যে ব্যক্তি আদালতের রায়ে নিজের দেশের ক্রিকেট থেকেই বিতাড়িত সেই ব্যক্তি ক্রিকেট বিশ্বের মাথা হয়ে থাকে কোন যুক্তিতে? তা টেস্ট খেলুড়ে দলগুলো কেনইবা মেনে নেয়! ক্রিকেট গৌরবের খেলা। তাই এর অভিভাবক সংস্থার প্রধানও হওয়া উচিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। কিন্তু শ্রীনিবাসন তো ঘরে-বাইরে বিতর্কিত এক ব্যক্তি।
শ্রীনি শুধু একা নন, ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত তার ফ্যামিলিও। তার জামাই মায়াপ্পন আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের দায়িত্বে থাকাকালে ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড-বিসিসিআই তো আদালতের সাহায্য নিয়ে সভাপতির পদ থেকে অপমান করেই বিদায় করেছে শ্রীনিবাসনকে!
বৈশ্বিক অন্যান্য ক্রীড়া ইভেন্ট যেখানে জনপ্রিয়তাকে বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেখানে স্বয়ং আইসিসি দিন দিন ক্রিকেটকে সঙ্কুুচিত করে ফেলছে! এবার ১৪ দলের বিশ্বকাপ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তীব্র লড়াই করেছে সহযোগী দেশগুলো। ক্রিকেটে এগিয়ে আসছে নতুন নতুন দেশ। তাই আইসিসির উচিত ছিল পরের বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করা। কিন্তু উল্টো পরের বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা কমিয়ে ১০-এ নামানোর চক্রান্ত এখন চূড়ান্ত! এটা সম্ভব হচ্ছে শ্রীনিবাসনের মতো লোক চেয়ারম্যানের পদে আছে বলেই! অথচ শচীন টেন্ডুলকারের মতো জীবন্ত কিংবদন্তিও ক্রিকেট বিশ্বকাপে আরও বেশি দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। যখন শচীনের মতো গ্রেট ক্রিকেটারের কথাও শেষ পর্যন্ত 'অরণ্যে রোদন' হয়ে যায়, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ গতিপথ!
একবার ভাবুন তো এই শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেটকে কি দিয়েছেন, আর শ্রীনি কী দিয়েছেন? শুধু একজন গ্রেট ক্রিকেটারই নন, শচীন হচ্ছেন আপদমস্তক একজন ক্রিকেটপ্রেমী। ক্রিকেটের উন্নয়নে কী করতে হবে তার চেয়ে আর কে ভালো জানবেন? শ্রীনি তো ক্রিকেটপ্রেমী নন, তার দরকার শুধু অর্থ ও ক্ষমতা। তাই ক্রিকেটের উন্নয়নকে তিনি বিচার করেন অর্থের মানদণ্ডে। শ্রীনিদের চক্রান্তের কারণে পরের আসর থেকে ১০ দেশের বিশ্বকাপ হলে আফগানিস্তান, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের মতো সহযোগী দেশগুলো কি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে না! স্পন্সররাও তো ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে!
আইসিসি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের সিদ্ধান্তগুলোও উদার হওয়ার কথা। ক্রিকেটবোদ্ধাদের দাবি, ধীরে ধীরে ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থাটি স্বতন্ত্রতা হারিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের প্লাটফরম হয়ে যাচ্ছে। কেন এক শ্রীনিবাসন এমন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবেন? তিনি যা বলবেন তা 'আইন' হয়ে যাবে!
ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে এবার নতুন চক্রান্তের আশ্রয় নিচ্ছেন শ্রীনিবাসন। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) কর্তৃত্বও হাতের মুঠোয় নিতে যাচ্ছেন তিনি। ভারতীয় পত্রিকা 'এবেলা'য় 'শ্রীনির আইসিসি এবার অকেজো করে দিতে চলেছে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলকেও' শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'মুস্তফা কামাল নিয়ে নাটকের মধ্যেই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের আইসিসি। ৩২ বছর ধরে চলতে থাকা এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলকে তারা অকেজো করে দিতে চলেছে।' প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আইসিসির উচ্চ কর্মকর্তাদের এই বৈঠকে এসিসির কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্তটা তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে তারা প্রতিবাদ করলেও শোনেনি শ্রীনিবাসন ও তার সহযোগীরা। এসিসির কারণে নাকি প্রতি বছর আইসিসির অনেক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তাই বাজেট ঘাটতি কমাতে এসিসির কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নেপথ্যে কারণ হচ্ছে, এসিসির প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন বাংলাদেশের সৈয়দ আশরাফুল হক। তাকে সরিয়ে দেওয়ায় এখন শ্রীনিবাসনের প্রধান কাজ!
