টেবিলের বাঁ দিকের চেয়ারে বসে গৌতম গম্ভীর। ডান দিকের চেয়ারে বিরাট কোহলি। কোনও রকম ঝগড়া, বিবাদ নেই। কারণ, তারা এখন একই দলে। বাংলাদেশ সিরিজের আগে মুখোমুখি আলোচনায় বসলেন বিরাট ও গম্ভীর। দু’জনের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা হল। উঠে এলো ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয় থেকে শুরু করে আইপিএলে ঝগড়ার প্রসঙ্গও।
আলোচনার শুরুতেই টেবিলে রাখা একটি ল্যাপটপে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের টুকরো টুকরো দৃশ্য দেখছিলেন বিরাট ও গম্ভীর। বীরেন্দ্র শেহবাগ ও শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট পড়ার পরে দলকে সামলেছিলেন এই দু’জনই। ১৩ বছর আগেই সেই ছবিতে ডুব দিলেন তারা।
গম্ভীর তখন ভারতীয় দলের প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার। বিরাট সবে এসেছেন। সেই ম্যাচের দৃশ্য দেখতে দেখতে গম্ভীর বলেন, “আমার মাথায় খালি একটাই কথা ঘুরছিল। শেষ পর্যন্ত খেলতে হবে। আউট হলে চলবে না। অন্য কিছু ভাবছিলাম না। তবে তুমি সেই ম্যাচে খুব গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছিলে। তোমার ইনিংস আমাকে খুব সাহায্য করেছিল।” সে কথা শুনে বিরাট বলেন, “আমি যখন মাঠে যাই তখন মনে হচ্ছিল শ্মশানে ঢুকছি। গোটা গ্যালারি চুপ করে বসে। আমার মনে আছে তুমি এসে বলেছিলে, জুটি বাঁধতে হবে। সেই চেষ্টা করেছিলাম আমরা। একটা করে চার হচ্ছিল আর গ্যালারিতে শব্দ ফিরছিল। তোমার ওই ইনিংস আমি ভুলব না।” বিরাটের কথায় হেসে ফেলেন গম্ভীর।
ভারতীয় কোচ তুলে ধরেন বিরাটের ২০১৪-১৫ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা। সেই সফর বিরাটকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। অ্যাডিলেডে প্রথম টেস্টে ১১৫, মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্টে ১৬৯ ও ৫৪, সিডনিতে চতুর্থ টেস্টে ১৪৭ ও ৪৬ রান করেছিলেন বিরাট। সেই সিরিজের কথা মনে করিয়ে গম্ভীর বলেন, “আমার মনে আছে তোমার অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা। তুমি রানের পর রান করছিলে। তোমার মধ্যে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস দেখেছিলাম।”
এই প্রসঙ্গে নিজের নিউজিল্যান্ড সফরের কথাও টেনে এনেছেন গম্ভীর। নেপিয়ারে ১৩৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন গম্ভীর। নিয়েছিলেন ৪৩৬ বল। গম্ভীর বলেন, “নেপিয়ারে আমার ঠিক তোমার মতো ঘটনা ঘটেছিল। ওখানে আমি যে ভাবে খেলেছিলাম তা দ্বিতীয় বার কোনও দিন খেলিনি। ওই রকম মানসিকতার মধ্যে থাকার উপলব্ধি আমার আছে। তাই আমি বুঝতে পারি যে অস্ট্রেলিয়া সফরে তোমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল।”
খেলোয়াড় হিসাবে গম্ভীর ও বিরাট অনেকটা একই রকমের চরিত্র। আগ্রাসন তাঁদের স্বভাবে। তাই বার বার মাঠে প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছেন তারা। সেই প্রসঙ্গ টেনে আনেন বিরাট। তিনি গম্ভীরকে প্রশ্ন করেন, “যখন তুমি ব্যাট করতে তখন প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা হত। কখনও একটু উত্তেজিত ভঙ্গিতেও কথা হত। এতে তোমার উপর কী প্রভাব পড়ত? এতে কি তোমার মনঃসংযোগে সমস্যা হত? না কি জেদ বেড়ে যেত?”
গম্ভীর এই প্রশ্নের জবাব দেননি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন বিরাটকে। গম্ভীর বলেন, “আমার থেকে মাঠে তোমার ঝগড়া বেশি হয়েছে। তাই আমার মনে হয় তুমি এই প্রশ্নের জবাব ভাল দিতে পারবে।” বিরাট জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আসলে আমি এমন কাউকে চাইছিলাম, যে আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাক। আমি বলছি না মাঠে মেজাজ হারানো খারাপ। আসলে আমি চাইছিলাম যে কেউ বলুক, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক করেছ। মাঠে আগ্রাসন দেখানো উচিত।’”
গম্ভীর ও বিরাট মাঠে আগ্রাসন নিয়ে কথা বলবেন আর আইপিএলের কথা উঠবে না, তা কি হয়। ২০১৩ থেকে ২০২৩। দীর্ঘ ১০ বছরে বেশ কয়েক বার মাঠে সংঘাত হয়েছে তাঁদের। তবে ২০১৩ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক গম্ভীর ও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর অধিনায়ক বিরাটের মধ্যে যে বিবাদ হয়েছিল তা সকলের মনে রয়েছে। মাঠের বাইরে বেরিয়ে জলের বোতল ও চেয়ারে লাথিও মেরেছিলেন গম্ভীর। পরে ২০২৩ সালে লখনউ সুপার জায়ান্টসের মেন্টর গম্ভীর ও আরসিবির ক্রিকেটার বিরাটের মধ্যেও বিবাদ হয়। খেলা শেষে দু’জনকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল বাকি ক্রিকেটারদের। সেই ঘটনা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি।
পরে অবশ্য দুই ক্রিকেটারই জানিয়েছেন, মাঠে উত্তেজনায় কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে মনে কিছু পুষে রাখেননি। গত মরসুমে কেকেআরের মেন্টর গম্ভীরের সঙ্গে মাঠে হাসিমুখে গল্প করতে দেখা গিয়েছিল বিরাটকে। সেই কথা আরও এক বার মনে করিয়েছেন বিরাট। তিনি বলেন, “সেই ঘটনার পর অনেক দিন পেরিয়ে গিয়েছে। লোকে অনেক বাড়িয়ে বলেছিল। আমরা দু’জনেই তা ভুলে গিয়েছি।” গম্ভীরকেও বিরাটের কথায় সায় দিতে দেখা যায়।
ভারতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম প্রশ্ন ছিল, বিরাটের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন থাকবে। গম্ভীর শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তারা একই দলে রয়েছেন। তাদের লক্ষ্য একটাই, দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই একসঙ্গে কাজ করবেন তারা। কোনও বিবাদ তাদের নেই। বিরাটও সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন। আরও এক বার বিরাট ও গম্ভীরকে একই দিকে দেখা গেল। বৃহস্পতিবার থেকে ভারতের কোচ হিসাবে প্রথম টেস্টে নামবেন গম্ভীর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চেন্নাইয়ে খেলা। বিরাটও অনেক দিন পরে টেস্টে নামবেন। তার আগে দু’জন ফিরে গেলেন পুরনো দিনে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল