শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাঙালি জাতির ‘মুকুট মণি’

মাহবুব-উল আলম হানিফ

বাঙালি জাতির ‘মুকুট মণি’

উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শেখ হাসিনা। একজন সংগ্রামী রাজনৈতিক নেত্রী, একজন সাহসী যোদ্ধা, বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তির আলোকবর্তিকা, একজন মমতাময়ী মানবিক নেত্রীর নাম শেখ হাসিনা।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গর্বিত সন্তান। বঞ্চিত বাঙালির একমাত্র আশ্রয়স্থল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সর্বজনমান্য নেত্রীর জন্মদিন আজ। বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনের ৭৪টি ঝড়ো বসন্ত পেরিয়ে আজ ৭৫-এ পা দিলেন তিনি।

ছাত্রজীবনেই পিতার মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেই রাজনীতির দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরশাসনে বঙ্গবন্ধুকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। মায়ের সঙ্গে জেলখানায় পিতাকে দেখতে যেতে যেতে এক কঠিন সংগ্রামী ও দৃঢ়চেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

১৯৭৫-এ কলঙ্কজনক আগস্ট হত্যাকান্ডের সময় ঘটনাক্রমে দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ১৫ আগস্টের অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও দুঃসহ যন্ত্রণা ও কষ্ট নিয়ে গত চারটি দশক তাঁকে ‘জীবন জয়ের’ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক জিয়া ক্ষমতা দখল করে ইনডেমনিটি আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ বন্ধ করার পাশাপাশি খুনিদের পুরস্কৃত করেছিল। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, হত্যার পাশাপাশি দলকে ভেঙে খন্ড-বিখন্ড করেছিল। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের নিয়ে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা পদদলিত করে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল।

দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্যে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দলের দায়িত্বভার গ্রহণের পরই তাঁর ৪১ বছরের ক্লান্তিহীন পথযাত্রা। এ যাত্রাপথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ৪১ বছরে কমপক্ষে ২০ বার তাঁকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বাঁচলেও স্বৈরাচারী শাসকদের জেল-জুলুম-অত্যাচারের হাত থেকে তিনি রক্ষা পাননি। এরশাদের স্বৈরশাসনের আমল থেকে শুরু করে সর্বশেষ ১/১১ সরকার আমলে বেশ কয়েকবার তাঁকে কারাবরণ এবং দীর্ঘ কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়। মোকাবিলা করতে হয় অসংখ্য মিথ্যা মামলা ও হয়রানির।

কিন্তু কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। অশুভ শক্তির সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলা করেই তিনি লক্ষ্যের দিকে অবিচল পদক্ষেপে এগিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই এরশাদ স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবিমৃশ্যকারী কান্ডকারখানা থেকে তিনি বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করেন।

এই সময়ের মধ্যে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার পাশাপাশি জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু করে আইনের শাসন বন্ধ করেছিলেন তা থেকে জাতিকে মুক্ত করেন।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমহানির সঙ্গে যারা জড়িত সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের আত্মার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার পথ সুগম করেছেন।

দলীয় প্রধান হিসেবে এই দীর্ঘ সময় চলার পথে অনেক চড়াই-উৎরাই, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে আজকের এ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সফল নেতৃত্বের কারণেই আওয়ামী লীগ চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এই শাসন আমলেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে। তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। দরিদ্র দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন। ‘রূপকল্প-২০২১’-এর মাধ্যমে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশকে ‘রূপকল্প-২০৪১’-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

কেবল রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই তিনি অনন্য নন, তাঁর রয়েছে অসাধারণ মানবিক গুণাবলি। লাখ লাখ নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি স্নেহময়ী ভগ্নি-জায়া-জননী। বিলাস-বাহুল্যবর্জিত সাদাসিধে জীবনযাত্রা এবং পোশাক-আশাকে তাঁর অতুলনীয় বাঙালিয়ানা তাঁকে মাটির মানুষের, দুঃখী মানুষের প্রিয় নেতা হিসেবে অসামান্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে বসিয়েছে।