দীর্ঘদিন নিরলস পরিশ্রম করে ডালমিয়ার সহযোগিতায় সৈয়দ আশরাফুল হক সংগঠনটিকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়েছেন। এশিয়া কাপের আয়োজন ছাড়াও এসিসির মাধ্যমে ক্রিকেটে পিছিয়ে থাকা এশিয়ার দেশগুলো আলোর মুখ দেখছিল। সেটি যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিশ্বকাপে দলের সংখ্যাও কমানো হয় তবে আফগানিস্তান, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেপালের মতো উদীয়মান ক্রিকেট দলগুলোর উন্নতি হবে কিভাবে? ব্যথার অজুুহাতে মাথাকেই তো কেটে ফেলা হচ্ছে!
ক্রিকেট এ কোন কলির কাল এসে উপস্থিত! আর আইসিসিকে দোষ দিয়ে কী লাভ? আইসিসিকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে যারা এর পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে তারাই আসল দায়ী।
মুস্তফা কামাল আইসিসির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ না করলে ক্রিকেট বিশ্ব জানতেই পারতো না ক্রিকেটের পবিত্র সংগঠন আইসিসির আড়ালে কী নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে এক চক্র। মুস্তফা কামাল পদত্যাগ করে প্রতিবাদের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছেন, এখন প্রয়োজন সেই পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। শ্রীনির ভিত কেঁপে উঠেছে। এখন অন্য দেশগুলোর উচিত এই সব বিতর্কিত লোককে বিতাড়িত করা। ক্রিকেটের স্বার্থে বাকি দেশগুলোকে এক হতে হবে। ক্রিকেটের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখনই নিতে হবে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তা না হলে ভবিষ্যতে শ্রীনির মতো বিতর্কিত লোকগুলোর থাবা আরও ভয়ঙ্কর হবে! তখন সামলানো কঠিন হয়ে যাবে! তবে এটা ঠিক, শ্রীনির সব চক্রান্ত বাস্তবায়ন হলে ক্ষতি ভারতেরও হবে। কেননা বিশ্ব জুড়ে এখন ভারতীয় ক্রিকেটের যে বাজার তাতে অনেক ধস নামবে!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্রিকেটপ্রেমীরা কিন্তু এই দুষ্টু চক্রকে ইতিমধ্যেই চিনে ফেলেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করাও শুরু করেছে। তা না হলে কেন, ২৯ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পুরস্কারদাতা হিসেবে শ্রীনিবাসনের নাম মাইকে বলার সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে স্টেডিয়াম গর্জে উঠেছিল, 'মানি না, মানি না'। সেদিন স্টেডিয়ামে তো বাংলাদেশি দর্শক ছিল না! অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক থাকলেও বেশির ভাগ দর্শক তো ভারতেরই ছিল। এখান থেকেই বোঝা যায়, যারা সত্যিকার অর্থে ক্রিকেটকে ভালোবাসে তারা কী ভারতীয় কী অস্ট্রেলীয়- কেউ-ই শ্রীনির এককাধিপত্যকে মেনে নেয়নি।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সংবিধান লঙ্ঘন করে শ্রীনি শুধু এক মুস্তফা কামাল কিংবা বাংলাদেশকে আঘাত করেনি, তার আঘাতটা হয়েছে ক্রিকেটের ওপর। এটা গোটা ক্রিকেট বিশ্বের লজ্জা। তাই ক্রিকেটকে রাহু মুক্ত করতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এখুনি। নয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। ক্যান্সার মরণব্যাধি হলেও নিরাময় যোগ্য যদি প্রাথমিক অবস্থায় টিউমারটিকে কেটে ফেলে দেওয়া হয়, নয়তো ঘা গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে তখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।