২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর কুইন্সল্যান্ডে টানা ছয় মাস বৃষ্টি নেমেছিল, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য করেছিল। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে কতটা বন্যা বা ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হবে তারা সেই আশঙ্কায় ছিলেন। এ নির্ঘুম রাত কাটানোর তালিকায় সাইবার সিকিউরিটির অধ্যাপক অ্যানড্রু ব্রাউনের নাম সম্ভবত সবার ওপরে থাকবে। তিনি অধ্যাপক হলেও শখের বশে একজন অপেশাদার আবহাওয়াবিদ হিসেবেও কাজ করেন। খুব কম মানুষই জানেন যে, জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ ‘ওয়ালিস ওয়েদার’-এর মূল ব্যক্তি। কুইন্সল্যান্ডের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের আবহাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া পেজটি বন্যার সময় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। যখন রেকর্ড-ব্রেকিং বন্যায় ৪০০ অধিবাসীকে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল তখন ব্রাউন ২৪ ঘণ্টা আবহাওয়ার আপডেট প্রকাশ করতেন, এমনকি রাত জেগেও তিনি তথ্য শেয়ার করতেন। একবার, যখন তার আবহাওয়া রাডারে ৫ ঘণ্টার টানা বৃষ্টির পূর্বাভাস দেখা গেল, তখন তিনি শুধু তার ফলোয়ারদেরই নয়, সহকর্মী, স্ত্রী ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদেরও কাজ থেকে দ্রুত ফিরে আসার পরামর্শ দেন। ব্রাউন বিশ্বাস করেন, ‘মানুষ জানতে চায় কী ঘটছে। বিদ্যুৎ চলে গেলেও ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, যার মাধ্যমে মানুষ চোখ ও কান খোলা রাখে।’ যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক খবর ও আবহাওয়ার আপডেটের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। রয়টার্স ইনস্টিটিউট এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা থেকে জানা যায়, মানুষ ফেসবুকের ইনফ্লুয়েন্সারদের সাংবাদিক ও মূলধারার গণমাধ্যমের মতোই গুরুত্ব দেয়, এমনকি ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে তাদের মূলধারার সমকক্ষদের চেয়েও বেশি মনোযোগ দেয়।
সরকারি সংস্থা বনাম ইনফ্লুয়েন্সার
কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ডিজিটাল মিডিয়া রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড্যানিয়েল অ্যাঙ্গাস নিজে ফেব্রুয়ারিতে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় আলফ্রেডের কারণে ব্যাপক বৃষ্টি ও বন্যার কবলে পড়েছিলেন। তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব মেটিওরোলজি থেকে সরকারি পরামর্শ অনুসরণ করেছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, তারাই এখনো সবচেয়ে নির্ভুল পূর্বাভাস ও সতর্কতা প্রদান করেন। তবে প্রফেসর অ্যাঙ্গাস আবহাওয়া ইনফ্লুয়েন্সার, যেমন ব্রাউনের ‘ওয়ালিস ওয়েদার’-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনের কারণও ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, এর কারণ কেবল মূলধারার গণমাধ্যম ও সরকারি উৎসগুলোর প্রতি মানুষের অবিশ্বাস প্রবণতা নয়, বরং কভারেজ ও প্রাসঙ্গিকতার ফাঁক পূরণ করাও বটে। অধ্যাপক অ্যাঙ্গাস বলেন, ‘আবহাওয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, বিশেষত গ্রামীণ ও আঞ্চলিক এলাকায়, কারণ তারা অত্যন্ত স্থানীয়, রিয়েল-টাইম আপডেট সরবরাহ করে, যা মূলধারার গণমাধ্যমগুলো প্রায়ই উপেক্ষা করে থাকে।’
বিতর্কের মূল কারণ
তবে আবহাওয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের বড় সমস্যা- ‘ভয় দেখানোর প্রবণতা’। অধ্যাপক অ্যাঙ্গাস টাউনসভিলের সোশ্যাল মিডিয়া আবহাওয়াবিদ ‘হিঁগিন্স স্টর্ম চেজিং’-এর সমালোচনা করেন। ২০১৮ সালে, তারা এক মিলিয়ন ফেসবুক ফলোয়ারকে ঐতিহাসিক বৃষ্টিপাত ও বন্যার পূর্বাভাস দিয়ে সমালোচিত হয়েছিল, যা বাস্তবে ঘটেনি। অধ্যাপক অ্যাঙ্গাস ব্যাখ্যা করেন, ‘আবহাওয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রায়ই অতিরঞ্জিত ও বাড়তি দাবি করেন; কারণ তাদের মূলধারা ও সরকারি সমকক্ষদের মতো একই মান বা পরিণতি দেখতে হয় না, যা ভয় দেখানো ও ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগের জন্ম দেয়।’ তার ভাষ্যমতে, ‘তাদের এর জন্য জবাবদিহি করতে হয় না, এ মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সাবেক টিভি আবহাওয়াবিদ অ্যালান সিলস। তিনি বিশ্বাস করেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মসহ প্রশিক্ষিত আবহাওয়াবিদরা খবরের মূল্য বোঝেন, কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তিরা পেশাকে অসম্মানিত করার ঝুঁকি তৈরি করে। সিলস বলেন, ‘এমনও লোক আছে যারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয় ও দীর্ঘ-পরিসরে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখানো এবং প্রচারের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁঁকি নেয়, যেন সেগুলো নির্ভুল। একে হাইপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা মানুষকে ক্লিক-শেয়ারে উৎসাহিত করে, এতে ইনফ্লুয়েন্সারের জনপ্রিয়তা বাড়ায়।’ অন্যদিকে প্রকৃত আবহাওয়াবিদরা এ ধরনের অতি উৎসাহ এড়িয়ে চলেন, কারণ এটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
পেশা নাকি শখ
কলরাডোভিত্তিক অ্যানড্রু মার্কোভিটজের আবহাওয়াবিদ্যার ডিগ্রি রয়েছে এবং তিনি একটি পাওয়ার সেভার কোম্পানিতে কাজ করেন। তবে তার টিকটক আবহাওয়া পেজে লক্ষাধিক ফলোয়ারও রয়েছে। লাইভ স্ট্রিম, স্পন্সরশিপ, ব্র্যান্ড ডিল এবং টিকটকের ক্রিয়েটিভিটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে মার্কোভিটজ মাসে হাজার হাজার ডলার উপার্জন করেন। তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্যই আমার চাকরি ছাড়ার জন্য যথেষ্ট নয়, আর আমি চাইও না। আমি একে মজার ছলে আয় হিসেবেই দেখি, যা আমি সাধারণত ভ্রমণে খরচ করি।’
তথ্যসূত্র : বিবিসি