চাকরির ভবিষ্যৎ
প্রযুক্তির অগ্রগতি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), কর্মক্ষেত্রে মানুষের কাজের ধরন বদলে দিচ্ছে, যা চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। যদিও অনেকে মনে করেন এআই মানুষের চাকরি পুরোপুরি কেড়ে নেবে না...
‘কম্পিউটার মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে’-এই ভয় অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান। তবে গত এক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যেভাবে কাজের ধরনকে পাল্টে দিয়েছে, তাতে এই আশঙ্কা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, এআই কি সত্যিই মানুষের চাকরি বিলীন করে দেবে? যদিও প্রযুক্তি খাতের ভিতরের মানুষজন এ বিষয় নিয়ে ভীষণভাবে দ্বিধাবিভক্ত।
চাকরির বাজারে এআই-এর প্রভাব
গেল ‘মে’ মাসে অ্যানথ্রপিকের সিইও দারিও আমোডি সতর্ক করে বলেছিলেন, আগামী এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এআই বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে হোয়াইট-কলার (অফিসভিত্তিক) চাকরিগুলোতে। এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। মেটা, মাইক্রোসফট এবং সেলসফোর্সের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে কোডিং ও অন্যান্য কাজে এআই ব্যবহার করছে। এমনকি অ্যামাজন, জেপি মরগান কোম্পানিগুলোর সিইওরাও সতর্ক করে বলেন, এআই তাদের মানবকর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমাবে। তবে এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে কিছুটা সংশয়ের চোখে দেখাও জরুরি। ‘এআই এতই শক্তিশালী যে এটি মানুষকে বেকার করে দেবে’-এমন বার্তাও হয়তো এআই বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর জন্য এক দারুণ বিপণন কৌশল। আবার, যারা কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা ভাবছেন, তাদের জন্য এটি একটি সুবিধাজনক অজুহাতও বটে।
কত দ্রুত বদলাবে কাজের ধরন?
এআই সত্যিই মানুষের জন্য হুমকি কি না, তার উত্তরও এতটা সহজ নয়। গত মাসে সিএনএন বেশ কয়েকজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, এআই কতটা এবং কত দ্রুত চাকরির বাজারকে প্রভাবিত করবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন, এনভিডিয়ার সিইও জেনসেন হুয়াং মনে করেন, এআই তখনই চাকরি বিলীন করবে যখন ‘পৃথিবীতে ধারণার অভাব হবে’। গুগলের ডিপমাইন্ডের সিইও ডেমিস হাসাবিস তো এআই-এর কারণে ‘চাকরির মহাপ্রলয়’ নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোই এ বছর হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করে। কারণ, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং অন্যান্য কাজের একটি বড় অংশ এখন এআই দিয়ে করানো হচ্ছে। তবে একটি বিষয়ে প্রায় সবাই একমত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজের প্রকৃতি বদলে দেবে।
এআই যুগে কাজের ভবিষ্যৎ
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ অনুযায়ী, অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান কর্মক্ষেত্রে এআইয়ের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। এক-তৃতীয়াংশ মনে করেন, এআই ভবিষ্যতে তাদের চাকরির সুযোগ কমিয়ে দেবে। তবে এআইয়ের কিছু ব্যর্থতা, যেমন : ইলন মাস্কের গ্রক চ্যাটবটের বিতর্কিত আচরণ বা এআই-জেনারেটেড বইয়ের তালিকা, মানুষের মনে রোবটনির্ভর কর্মক্ষেত্রের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি করে। রেসপনসিবল ইনোভেশন ল্যাবসের নির্বাহী পরিচালক গৌরাব বানসাল মনে করেন, কিছু চাকরির স্থানচ্যুতি হলেও নতুন ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি জটিল পুনর্গঠনের দিকে দেখছি, সরলভাবে মুছে ফেলার দিকে নয়।’ তার মতে, আমরা এখন ‘একদশক বা তার বেশি সময়ের অনিশ্চয়তার’ মধ্যে প্রবেশ করছি।
‘চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী এআইয়ের উত্থান
সিলিকন ভ্যালিতে অনেক দিন ধরেই এআইয়ের প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে, তন্মধ্যে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের মতো সমাধানের প্রস্তাবও ছিল, যা ওপেনএআই সিইও স্যাম অল্টম্যান সমর্থন করেন। তবে সম্প্রতি ‘এজেন্ট এআই’ টুলগুলো বাজারে আসার পর এই আলোচনা জনসম্মুখে আসে। চ্যাটবটের মতো সরল প্রশ্ন-উত্তরের বদলে, এজেন্টিক এআই সিস্টেমগুলো আরও জটিল ও বহু-ধাপের কাজ নিজে থেকে সম্পন্ন করতে পারে। যেমন : ব্যবহারকারীর ধারণা থেকে ওয়েবসাইট কোড করা বা কোনো বিষয়ে গবেষণা করে প্রেজেন্টেশন তৈরি করা। ওপেনএআই গত সপ্তাহে চ্যাটজিপিটির জন্য এমন একটি এজেন্ট মোড চালু করেছে, যা ব্যবহারকারীর হয়ে কাজ করতে পারে। অ্যামাজনের এআই ডেভেলপার এজেন্ট গত বছর ছয় মাসেই ৩০ হাজার সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন আপগ্রেড করে, যা মানুষের ৪,৫০০ ডেভেলপারের এক বছরের কাজ ছিল। মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা জানিয়েছেন, তাদের ২০-৩০ শতাংশ কোড এআই দিয়ে তৈরি হচ্ছে, আর মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ বলেছেন, আগামী বছর নাগাদ কোম্পানির প্রায় অর্ধেক কোড এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি হবে। শিল্পবিপ্লবের চেয়ে এআইকে কাজে যুক্ত করা এখন অনেক সহজ। সাবেক ওপেনএআই গবেষক স্টিভেন অ্যাডলার বলেন, ‘এআই কর্মীরা কেবল সফটওয়্যার, তাই ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন নেই।’
চাকরির বিলুপ্তি নাকি রূপান্তর?
যদিও কোডিং এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো কিছু কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হতে পারে, তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বেশির ভাগ চাকরি পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে না, বরং তাদের প্রকৃতি বদলে যাবে। কর্মীরা এআই ব্যবহার করে পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করবে, যা তাদের সৃজনশীল বা সম্পর্কীয় কাজগুলোতে বেশি সময় দিতে সাহায্য করবে। যেমন : একজন ডাক্তার এআই সহকারীর মাধ্যমে রোগীর তথ্য রেকর্ড করতে পারবেন, যা তাকে রোগীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য বেশি সময় দেবে। মেটার প্রধান এআই বিজ্ঞানী ইয়ান লেকুন বলেছেন, ‘বেশির ভাগ চাকরির বেশির ভাগ কাজ স্বয়ংক্রিয় করা যায় না।’ অনেক কোম্পানি ও সরকার এআই যুগের জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে বিনিয়োগ করছে। তবে স্টিভেন অ্যাডলারের মতে, এআই কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ালেও শ্রমের অতিরিক্ত জোগান তৈরি করে মজুরি কমিয়ে দিতে পারে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন