২০১৪ থেকে ২০১৫। ব্যবধান এক বছর। এই সময়টুকুতে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। পাল্টে দিয়েছে বিশ্বকাপ! এমনটা এখন বলাই যায়। ক্রিকেট মহাযজ্ঞে যে দুরন্ত ক্রিকেট খেলেছে টাইগাররা, কাল তার হাতেনাতে ফল মিলল মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে। দেখালেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা। পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলেছে বাংলাদেশ। খেলেছে বলেই ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে নিজেদের সর্বোচ্চ ইনিংস খেলল টাইগাররা। কাল তামিম ও মুশফিকের জোড়া সেঞ্চুরিতে স্কোর বোর্ডে লিখল ৬ উইকেটে ৩২৯ রান। অনেক রেকর্ডের এই স্কোর টাইগাররা গড়ল বিশ্বকাপের অদম্য মানসিকতাকে পুঁজি করে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের বাজে বছরগুলোর একটি ২০১৪। টানা হারের ধাক্কায় আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকেছিল। ক্রিকেটারদের দেখলে তখন মনে হতো সামান্য ঝড়েই ভেঙে পড়বে হুড়মুড় করে। হারতে হারতে লড়াইয়ের মানসিকতা হারিয়ে গিয়েছিল দূর নীলিমায়। মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিবদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, আইসিসি সহযোগী দেশ আফগানিস্তান, হংকংয়ের কাছেও হারের লজ্জা পেতে হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সাল ‘শুভ ভাগ্য’ বয়ে আনে। বদলে যায় দল। বদলে যান ক্রিকেটাররা। বিশ্বকাপ বদলে দেয় টাইগারদের। বদলে গেছে মাশরাফি বিন মর্তুজার হাত ধরে। মাশরাফির নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে বিশ্বকাপে। গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছিল। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেছিল শেষ পর্যন্ত লড়াই করে। বৃষ্টি নামতে দেয়নি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। বাকি ম্যাচগুলোতে অদম্য মাশরাফিদের রুখতেই পারেনি আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। আফগানিস্তানকে প্রথম ম্যাচে উড়িয়ে দেওয়ার পর নেলসনে রেকর্ড গড়ে টাইগাররা। স্কটল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ৩১৮ রান টপকে যায় আরামসে। অ্যাডিলেডে ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো জায়গা করে কোয়ার্টার ফাইনালে। কোয়ার্টারে ভারতের কাছে বড় ব্যবধানে হারলেও বিশ্বকাপ যে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে টাইগারদের, সেটা কাল বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তামিম, মুশফিকদের ব্যাটিংয়ে।
গত বছর এশিয়া কাপে এই মিরপুরেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩ উইকেটে ৩২৬ রান করেছিল বাংলাদেশ। এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল এটা। কাল ১৩ মাস পর পাকিস্তানের বিপক্ষে রেকর্ড বুকটাকে আরও উন্নত করল টাইগাররা। আরও উপরে টেনে নিল। কাল যে রেকর্ড করল, তাতে তামিম ও মুশফিকের অবদান শতভাগ। সেঞ্চুরি করেন দুজনেই। তামিম খেলেন ১৩২ রানের ইনিংস এবং মুশফিক ১০৬ রানের। তামিম সেঞ্চুরি করেন ২১ ম্যাচ পর। ২৫ মাস আগে হাম্বানটোটায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বশেষ সেঞ্চুরি করেছিলেন তামিম। তামিম ১১২ রান করার পরও হেরেছিল বাংলাদেশ। আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা মুশফিকও সেঞ্চুরি করেন প্রায় ১৪ মাস পর। এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন মুশফিক। তারপরও হেরেছিল বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপে রানে ফিরতে মরিয়া তামিম লড়াই করেছিলেন নিজের সঙ্গে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে রেকর্ড জয়ের ম্যাচে ৯৫ রান করলেও বাকিটা সময় ছিলেন ছায়া। সেঞ্চুরি করেছিলেন ২০১৩ সালের ২৩ মার্চ। সেঞ্চুরি না পেলেও ছিল চারটি হাফ সেঞ্চুরি। কিন্তু তার সঙ্গে মানায় বলেই সমালোচনার তীক্ষ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছিলেন ১৪২ ম্যাচে ৪২৫৭ রান করা বাঁ হাতি ওপেনার। তারপরও টিম ম্যানেজমেন্ট আস্থা রাখেন তার ওপর। কাল সেই আস্থার প্রতিদান দেন ১৩৫ বলে ১৩২ রানের নান্দনিক ইনিংস খেলে। অবশ্য ইনিংসটি ৪৭ রানে থেমে যেতে পারত। কিন্তু ডেব্যুডেন্ট সাদ নাসিম ফিরতি ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত পঞ্চম সেঞ্চুরি নিয়ে মাঠ ছাড়েন তামিম। তার ইনিংসটিতে ১৫টি বাউন্ডারি ছাড়াও ছিল ৩টি ওভার বাউন্ডারি। যার দুটি আবার টানা।
বিশ্বকাপে তামিম ব্যর্থ হলেও ধারাবাহিক ছিলেন মুশফিক। ৬ ম্যাচের তিনটিতে খেলেন ম্যাচ জয়ী ইনিংস। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৭১, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৬০ এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৯। কাল সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে খেলেন ৭৭ বলে ১০৬ রানের ঝড়ো ইনিংস। তবে নিশ্ছিদ্র ছিল না ইনিংসটি। ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান জুনায়েদ খানের হাতে। এর পরই ব্যাটকে খাপ খোলা তলোয়ার বানিয়ে পাকিস্তানি বোলিংকে চিড়ে-চিপ্টে ফেলেন। এতটাই আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিলেন যে, ৩০ ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ ২৬২ রান! অবিশ্বাস্য! বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ফিনিশিংয়ের আগে কখনোই দেখা যায়নি। এতটাই মেজাজি ব্যাটিং করেন টাইগাররা যে, ব্যাটিং পাওয়ার প্লের ৫ ওভারে ৪৭ রান এবং শেষ ১০ ওভারে ৯৩ রান সংগ্রহ করে টাইগাররা। তামিম ও মুশফিকের টর্নেডো ব্যাটিংয়ে সুর-তাল-লয় হারিয়ে ফেলেন সাত মাস পর খেলতে নামা সাঈদ আজমল। প্রথম ৫ ওভারে আজমল দিয়েছিলেন ১১ রান। শেষ ৫ ওভারে দেন ৬৩ রান! সব মিলিয়ে ১০ ওভারে ৭৪!
কালকের আগে সাতবার তিনশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেছে বাংলাদেশ। যার ছয়টিতেই জিতেছে। যে একবার হেরেছে, সেটি আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে গত এশিয়া কাপে। তাই ৩২৯ রান করার পরও শঙ্কা একটি থেকেই যাচ্ছিল কিন্তু এবার আর হার নয়। জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছে টাইগররা !