহিনীর মতো ম্যালা বাহিনী আছে। আবার অনেকের হয়তো বাহিনী নাই, একা একা চুরি-চামারি করে। কিন্তু সমস্যা হয় তালা খুলতে গিয়া। আপনে রাজি থাকলে আমি তাদের সাথে আপনেরে চুক্তি করায়া দিতে পারি। টেকায় লালে লাল হইতে সময় লাগবো না।

মতিনের অন্যায় প্রস্তাবের কড়া বিরোধিতা করতে চায় কাশেম। জানাতে চায় চরম অসন্তোষ। কিন্তু মতিন তাকে মুখ খুলতেই দেয় না। বরং একপ্রকার জোর খাটিয়ে রাজি করাতে চায় প্রস্তাবে। কাশেম রাজি হয় না। মতিন উপর্যুপরি অনুরোধ করে। পরদিন সন্ধ্যায়ই ঢাকা ফেরে কাশেম। এর পর দেখতে দেখতে চলে যায় দুই দিন। আড়াই দিনের মাথায় মতিন ফোন করে তাকে। বলে- কী সিদ্ধান্ত নিছেন, সেইটা জানার আগে একটা কথা বলি। আপনে হয়তো মনে করতেছেন বিষয়টা নিয়া আমি এত লাফালাফি করতাছি ক্যান। আমার কী স্বার্থ? আছে, স্বার্থ আছে।

কাশেম জানতে চায় স্বার্থটা কী। মতিন বলে- আপনে তো জানেন, আপনে যেই এলাকায় থাকেন, এই এলাকায় একসময় আমিও থাকতাম। তখন একটা দলের সাথে আমার খুব খাতির হইছিল। সেই খাতির এখনও আছে। তো দলের যে লিডার, সে ওইদিন কথায় কথায় বলতেছিল তার জানামতে নাকি বেশ কিছু দোকান আছে, গোডাউন আছে, যেইখানে প্রচুর মালামাল। তবে তালা ভাঙতে গেলে ধরা খাওয়ার ভয় আছে। আমার মাথায় তখন আপনের কথা আসলো। লগে লগে বইলা দিলাম।

কাশেম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানিয়ে দেয়, সে রাজি। মতিন সশব্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং বন্ধুকে ধন্যবাদ জানায়। তারপর তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বলে- দুনিয়ায় যারা রাতারাতি বড়লোক হইছে, তারা কোনো না কোনো ধান্ধা কইরা হইছে। আমরাও না হয় ছোটখাটো একটা ধান্ধা করলাম। এইটা বড় কোনো পাপ না।

এক বছর পর। কাশেম তার সেই ছোট ভাড়া দোকানটায় এখন আর বসে না। বসে মেইন রোডের পাশের বড় একটা দোকানে। দোকানটা ভাড়া না। তিন মাস হলো কিনেছে। কাছাকাছি এলাকায় আরেকটা দোকান কেনার কথা চলছে তার। হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যেই কেনা হয়ে যাবে। ওই দোকানটা সে ভাড়া দেবে। কাশেম সাধারণত রাত ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে। তবে আজ সোয়া ১১টা বেজে গেলেও এখন পর্যন্ত বন্ধ করেনি। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলছে। একপক্ষ কাশেম, অন্যপক্ষ সগির বাহিনীর প্রধান সগির আলী।

আলোচনার একপর্যায়ে সগির জানায় বড় একটা কাজের প্রস্তাব হাতে এসেছে। কাজটা করে দিতে পারলে বলা চলে টাকার বস্তা পাওয়া যাবে। সগির পাবে ১০ লাখ, কাশেমকে দেওয়া হবে ১ লাখ। কাশেম এলাকার নাম জানতে চায়। সগির বলে- তোমার দোকানের কাছেই। খুব যে কঠিন কাজ, তাও না। গত এক বছরে এর চেয়ে বহুত কঠিন কাজ তুমি করছো। শোনো, তালা খুলতে হইবো তিনটা। একটা মেইন গেইটের, একটা অফিসের দরজার, একটা আলমারির।

