গল্প
মেয়েটির বয়স বেশি নয়। বারো-তেরো। অথবা চৌদ্দ। কালো। তবে দেখতে বেশ। হাল্কা পাতলা লম্বা। মসৃণ মায়াবী মুখ। অযত্নে ধূসর কালো চুল। বকশাদা দাঁত। কালো মানুষদের দাঁত আর চুল অকারণ সুন্দর হয়। কোনো মিল নেই, তবুও মেয়েটিকে দেখার পর আবিদের বারবার মনে পড়ছে ছোট
বোনের কথা। খুঁজে খুঁজে আবিদ কয়েকটি মিল বের করে। ওর বোন এবার নাইনে। বয়সের মিলটা চমৎকার। ওর বোন সাজতে খুব ভালোবাসে। বাবা কোনো নতুন কাপড় কিনলে আর মাফ নেই। না ধোয়া পর্যন্ত ওটা ওর দখলে। লুঙ্গি, শাড়ি, ব্লাউজ যাই হোক। কারও ভালো লাগুক আর মন্দ লাগুক ওর কিছু এসে যায় না। ছোট মেয়েরা শাড়ি পরলে আবিদের খুব ভালোলাগে। অতবড়ো কাপড়খানা যখন সামলাতে পারে না, তখন আবিদ খুব মজা পায়। শাড়ির সাথে যাদের পরিচয়, নেই ওদের জন্যে আবিদের কষ্ট হয়।
বড়রাস্তা থেকে গলির মতো ভেতরে ঢুকে যাওয়া পথের বাঁকে প্রেসে বসে গ্রুফ দেখতে দেখতে ভাবতে থাকে আবিদ- মেয়েটা শাড়ি-ব্লাউজ পরেছে। লাল লিপিস্টিক। লাল টিপ। হাসছিল। শাদা দাঁতগুলো আবছা অন্ধকারেও বেশ লাগছিল। কিন্তু আবিদের খুব খারাপ লাগে যখন সন্ধের পর বৃষ্টির রাতে রিকশায় বাবার বয়সি একটা মানুষের সাথে অমন হাসতে হাসতে রেলস্টেশনের দিকে কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? কেন? লোকটা বাবা-বড় ভাই হতে পারত। কিন্তু আবিদ দেখতে পেয়েছে- পথের বাঁকে চলে যেতে যেতে অন্ধকারে লোকটা ওকে রিকশার ভেতরই জড়িয়ে ধরেছে।
আবিদ মেয়েটাকে এর আগেও কয়েকবার দেখেছে। রাজশাহীর অসহ্য খরার দুপুর। মাথার মগজ গলে যাওয়া রোদ। লোকজনের অনাগরিক ঝাঁঝালো মেজাজ। ছুটি হওয়া গার্লস স্কুলের পাশ ঘেঁষে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসছিল আবিদ। প্রেস থেকে হলে আসবে। সাহেব বাজার মোড়ে মেয়েটা বয়স্কা
একজন মহিলার সাথে। মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে এমন বেশভূষা। বয়স্কা মহিলাটির উৎকট উগ্র সাজ-সজ্জা। দুজনে জড়াজড়ি ঢলাঢলি করে হেঁটে যাচ্ছে। পিচ গলা রোদেও খালি পা। নির্বিকার। মহিলা মেয়েটার মা-খালা কেউ হতে পারে- এমন মনে হয়নি আবিদের।
দুই.
দুপুর থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। কমছে। থামছে। আবার জোরে। এই-ই চলছে গতি এখনো। আবিদের ছাপার কাজ অনেক বাকি। রাত বারোটা বেজে যেতে পারে। কাল ঝামেলা আছে। তাই কাজ বাকি রাখা যাবে না। গুমোট গরম মেশিনঘরটা থেকে রাস্তায় আসে আবিদ। দেখতে থাকে স্রোতের মতো চলে যাওয়া রিকশা। সাইকেল। গাড়ি। মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেপরোয়া লাইব্রেরি ট্রিপ বাস। রাস্তার ওপারে দোকানপাট। দোতলা বিল্ডিং। খুলে রাখা একটি জানালা। পড়তে বসা একটি মেয়ে। নোবেল। আবিদ প্রথম যেদিন এ প্রেসে কাজ শুরু করে একটি মজার ঘটনা ঘটে সেদিনই। দোতলার ছাদের ওপর দুটি মেয়ে। বিকেলে আবিদকে নিয়ে দুজন বেশ মজা করছে। একটি মেয়ে আবিদের ভঙ্গি নকল করছে। আবিদ মাথায় হাত রাখলে সেও তাই করছে। যেভাবে দাঁড়াচ্ছে আবিদ, সেভাবে সেও। এটা করে দুজনে মজা পাচ্ছে খুব। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে এ ওর গায়। আবিদের বয়সি প্রেস মালিকের ছোট ভাইটি ব্যাপারটা বুঝতে পারলে আবিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বললো,
-ওদের চেনেন নাকি?
