দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই তিনি তামিম ইকবাল! চাপদাড়িতে কেমন যেন অপরিচিত মনে হয় বাঁ হাতি ড্যাসিং ওপেনারকে। অথচ কিছুদিন আগেও ক্লিন শেভড তামিম যে কোনো মডেলের চেয়েও ছিলেন আকর্ষণীয়। হঠাৎ এই পরিবর্তনের কোনো কারণ খুঁজে পাননি কেউ। পরিবর্তনের কোনো কারণও বলেননি তামিম। অবয়বের মতো তামিমও যে বদলে গেছেন, বুঝা গেছে ব্যাটে সুর তোলা দেখে। রান করছেন ফাল্গুধারার মতো। রানের এমনই ধারাবাহিকতা, যা শুধু কল্পনার রংতুলিতেই অাঁকা সম্ভব। উইলোবাজিতে ২২ গজি উইকেটটাকে এমনভাবে শাসন করছেন, যেমন ক্রিকেটের রাজাধিরাজ তামিম!
টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫১ সেঞ্চুরি, ১৫৯২১ রান এবং ওয়ানডেতে ৪৯ সেঞ্চুরি এবং ১৮৪২৬ রান করেন জীবন্ত কিংবদন্তি শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। শত বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ক্রিকেটার এর আগে কখনো আসেননি। তারপরও ফর্মহীনতায় শুনতে হয়েছিল 'টেন্ডুলকারকে'। একইভাবে নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো কিংবদন্তির ক্রিকেটারকে। সমালোচকরা ভুলে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থানের অন্যতম কারিগর এ তিন ক্রিকেটার। তেমনি বাংলাদেশ আজ যে সাফল্য পাচ্ছে, তারও অন্যরকম কারিগর তামিম। অথচ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে যখন রান পাচ্ছিলেন না এই বাঁ হাতি ওপেনার, তখন অহর্নিশ শুনতে হয়েছে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান। কিন্তু পর্বতসমান দৃঢ়তায় সব সমালোচনাকে ছিটকে এখন সাফল্যের সুরকার তামিম। রচনা করছেন একের পর এক ইতিহাস। ব্যাটে এমন সুর তুলছেন, যার বন্দনায় আগামী কয়েক বছর মশগুল থাকবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।
বিশ্বকাপে পুরোপুরি ফ্লপ তামিম। শুধুমাত্র স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৫ রানের একটি নান্দনিক ইনিংস তাকে আলাদা পরিচয় দিয়েছিল। তাতেও থেমে ছিলেন না নিন্দুকেরা। সমালোচনার তীক্ষ্নবানে জর্জরিত করে জীবন অতীষ্ঠ করে তুলেছিলেন তামিমের। কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহেসহ টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থায় সামলে নেন সব প্রতিকূল অবস্থা। কোচ, টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থাকে সঙ্গী করে পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটকে খাপ খোলা তলোয়াড়ে পরিণত করে নিজেকে তুলে নেন অনন্য উচ্চতায়। মুখে কুলুপ এঁটে দেন সমালোচকদের। পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ওয়ানডেতে খেলেন ১৩২, ১১৬* ও ৬৪ রানের নান্দনিক ইনিংস। শাহরিয়ার নাফিস ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের পর তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টানা সেঞ্চুরি করেন তামিম। টানা সেঞ্চুরি করে ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও তিনি। ১৪৪ ম্যাচে রান ৪৪৩৭।
ওয়ানডের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন টেস্টেও। বিশ্বকাপে না পারলেও টেস্টে কিন্তু সফল ওপেনার। খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বরেকর্ড গড়ার আগের দুই টেস্টে টানা সেঞ্চুরি রয়েছে তামিমের। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে গত বছর চট্টগ্রামে ১০৯ ও খুলনায় ১০৯ রানের ইনিংস খেলেন। বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি টেস্ট ও ওয়ানডেতে টানা সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছেন। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে ১০৩ ও ম্যাঞ্চেস্টারে ১০৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন এই বাঁ হাতি ওপেনার। খুলনা টেস্টে বাঁ হাতি ওপেনার খেলতে নামেন ওয়ানডেতে টানা দুই সেঞ্চুরির আত্মবিশ্বাস নিয়ে। আত্মবিশ্বাসী প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেন স্বপ্নের এক ইনিংস। ইমরুল কায়েসকে নিয়ে উদ্বোধনী জুটিতে ৩১২ রান করে গড়েন বিশ্বরেকর্ড। লিখেন নতুন এক ইতিহাস। বাংলাদেশের ৮৯ টেস্ট ইতিহাসে ৩০০ রানের জুটি এই প্রথম। তিনি ও ইমরুল এমন চাপে জুটি গড়েন, যা টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল। ২৯৬ রানে পিছিয়ে থেকে দল যখন ইনিংস হারের শঙ্কায়, তখন ইমরুলকে নিয়ে যোগ করেন ৩১২ রান। ইমরুল ক্যারিয়ার সেরা ১৫০ রান করলেও ব্যর্থ হন ডাবল সেঞ্চুরি করতে। কিন্তু ব্যর্থ হননি তামিম। সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুশফিকুর রহিমের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করেন বাঁ হাতি ওপেনার। মুশফিক ২০১৩ সালে ২০০ রান করেছিলেন গলে। তামিম করলেন ঘরের মাঠে। ২০৬ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। ইনিংসটি খেলার পথে লিখেছেন বেশ কিছু রেকর্ড। ইমরুলকে নিয়ে ভেঙেছেন ৫৫ বছরের ইতিহাস। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কলিন কাউড্রে ও জিওফ পুলার করেছিলেন ২৯০ রান। পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে তামিম-ইমরুল এই প্রথম তিন শতাধিক রানের জুটি গড়েন। আগের রেকর্ড জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার-মারে গডউইনের, ২৭৭। তামিমের সেঞ্চুরিতে পঞ্চমবারের মতো ইনিংসে পাঁচ শতাধিক রান করে টাইগাররা এবং এ প্রথম দ্বিতীয় ইনিংসে। দ্বিতীয় ইনিংসে আগের সর্বোচ্চ ৪১৩, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। তামিমের ডাবল সেঞ্চুরির ম্যাচে বাংলাদেশ দুই ইনিংস মিলিয়ে রান করে ৮৮৭। আগের রেকর্ড ৮২২, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। শুধুমাত্র তামিমের ব্যাটিং সৌকর্য্যেই রেকর্ডের ভেন্যু হয়েছে খুলনা। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬ বছরের বন্ধত্ম্য ঘুচিয়ে ওয়ানডেতে জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। সর্বশেষ তার ডাবল সেঞ্চুরিতে অবশেষে ড্রয়ের স্বাদ নেয় টাইগাররা। যে ড্রয়ের প্রাপ্তি জয়ের চেয়েও বেশি।