কাশেম জানতে চায় দারোয়ান আছে কি না। সগির এবার এগিয়ে বসে। তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে- নাইটগার্ড আছে। তবে তার ব্যবস্থা আমরা করমু। এইটা নিয়া তোমার টেনশন করতে হইবো না। আর শোনো, ব্যাপারটা কিন্তু ইশকুলের। যার সাথে আমার চুক্তি হইছে, সে একজন গার্জিয়ান। যেই ইশকুলের ব্যাপার, সেই ইশকুলে উনার পোলা পড়ে। গাধা ছাত্র। কিন্তু উনার খুব শখ, পোলার রোল নম্বর এক হইবো। এই জন্য উনি ঠিক করছে, ইশকুলের আলমারি থেকে প্রশ্ন বাইর কইরা আইনা পোলার হাতে দিবো। রোল নম্বর এক বানাইবো।

গলা শুকনো শুকনো লাগে কাশেমের। তাই সে ঢোক গিলতে থাকে। আর কথা চালিয়ে যায় সগির-   লোকটায় পয়লা যখন আমারে প্রস্তাব দিল, আমি রাজি হই নাই। কারণ, মাত্র ১ লাখ দিবো বলতেছিল। আমি তারে বইলা দিলাম, এত কম টেকায় এত বড় রিক্সের কাজ করমু না। ১০ লাখ দিতে পারলে আইসেন। পরের দিন সে আবার আইসা হাজির। কইল তার সাথে নাকি আরও কিছু গার্জিয়ান যোগ হইছে। তাদের একেকজনের বাচ্চা একেক ক্লাসে পড়ে। সবগুলা গাধা ছাত্র। কিন্তু তারাও চায় রোল নম্বর এক, দুই বা তিন হোক।

সগির আরও বলে, সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত সব ক্লাসের প্রশ্নই আনা হবে। তবে এক সেটের বেশি আনা হবে না। বেশি আনতে গেলে বান্ডেল দেখেই শিক্ষকরা টের পেয়ে যাবে যে, প্রশ্ন চুরি হয়েছে। তখন হয়তো এই প্রশ্ন বাতিল করে নতুন প্রশ্ন করতে পারে। কাশেম বলে- টেকা কম হইয়া গেছে। আপনের পাওয়া দরকার ছিল বিশ, আর আমার কমপক্ষে পাঁচ। এতগুলা গার্জিয়ান মিল্লা অপকর্মটা করতাছে, এতগুলা বলদা ছাত্র ভালা রিজাল্ট করবো, তাইলে টেকা ঢালতে সমস্যা কী?

সগির পকেট থেকে দামি সিগারেটের প্যাকেট বের করে। তারপর একটা সিগারেট খুলে বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে প্যাকেটটা আগের জায়গায় রাখতে রাখতে বলে- তুমি এক পাইলেও সেইটা পাঁচের সমান। কারণ, তোমার পোলায়ও এই ইশকুলেই পড়ে। এক ‘সেইট’ প্রশ্ন তার হাতে তুইলা দিতে পারলে সাংঘাতিক ঘটনা ঘইটা যাইবো কিন্তু। আরে মিয়া, তোমার পোলার রোল নম্বর যে একশোর পরে, এইটা আমি ভালো কইরাই জানি। এক, দুই, তিন না হোক, রোল নম্বরটা যদি দশের মইধ্যে চইলা আসে, বিরাট ব্যাপার না?

কাশেম কিছু বলে না। পরদিন সকালে ফোন করে সগির। জানায়, সময় কম। কাজটা আজকে রাতেই করতে হবে। আর এখন যেতে হবে স্কুলে। জায়গা এবং তালাগুলো দেখে আসার জন্য। কাশেম পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, কাজটা সে করবে না। সগির তাকে বোঝায়।  নগদ ১ লাখ টাকার লোভ তো দেখায়ই, প্রশ্নপত্র পেলে তার ছেলের রোল নম্বর সেই পেছন থেকে এগিয়ে কতটা সামনে আসবে, তাও আবার বলে।

কাশেম চুপ করে থাকে। সগির তাগাদা দেয়। নীরব থাকতে নিষেধ করে। এবার কাশেম ফোন কেটে দেয় এই বলে- আমি খারাপ হইলেও এত খারাপ হই নাই, বলদা ছাত্র-ছাত্রীগোরে প্রশ্ন আইনা দিয়া ভালা ছাত্র-ছাত্রীগোর কপাল পুড়মু।

 

রাত। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে আশপাশ। ধসে পড়ে কাশেমের পুরো দোকান। হাত-পা থেঁতলানো অবস্থায় তাকে বের করা হয় ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।  কেউ কেউ ধারণা করে, বিস্ফোরণটা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর