ভীষণ বিরক্ত পাকিস্তানি ফিল্ডাররা। তামিম ইকবাল বাঁ হাতি, মুশফিকুর রহিম ডান হাতি। দুই ব্যাটসম্যানের জন্য প্রতি বলেই জায়গা বদল করতে হচ্ছে ফিল্ডারদের। তবে ফিল্ডারদের চেয়ে কাল দুই বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের জ্বালাতন বেশি সহ্য করতে হয়েছে তো পাকিস্তানি বোলারদের! আজমল-জুনায়েদদের যেন পাড়ার বোলার বানিয়ে ফেলেছিলেন তামিম-মুশফিক। দুই ব্যাটসম্যানই তুলে নেন সেঞ্চুরি। চতুর্থ উইকেটে তাদের ১৭৮ রানের জুটি বাংলাদেশকে এনে দেয় ৩২৯ রানের রেকর্ড স্কোর।
আগে বাংলাদেশের দলীয় সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩২৬, সেটিও এই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই, গত বছর এশিয়া কাপে। কাল তামিম ও মুশফিক মিলে পার্টনারশিপে ১৭৮ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন। এটি শুধু তৃতীয় উইকেট জুটিতে নয়, ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান। এর আগে সর্বোচ্চ ছিল ১৭৫ রান। সেটা ফতুল্লায় কেনিয়ার বিপক্ষে। বাশার ও রাজিন সালেহ সেই রেকর্ড গড়েছিলেন। সেই সঙ্গে আরেকটি রেকর্ড হয়েছে কাল। প্রথমবারের মতো কোনো ওয়ানডেতে কোনো দলের বিরুদ্ধে জোড়া সেঞ্চুরি।
বিশ্বকাপে দল হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্য এবং ওপেনার তামিমের পারফরম্যান্স এককথায় ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয়, 'প্রদীপের পাদপীঠে অন্ধকার'। 'টিম বাংলাদেশ' অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে ছিল সাফল্যের প্রতীক হিসেবে। সেই দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও তামিম নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। নিউজিল্যান্ডের নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৯৫ রানের ইনিংসটা ছাড়া বলার মতো কোনো স্কোর করতে পারেননি তামিম। ড্যাসিং ওপেনার নিজের সর্বশেষ সেঞ্চুরিটাও পেয়েছিলেন বছর দুই আগে, ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। আর ঘরের মাঠে তামিমের সেঞ্চুরির কথা তো ভক্তরা ভুলেই গিয়েছিলেন। সেই ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করেছিলেন শতক। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অবশেষে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে 'তামিম' 'তামিম' গর্জন শোনা গেল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাসী এক সেঞ্চুরি।
একটা বড় ইনিংসের জন্য তামিম নিজেও যে কতটা ক্ষুধার্ত ছিলেন, সেটা বোঝা যায় সেঞ্চুরির পর তার উদযাপনের ভঙ্গি দেখে। সাঈদ আজমলের বল বাউন্ডারি রশি পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের ব্যাটটা ছুড়ে ফেলেন, হেলমেট-গ্লাভস খুলে দর্শদের উদ্দেশে দুই হাত দিয়ে ব্যতিক্রমী ভঙ্গি দেখান। এর আগে কোনো ক্রিকেটারকে সেঞ্চুরির পর এমন করতে দেখা যায়নি। প্রেসবক্সে থাকা মিডিয়া কর্মীরা নানাভাবে তামিমের উদযাপনের ব্যাখ্যা করলেন। কেউ বললেন, তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে, তাই এবার সবাইকে চুপ থাকতে বললেন। আর কেউ বললেন, এখন থেকে তিনি নিয়মিত রান করবেন, সেই ইঙ্গিত করলেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, কাল হাফ সেঞ্চুরি করতে তামিমকে খেলতে হয়েছিল ৭৫ বল। ছিল না কোনো ছক্কা! দেশসেরা ওপেনার রানে ফেরায় স্বস্তি ছিল বটে, কিন্তু স্ট্রাইক রেটটা তামিমের সঙ্গে মানানসই ছিল না। তাই ড্যাসিং ওপেনারকে অনুপ্রেরণা দিতেই কিনা গ্যালারির দর্শকরা 'তামিম' 'তামিম' বলে চিৎকার করতে থাকেন। পাকিস্তানি বোলার হারিস সোহেলের করা ২৮তম ওভারের পঞ্চম বল ডিপ মিড উইকেট দিয়ে তুলে মারেন তামিম। বল সরাসরি গিয়ে আঘাত হানে সীমানা রশির বাইরে থাকা বিজ্ঞাপনী বোর্ডে। পরের বল পাঠিয়ে দেন সোজা গ্যালারিতে। মারকুটে ব্যাটিং করে ১১২ বলেই ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরি তুলে নেন তামিম। এর মধ্যে আরও একটি বিশাল ছক্কা এসেছে তার ব্যাট থেকে। আউট হওয়ার আগে খেললেন ১৩২ রানের এক সৌরভ ছড়ানো ইনিংস।
তামিমের বিধ্বংসী হয়ে ওঠার দিনে চেনা রূপেই ছিলেন মুশফিকুর রহিম। বিশ্বকাপে যেমন বিশ্বসেরা বোলারদের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন কাল তুলোধুনা করলেন পাকিস্তানি বোলারদের। মুশি ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরিটা তুলে নেন মাত্র ৬৯ বলে। দুটি ছক্কার সঙ্গে ১৩ চার। বাংলাদেশের দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি এটি। এর আগে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ৬৮ বলে সেঞ্চুরি রয়েছে সাকিবের।
কাল সেঞ্চুরির পর ইনিংসটাকে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারেননি মুশফিক। ৭৭ বলে ১০৬ রানে আউট হয়ে যান। ততক্ষণে বাংলাদেশের স্কোরকে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে যাওয়ার পথটা দেখিয়ে দিয়েছেন। যদিও পাকিস্তানি ফিল্ডার জুনায়েদ খানের সৌজন্যে ৩৫ রানে একবার নতুন জীবন পেয়েছেন মুশফিক। সেটাও তো খেলারই অংশ। তবে কাল দাপুটে সেঞ্চুরি করে মুশি আবারও বুঝিয়ে দিলেন কেন তাকে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড বলা হয়।
সেঞ্চুরি করে তামিম ইকবাল কাল ছাড়িয়ে গেছেন বন্ধু সাকিবকে। তিনি এখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ১৪১ ম্যাচে তামিমের মোট রান ৪২৫৭। সাকিব ১৪৮ ম্যাচে করেছেন ৪২০৪ রান।