বর্ণাঢ্য সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি তাঁর ধীশক্তি এবং সৃজনশীল লেখালেখি তাঁকে রাজনীতিকদের মধ্যেও অনন্য আসনে বসিয়েছে। রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা যেমন, তেমনি লেখক-চিন্তক শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের ইতিহাসে নিজের জন্য শিখরস্পর্শী অক্ষয় আসন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রতি অধ্যায়ে, প্রতি পাতায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্ব উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং এর নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা বিশ্ব পরিমন্ডলে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। একটি পশ্চাৎপদ দেশকে উন্নয়নের কাতারে শামিল করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃত্বের মাঝে নিজের অবস্থানকে একটা অনন্য ধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন জোটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি অবশ্যই আর্থ-সামাজিক ও কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, যা অভ্যন্তরীণ অবস্থার উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষের ফল। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ও তার নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ আঞ্চলিক সহযোগিতা ও মৈত্রীর ক্ষেত্রে তাঁর দৃঢ় অবস্থান। তিনি নানা আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক জোট এবং সহযোগিতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ অব্যাহত রেখেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের বাইরে আঞ্চলিক পর্যায়ে নেতৃত্বের যে ভূমিকা রেখে চলেছেন তা তাঁকে বিশ্ব পরিমন্ডলে নেতৃত্বের আসন লাভে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘ, জি-সেভেনের মতো আসরে তাঁর বিশেষ মর্যাদা এ কারণেই। এসব কারণেই তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রণীত প্রভাবশালী নেতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হচ্ছেন।

বস্তুত, দারিদ্র্য হ্রাস, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ প্রভৃতি কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বপরিমন্ডলে স্বাতন্ত্র্য অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বোপরি লাখ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে বাংলাদেশে আশ্রয়দান এবং সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বমহলে প্রশংসিত হয়ে আসছে। নিজ দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যার মধ্যেও যেভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহানুভূতি প্রদর্শন করে আসছে, তাতে বিশ্ববাসী বিস্মিত হলেও শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা, সাহসী ভূমিকা এক অনন্য উচ্চমাত্রা এনে দিয়েছে।

শেখ হাসিনা নিজে যেমন স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য যা যা করণীয় সবই তিনি করছেন। বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার স্বদেশি চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তিনি এখন বিশ্বসভায় পৌঁছে গেছেন। জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং আর্থ-সামাজিক সূচকে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে সত্যিকারার্থেই উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশের। যে কারণে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। আর এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। শুধু বিশ্বাস নয়, এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্যও।

তাঁর এই সফলতা এবং বিচক্ষণতার জন্য বারবার আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ বরাবরই সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা জাতিসংঘের এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার অর্জন করেছে ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ক্রাউন জুয়েল’ বা ‘মুকুট মণি’ আখ্যায়িত করেছে আর্থ ইনস্টিটিউট, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, গ্লোবাল মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস এবং ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক।

২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন নিয়ে নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানানোর সময় ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেফ্রি স্যাক্স শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করে শেখ হাসিনাকে ‘ঔববিষ রহ ঃযব ঈৎড়হি’ (মুকুট মণি) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সত্যিকার অর্থেই শেখ হাসিনা আজ বাঙালি জাতির ‘মুকুট মণি’।

পিতার মতো বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও রাজনীতিকে গ্রহণ করেছেন সেবা ও ত্যাগের আদর্শ হিসেবে। তাঁর সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দৃঢ় নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সংগ্রাম, সাফল্য আর বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জীবন্ত কিংবদন্তি জননেত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোন।  বাঙালি জাতিকে আরও দীর্ঘদিন উন্নত, সমৃদ্ধ জীবন গড়ার কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিন, সুস্থ থাকুন-৭৫ বছরে পদার্পণের মাহেন্দ্রক্ষণে এটাই আমাদের প্রত্যাশা, জাতির প্রত্যাশা।

জয়তু শেখ হাসিনা, শুভ জন্মদিন।

লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর