মোহাম্মদ রেজাউল করিম| চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তপুর থানার রহমপুর গাঁয়ে থাকেন তিনি| ছোটবেলায় ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হবেন| কিন্তু পারিবারিক দারিদ্রতার কারণে শিক্ষার নগন্য আলো দেখেছেন তিনি| তাই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন এক প্রকার নিভেই গেল| স্বল্প শিক্ষায় এ দেশের চাকরি করে বেঁচে থাকাটা এক প্রকার লড়াই বলা চলে| শিক্ষিত মানুষ যেখানে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে স্বল্প শিক্ষিত ব্যাক্তির স্বপ্ন দেখাটায় যেন ‘পানি থেকে তেল আলাদা’ করার তে কঠিন ব্যাপার| তাই বলে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না রেজাউল। বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিজেকে উচ্চতরে নিয়ে যেতে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি এডুকেশনাল ওয়াকফ (আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউ)-এর ভোকেশনাল ট্রেইনিং স্কলারশিপের আওতায় ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন ট্রেডে ছয় মাসের ফ্রি ট্রেনিং করে এখন তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন| এই ট্রেনিংয়ের পর জীবন যেন এক নিমিশেই বদলে গেল|
বদলে যাওয়া জীবন সম্পর্কে রেজাউল বলেন, ‘আমি আগে ভয় পেতাম যেম কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবো| কারণ, আমার তেমন কোনো লেখাপড়া ছিল না| আর এখন আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউতে ট্রেইনিং করে একটা কোম্পানিতে চাকরি করছি| এতে আমি সব মিলিয়ে ১৪ হাজার ৫শ' টাকা এবং অন্যান্য বেতন বাবদ প্রায় ২০ হাজার টাকা প্রতি মাসে আয় করছি| আমার সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে আমার হাতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা থাকে|’
শুধু রেজাউলই নয়, তার মতো শহীদুল, আতাউর, বশীরসহ আরও অনেকেই এই ট্রেইনিং নিয়ে স্বপ্ন বুননের কারিগর| এদের মধ্যে বশীর আহমেদ মালেশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রতিমাসে ৯৮ হাজার টাকা আয় করছেন|
আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউ ভোকেশনাল ট্রেইনিং স্কলারশিপ সম্পর্কে আইডিবি-বিআইএসইডাব্লিউর প্রোগ্রাম অফিসার জাহিদ-আল-মাহাদী বলেন, ‘আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউ ভোকেশনাল ফ্রি ট্রেনিং স্কলারশিপ ২০১২ সালে শুরু হয়| এখন পর্যন্ত এখানে ২৬০ জন বিভিন্ন ট্রেডে ট্রেনিং নিয়েছে এবং তারা সবাই দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন|’
একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রার্থী কীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে এবং কেমন টাকা আয় করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউ শুধু প্রশিক্ষণই দিচ্ছে না, পাশাপাশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের স্ব-স্ব দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে| এই লক্ষ্যে আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউর প্লেসমেন্ট সেল সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে| তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রার্থীরাই তাদের নিজেদের কর্ম অন্বেষণ করছে| আর বেতনের কথা বলতে গেলে আমাদের প্রার্থীরা বিদেশে কাজ করে প্রায় এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করছে|’
এই বিষয়ে ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন ট্রেডের প্রশিক্ষক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এখানে আমরা এমনভাবে প্রার্থীদের তৈরি করি যাতে বিশ্ববাজারে তারা প্রতিযোগিতা করতে পারে| দেশে-বিদেশে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রার্থীরা সবাই কর্মরত রয়েছে এবং তুলনামূলক ভালো টাকা আয় করছে|’
এই ট্রেনিংয়ে আবেদনের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণী পাস, এসএসসি/দাখিল পাস এবং সর্বোচ্চ ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবেন| তবে এইচএসসি, স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর পাস বা অধ্যায়নরত প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবেন না|’
এই ট্রেনিংয়ে কি কি ধরনের বা কোন কোন ট্রেডের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কলারশিপে আমরা ৪টি ট্রেডের উপর ৬ মাসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি| ট্রেডগুলো হলো- ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কস, ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ফেব্রিকেশন, ইলেকট্রনিক্স এবং রিফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং|
এই ট্রেনিংইয়ের আওতায় কি কি ধরনের সুবিধা প্রদান করা হয় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশিক্ষণার্থীদের চাকরি উপযোগী সিলেবাস অনুসরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে থাকি| আমাদের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে এই প্রোগ্রামের সার্বিক মান বজায় রাখা হয়| এ ছাড়াও সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মাত্র ৫০ টাকায় ফরম পূরণ করা ছাড়া প্রশিক্ষণার্থীকে আর কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না| আমরাই প্রশিক্ষণ চলাকালীন শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া যাবতীয় ব্যয় বহন করে থাকি| তদুপরি মাসিক ভাতা হিসেবে ৫০০ টাকা প্রদান করে থাকি|’
কীভাবে শিক্ষার্থীদের ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হয়, এই ব্যাপারে মাহাদী বলেন, ‘প্রথমে লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে মেধানুসারে প্রার্থী বাছাই করা হয়| লিখিত পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, ও গণিত বিষয়ে সাধারণ দক্ষতা যাচাই করা হয়| এরপর মৌখিক পরিক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়| প্রার্থীর ফলাফল মোবাইলে এসএমএস এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়|’
ছয় মাসের এই ভোকেশনাল ট্রেনিং প্রশিক্ষণে প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস করতে হবে এবং প্রশিক্ষণের সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা বেলা ১টা পর্যন্ত| এই ট্রেনিংএর জন্য প্রশিক্ষকদের কোথা থেকে এবং কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এই বিষয়ে তিনি জানান, ‘আমরা বেশিরভাগ প্রশিক্ষক পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে মাঠ পর্যায়ে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রশিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে থাকি| ফলে প্রশিক্ষণার্থীরা হাতে কলমে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে|’
স্বপ্ন পূরণে শিক্ষার অভাব কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না| কারিগরি শিক্ষাই আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে| আপনি চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করতে পারেন। ওয়েবসাইট :www.idb-bisew.org|
বিডি-প্রতিদিন/২৫ মে, ২০১৫/মাহবুব