মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

দূষণের রাজধানীতে মাস্কবিহীন মুখ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

দূষণের রাজধানীতে মাস্কবিহীন মুখ

শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালি, কালো ধোঁয়ার দূষণে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় মাস্ক ছাড়াই চলাচল করছে মানুষ। গুলিস্তানের ছবি : জয়ীতা রায়

তাপমাত্রার পারদ নামতেই প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ। বৃষ্টি না থাকায় ধুলায় ধূসর হয়ে উঠেছে রাজধানী। ধুলাবালুর সঙ্গে গাড়ির কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যেই মাস্ক ছাড়া চলাচল করছে মানুষ। ফলে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘পরিবেশ দূষণ রাজধানীবাসীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। বায়ু দূষণের ফলে শ্বাসতন্ত্রে এলার্জি, কাশি, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দীর্ঘমেয়াদে দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। দূষিত বাতাসে থাকা বস্তুকণা শ্বাসতন্ত্রের ভিতরে গিয়ে লিভার, কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। মাস্ক পরলে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটা কমবে।’

যেসব সড়কে উন্নয়ন কাজ চলছে সেখানকার অবস্থা আরও খারাপ। অনেকেই নতুন করে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন। রাজধানীর প্রবেশমুখ টঙ্গী, উত্তরা এলাকায় চলছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ, উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের এমআরটি-৬ প্রকল্পের কাজ চলছে। এ কারণে মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, বাংলামোটর, প্রেস ক্লাব, পল্টন, মতিঝিল এলাকা ধুলায় ধূসর অবস্থা। এ ছাড়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের কারণে কুড়িল, বনানী, তেজগাঁও ও এফডিসি এলাকার আকাশও প্রায় কুয়াশাচ্ছন্নভাব। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, তিতাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিসিএল নগরীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতেও খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। উন্নয়ন কাজের সময় যাতে ধুলার সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব থাকলেও খেয়াল নেই কারও। উন্নয়নের ধুলায় বাড়ছে দূষণ। বরাবরের মতো উপেক্ষিত থাকছে পরিবেশের বিষয়। সিটি করপোরেশনের পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব থাকলেও তা যেন দেখার কেউ নেই। এমন অবস্থায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানো এবং ধুলার উৎস নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব থাকলেও তা করা হচ্ছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ধুলা কমাতে পানি ছিটানোর ১৫টি গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি দিয়ে পানি ছিটানো শুরু করেছে বলে জানা গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর আটটি গাড়ি রয়েছে। বর্তমানে শুধু ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে নিয়মিত পানি ছিটানো হচ্ছে। আর কোনো সভা-সমাবেশ হলে সেখানে যদি বেশি ধুলার সৃষ্টি হয়, তখন সেসব এলাকায় পানি ছিটানো হয়।

বায়ুমন্ডলীয় বিজ্ঞান নিয়ে ২০ বছর ধরে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম। ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে তারা ঢাকা শহরের ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাতাসের মান নিয়ে গবেষণা করেন। বায়ুদূষণ শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা দেখাই ছিল গবেষণার মূল লক্ষ্য। সেখানে দেখা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়েও চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বাতাসে। গবেষকরা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯ থেকে ১০ বছর বয়সী ২৫০ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেন ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী কাশি, ৫ শতাংশ অ্যাজমা অথবা শ্বাসকষ্ট এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী মাথাব্যথায় ভুগছেন। ৫০-৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) ২০২০ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, অতিরিক্ত ধুলার কারণে জামাকাপড় পরিষ্কার, বাসাবাড়ি ধোয়া ও মোছার জন্য অতিরিক্ত পানি ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হয়। কাপড় ইস্ত্রি করতেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধুলা দূষণের কারণে মাসে অন্তত ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা বেশি খরচ করতে হয়। সড়কে জমে থাকা ধুলাবালি চলন্ত বাসের গতিতে ওপরে উঠে বাতাসে মিশছে। গ্যাস, পানি, স্যুয়ারেজ নানা কারণে সড়ক খনন করছে। মাটি সড়কের ওপর স্তূপ করে রাখার কারণে ধুলাবালির সৃষ্টি হচ্ছে। অবকাঠামোর নির্মাণসামগ্রী খোলা ট্রাকে পরিবহনের কারণেও বাতাসে ধুলা ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে কভিড-১৯ এর কারণে মানুষের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়েছে। এর আগে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু করোনা সংক্রমণ কমতেই উঠে গেছে মাস্কের ব্যবহার। ধুলার মধ্যে নাকে রুমাল চেপে কিংবা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে চলাচল করছে মানুষ। কিন্তু মাস্ক পরছে না।

সর্বশেষ খবর