ইলন মাস্কের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলে সক্রিয় সাইবার প্রতারণা চক্রের হাতে থাকা আড়াই হাজারেরও বেশি স্টারলিংক ডিভাইস বন্ধ করে দিয়েছে। থাইল্যান্ড সীমান্তঘেঁষা এসব এলাকায় আইনের শাসন কার্যত নেই বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো। আর এই সুযোগেই প্রতারকেরা গড়ে তুলেছে অসংখ্য স্ক্যাম সেন্টার।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, বুধবার স্পেসএক্স জানিয়েছে—মিয়ানমারের এসব স্ক্যাম নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে ২ হাজার ৫০০–এরও বেশি ডিভাইস নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। দেশটিতে গৃহযুদ্ধ ও আইনহীনতার সুযোগে প্রতারণা কেন্দ্রগুলো দিন দিন বেড়ে চলেছে, যদিও সীমান্তে অভিযান চালাচ্ছে আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ।
স্পেসএক্সের ব্যবসা পরিচালনা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট লরেন ড্রেয়ার এক্সে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, “যেসব দেশে স্টারলিংক পরিচালিত হয়, সেখানে নিয়ম ভঙ্গ শনাক্তে আমরা নিয়মিত কাজ করি। কোনো ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
তিনি আরও জানান, “মিয়ানমারে সন্দেহভাজন প্রতারণা কেন্দ্রগুলোর আশপাশে ২,৫০০–এরও বেশি স্টারলিংক কিট নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।” যদিও তিনি কখন এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা স্পষ্ট করেননি। এর মধ্যেই মিয়ানমারের সেনা সরকার জানিয়েছে, সম্প্রতি এক প্রতারণা কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে ৩০টি স্টারলিংক রিসিভার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ জব্দ করা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট জানায়, থাইল্যান্ড সীমান্তজুড়ে বর্তমানে অন্তত ৩০টি বিশাল স্ক্যাম সেন্টার কার্যকর রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এসব কেন্দ্রে কর্মীদের ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয় কিংবা পাচার করা হয়। পরে জোর করে প্রতারণার কাজে লাগানো হয়। সশস্ত্র প্রহরায় ঘেরা কম্পাউন্ডে আটকে রাখা বহু ব্যক্তি পরে জানিয়েছেন, সেখানে নিয়মিত মারধর ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করছে—মিয়ানমারের এই অপরাধচক্রগুলো স্টারলিংকের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে প্রতারণা চালাচ্ছে। স্পেসএক্সের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে স্টারলিংকের গ্রাহকসংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি। নিম্ন-কক্ষপথে হাজারো উপগ্রহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দূরবর্তী এলাকাগুলোতেও উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করছে।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রতারণা কেন্দ্রের ছাদে বিশাল আকারের স্টারলিংক রিসিভার বসানো হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের জয়েন্ট ইকোনমিক কমিটি স্টারলিংকের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর (ইউএনওডিসি) জানায়, বিশ্বজুড়ে প্রতারণা শিল্প এখন অভূতপূর্ব হারে বিস্তার লাভ করছে। অপরাধচক্রগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে অগাধ পরিমাণ অর্থ গোপনে স্থানান্তর করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখন ‘রোমান্স’ ও ‘বিনিয়োগ’ প্রতারণার কেন্দ্রবিন্দু, যা ‘পিগ বুচারিং’ নামে পরিচিত। দুর্নীতি ও সামরিক জান্তার আশ্রয়ে মিয়ানমার এই অপরাধচক্রগুলোর নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির সেনা সরকার এখনো পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে চলমান সংঘাতের মাঝেই এই অপরাধচক্রগুলো আরও শক্তিশালী হচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে থাইল্যান্ড সীমান্তের ওই অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিলে প্রতারণা কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। পরে প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক ও ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে নিজ দেশে ফেরত পাঠায় থাই কর্তৃপক্ষ।
মিয়ানমারের সামরিক সরকার জানিয়েছে, ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশটির প্রতারণা কেন্দ্রগুলো থেকে ৯ হাজার ৫৫১ জন বিদেশি নাগরিককে আটক করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশকেই ইতিমধ্যে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
সূত্র: সিএনএন, এএফপি
বিডি প্রতিদিন/আশিক