-নাহ! কেন?
লাইট পোস্টের দিকে দাঁড়ানো মেয়েটির নাম নোবেল। নিচের মোড়ে যে দোকানগুলো দেখছেন সব ওদের। ঐযে নোবেল এন্টারপ্রাইজ দেখছেন, ওটাতে ওর বড় ভাই বসে। নোবেল মহিলা কলেজে পড়ত। মনে রাখার মতো সুন্দরী ছিল। ডজনকে ডজন ছেলের সাথে প্রেম করে পুরাকীর্তির মতো হয়ে গেছে এখন। একদম বুড়ি।
আবিদ এবার নোবেলকে দেখতে চাইলে দেখলো মধ্যবয়সি একজন মানুষ। হয়তো নোবেলের বাবা। খালি গায়ে ছাদের ওপর বসে আছেন চেয়ারে। নোবেল নেই। বিদ্যুতের তারে ঝুলে থাকা মৃতবাদুড়ের দিকে তাকিয়ে থাকল আবিদ। কে জানে কবে লেগেছে।
তিন.
টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছেই। তবে লোকটা নিয়মমাফিক হাজির। প্রথম প্রথম আবিদ বুঝতে পারেনি কিছুই। প্রতিদিন রাত সাতটা থেকে দশ-এগারোটা পর্যন্ত লোকটা রাস্তার মোড়ে পায়চারি করতে থাকে অন্ধকারে। টুপ করে এসে বিশা থামে সামনে। পিঁপড়ের মতো মুখে মুখে কথা হয় নিঃশব্দে। তারপর
দুজনে আরও অন্ধকারে ঢোকে। আড়ালে লুকোনো থাকে একটি বড় বোতল। একটি ছোট গ্লাস। বোতল থেকে তরল পদার্থ গ্লাসে ঢেলে দেয় লোকটা। আগন্তুক গলায় ঢেলে দিয়ে ঘাড়ের গামছায় মুখ মোছে। পকেট থেকে হাতে কিছু দিয়ে চলে যায়। লোকটা আবার পায়চারি করতে থাকে। যাত্রাদলের অভিনেতা মার্কা তেল চপচপে লম্বাচুলে বিলি কাটে। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে। ইতোমধ্যে আবার কাস্টমার এসে যায়। রিকশাওয়ালা। রিকশার প্যাসেঞ্জার। আশপাশের দোকানি। যুবক। মাঝবয়সি।
ব্যাপারটা পষ্ট জানবার জন্যে আবিদ একদিন লোকটার কাছে যেতে চাইলে লোকটা দূরত্ব বজায় রেখে দূরে চলে যেতে থাকে। তাহলে কী যারা আসে সবাই তার পরিচিত? আবিদ অবাক হয়। এও এক পেশা বটে।
তরল বেচা লোকটাকে দেখে রিকশার ভেতর ছোট মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরা লোকটার কোথায় যেন মিল খুঁজে পায় আবিদ। মেয়েটাকে মনে পড়ে। ওর বোনটার মতোই। আবিদের কষ্ট বাড়তে থাকে।
চার.
এগারোটা বাজতে বৃষ্টি থেমে গেছে। আবিদের ছাপার কাজ শেষ হতে বারোটা। এতো রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো শহরের রিকশা যাবে না। এ সময় একটা ট্রেন বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন হয়ে যায়। আবিদ তাড়াতাড়ি স্টেশনে পৌঁছে দেখে সেই ট্রেন চলে গেছে।
মেঘলা আকাশ। অন্ধকার। দুপুর থেকে কয়েক দফা বৃষ্টি। পথে থক থকে কাদা। নির্জনতা। আবিদকে একা যেতে হবে। স্থানীয় লোকজনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রদের সম্পর্ক ভালো না। বড় একটা মারামারি কদিন আগেই হয়ে গেছে। আবিদের ভয় করে। একা যেতে হবে।
আবিদ হাঁটতে শুরু করে। প্ল্যাটফর্মের আলো থেকে অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। হঠাৎ স্টেশন পেরোবার আগেই চমকে ওঠে আবিদ। থমকে থেমে যায়। গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। ট্রেনের বগির আড়ালে মেয়ে মানুষের চাপা শীৎকার! কঁকিয়ে কাঁদছে...! হিস হিস করছে পুরুষ কণ্ঠ...।
আবিদের অনুভূতিতে বিদ্যুৎ খেলে যায়। বিকট শব্দে বজ্রপাত হয় পাশেই কোথাও। বিজলির জ্যোতি আবিদকে অন্ধ করতে এসে পষ্ট দেখিয়ে যায়, একদল বুনো কুকুর একটা জীবিত প্রাণীকে নখ-দণ্ডে ছিঁড়ে খাচ্ছে। নগ্নতা ঢাকবার কারও কোনো সুন্দর মুখোশ নেই।