ফুটওভার ব্রিজ ঢেকে আছে ব্যানার পোস্টারে। ফুটওভার ব্রিজের নিচে ময়লার স্তূপ। সিঁড়িতে ধুলার স্তর জমে আছে, হাতলে ধুলা। ফুটওভার ব্রিজের ওপরে পলিথিন, বাদামের খোসা, পানির বোতল ছড়ানো-ছিটানো। প্রস্রাবের দুর্গন্ধে নাক চেপে পার হচ্ছেন মানুষ। এ অবস্থা রাজধানীর শুক্রাবাদ ফুটওভার ব্রিজের।
এই এলাকায় আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিপণিবিতান। গত শনিবার রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত একটি এলাকার ফুটওভার ব্রিজের চিত্র ছিল এটি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিরা ইয়াসমিন বলেন, ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতে হয়। ফুটওভার ব্রিজে অনেক সময় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। রাত বাড়লে বখাটেদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয় ফুটওভার ব্রিজ। তখন বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয়। শুধু এই ফুটওভার ব্রিজ নয় রাজধানীর বেশকিছু ফুটওভারব্রিজ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। অনেক জায়গাই চলে গেছে হকার আর ভাসমান মানুষের দখলে। তাদের ফাঁক গলে যাতায়াত করতে হয় মানুষকে। আবার অনেক জায়গায় ফুটওভার ব্রিজ পরিচ্ছন্ন থাকলেও মানুষ রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পার হয়। অনেকের এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের বাধ্য করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। অনেক জায়গায় ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়ে পার হতে হয় মানুষকে।
নীলক্ষেত থেকে সাইয়েন্সল্যাব পর্যন্ত তিনটি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। সাধারণত সেগুলো কেউ ব্যবহার করে না। কারণ, সেসব ফুটওভার ব্রিজ স্বাচ্ছন্দ্যে পারাপারের কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন পণ্যের হকাররা সেসব ফুটওভার ব্রিজ দখল করে দিনভর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। হকারদের সবচেয়ে বেশি উপদ্রব নিউমার্কেট ফুটওভার ব্রিজে। গতকাল দেখা যায়, ফুটওভার ব্রিজে ১২ জন হকার বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছেন। ফুটওভার ব্রিজে পলিথিন বিছিয়ে চুড়ি, ক্লিপ, ব্যাগ বিক্রি করছেন সিরাজ আলী। তার পাশে আরেকজন বিক্রি করছেন স্টিলের বিভিন্ন সামগ্রী। শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট কী নেই ফুটওভার ব্রিজের হকারদের কাছে। তাদের হাঁকডাকে পথচারীরা থেমে থেমে বিভিন্ন পণ্য কিনতে থামছেন। এতে জটলা তৈরি হচ্ছে ফুটওভার ব্রিজে। ধাক্কাধাক্কি করে পার হচ্ছেন অনেকে। মুখে মাস্ক নেই ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই। নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা রাইসা বেগম। চার বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে ফুটওভার ব্রিজ পার হতে বিপাকে পড়েন তিনি। রাইসা বেগম বলেন, নিউমার্কেটে কেনাকাটা সেরে এখন হকার্স মার্কেটে যাব শাড়ি কিনতে। মেয়েকে কোলে নিয়ে ব্যাগ হাতে এত উঁচুতে ফুটওভার ব্রিজে ওঠায় কঠিন। তার মধ্যে হকারদের দৌরাত্ম্যে হাঁটার মতো পরিস্থিতি নেই। এর মধ্যে টাকার ব্যাগ, মোবাইল খোয়া যাওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। পৃথিবীর উন্নত দেশে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচুর অর্থ খরচ করে ফুটওভার ব্রিজ বানানো হয়। তারও এ রকম বেহাল অবস্থা।
রাজধানীর ব্যস্ত বেশ কিছু জায়গায় উন্নয়ন কাজ করতে গিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। কারওয়ান বাজার রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক। মেট্রোরেলের কাজের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আন্ডারপাস এবং সরিয়ে ফেলা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। গোলচত্বরে চারদিক থেকে ছুটে আসা গাড়ির সামনে দিয়ে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন মানুষ। একই অবস্থা উত্তর বাড্ডা থেকে রামপুরা পর্যন্ত সড়কে। এই সড়কের লিংক রোড এলাকায় তিন দিক থেকে আসা গাড়ির মধ্যে দৌড়ে পার হতে দেখা যায় লোকজনকে। ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল হাতের ইশারায় থামিয়ে দল বেঁধে পার হচ্ছেন মানুষ। একই অবস্থা মেরুল বাড্ডা এলাকাতেও। রামপুরা ইউলুপ থেকে নেমে আসা গাড়ি এবং হাতিরঝিল থেকে আসা দ্রুত গতির গাড়ি ছুটে চলে বাড্ডার দিকে। আর বাড্ডা থেকে রামপুরা ব্রিজের দিকে গাড়ির গতিও বেশি থাকে। এর মধ্যে দুই দিকের গাড়িতে রাস্তা পার হতে যানজটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় মানুষকে। যানজটে গাড়ির গতি ধীর হলে রাস্তা পার হয় মানুষ। অনেকে দ্রুত গতির গাড়ির সামনে হাত উঁচিয়ে দৌড়ে পার হন। অনেক সময় ঘটে দুর্ঘটনা। প্রতিদিন রাস্তা পার হয়ে হাতিরঝিল গিয়ে চক্রাকার বাস ধরেন হালিম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমি ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পার হই না। গাড়ির সামনে দৌড়ে রাস্তা পার হতে ভীষণ ভয় পাই। কিন্তু না চাইলেও এই কাজটিই আমাকে প্রতিদিন করতে হয়। এই পুরো এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার জন্য কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সে দায় কে নেবে?
এ ব্যাপারে নগরবিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, রাস্তা পার হতে জেব্রাক্রসিং সবচেয়ে স্মার্ট পদ্ধতি। কিন্তু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় জেব্রাক্রসিং ব্যবহার না করে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করা হয়। বয়স্ক মানুষ, অসুস্থ ব্যক্তি, গর্ভবতী নারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা কঠিন। আবার অনেক ফুটওভার ব্রিজ নোংরা ও অরক্ষিত। এমনিতেই আমাদের দেশে মানুষের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হওয়ার প্রবণতা বেশি। তার মধ্যে যারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি তাদের অনুৎসাহিত করে।