বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী। পাঁচ দশক যাবৎ তিনি কবিতা লিখছেন। 'তবক দেওয়া পান' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তার আবির্ভাব। কবিতার সমান্তরালে শিশুসাহিত্য ও অনুবাদে সমান অবদান রেখেছেন তিনি, করেছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনা। কর্মসূত্রে সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা শেষে সুদীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বাংলা একাডেমিতে। শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় পারদর্শী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন -শেখ মেহেদী হাসান
আপনি জন্মেছিলেন বরিশালে। আপনার পূর্বপুরুষের বাড়ি বরিশালে। সেখানেই কী আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে?
আমার জন্ম বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থানার উলানিয়া গ্রামে। আমার বাবা আরিফ চৌধুরী অত্যন্ত ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। পরে তার তিন সন্তান ও স্ত্রী মারা যান। তারপর আব্বা তার বন্ধুর স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা বেগমকে বিয়ে করেন। তার বাড়ি শায়েস্তাবাদ। আমার নানা আমাদের গ্রামেই থাকতেন। নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি ছিল পুকুরের এপার আর ওপার। আমার শৈশবটা খুব আদরে কেটেছে। আমরা ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত উলানিয়ায় ছিলাম। মাঝে একবার জ্বর হওয়ায় চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাকে। কলকাতায় মাস দুয়েক ছিলাম। ক্লাস ওয়ান পাস করার পর ঢাকায় চলে আসি। সুতরাং স্মৃতিতে গ্রামের চেয়ে ঢাকার কথাই বেশি মনে পড়ে। ঢাকায় তখন বাসাভাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। সদরঘাটে নৌকা ভাড়া নিয়ে ছিলাম প্রায় একমাস। তারপর কলতাবাজারের একটি বাড়িতে উঠি। সেখান থেকে বাবু বাজারের আকমল খাঁ রোডে বাড়িতে চলে যাই। সে এক বিশাল অভিজ্ঞতা! ঢাকাকে আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠতে দেখেছি। কিন্তু গ্রামকে আমি ভুলতে পারিনি। উলানিয়ার সাত মাইল অদূরে পালকি চড়ে গিয়েছি। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমি ও সিডনি (অভিনেতা আলী আহসান সিডনি) গামছা দিয়ে নদীতে মাছ ধরেছি। নদী ভাঙনে বহু ঘরবাড়ি এখন বিলীন হয়ে গেছে। আমার শৈশব-কৈশোরের এত ঘটনা যে, বলে শেষ হবে না।
আপনার বাবা তো রাজনীতিবিদ ছিলেন?
যুক্তবঙ্গের শেষ এমএলএদের একজন ছিলেন আমার বাবা। তিনি ১৯৪২ পর্যন্ত কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। পরে নেহরুর এক বক্তৃতা শুনে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের ত্যাগী নেতাদের একজন। কিন্তু এক পর্যায়ে মুসলিম লীগের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্দজীবনী'তে দুবার আমার বাবার কথা স্মরণ করেছেন।
ছেলেবেলার পাঠ অভিজ্ঞতা কীভাবে আপনার লেখাকে ঋদ্ধ করেছে?
আমি তখন পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। রবীন্দ্রনাথের 'ছুটি' কবিতাটি পড়ে মনে গেঁথে যায়। সম্ভবত, মুক্ত জীবনের একটা স্বাদ পেয়েছিলাম কবিতাটি পড়ে। কারণ, এরপর আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে। আমি বইমুখী হয়ে পড়ি। বাড়িতে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল। ছেলেবেলায় সুকুমার রায়ের 'আবোল তাবোল', নজরুলের 'অগি্নবীণা' ও 'বিষের বাঁশী' পড়া হয়ে যায়। প্রথম বইটা বাড়িতেই ছিল। নজরুলের বই দুটি দিয়েছিলেন আমার বাবার এক কমিউনিস্ট বন্ধু। তিনি খবরের কাগজে মুড়ে দিয়েছিলেন; কারণ আমি ছিলাম মাদ্রাসার ছাত্র। সময়টাও ছিল উত্তাল। এরপর আরও অনেক বই হুড়মুড়িয়ে পড়ে ফেলি, সুকান্তের 'ছাড়পত্র', সুভাষের কবিতা। যদিও সেসব কবিতার মানে তখন সেভাবে বুঝিনি। তবে মনের ভিতর একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছিল।
আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন?
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আমার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক কাজী দীন মুহম্মদ, মুনীর চৌধুরী, মুহাম্মদ আবদুল হাই, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহীম, আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রমুখ। একেকজন ছিলেন দিকপাল। আমি ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লার বিভিন্ন বক্তৃতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। আকতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুল মান্নান সৈয়দ আমার সহপাঠী ছিলেন। ছাত্র জীবনেই আমরা অসাম্প্রদায়িক চিন্তা করতে শিখেছি। আমরা সাম্প্রদায়িকতা দেখেছি, গণতন্ত্র দেখেছি, বুট ও বেয়নেটের শাসনও দেখেছি। এভাবে শৈশব-কৈশোরের এক বহুমুখী ধারা আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
আপনি সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কাজ করেছেন বাংলা একাডেমিতে। সে অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।
আমরা যখন ঢাকায় চলে আসে তখন আমাদের জমিদারি চলে গেছে। পিতামহ খাসজমি অপছন্দ করতেন না বলে উলানিয়ার বড় হিস্যার, অর্থাৎ আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তখন আজাদ পত্রিকায় কাজ করেন। তিনিই মাসিক মোহাম্মদীর প্রুফ রিডার হিসেবে আমার চাকরির ব্যবস্থা করলেন। বেতন ষাট টাকা। আমি বোধহয় দুদিন প্রুফ দেখেছি, তিনিই আমার কাজ করে দিতেন, আমার কাজ ছিল বাড়ির গল্প করা, আর চা-পুরি এসব গেলা। এরপর জয়বাংলা পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এমএ পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার আগেই আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যোগ দেই। সেখানে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করি। আবার দৈনিক জনপদে সাংবাদিকতা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ আমি জার্মানিতে ডয়েসএভেলেতে কাজ করি। সবশেষ বাংলা একাডেমিতে যোগ দিই। কর্মজীবনে দারুণসব অভিজ্ঞতা আমার।
লেখালেখির প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন কীভাবে?
আসলে লেখালেখিতে আসা কোনো আগ্রহ থেকে নয়। আমাদের সময় বই ছিল বিনোদনের একটা মাধ্যম। আমাদের গ্রামের বাড়িতে রেডিও ছিল, আর ছিল বই ও পত্রপত্রিকা। যার ফলে পড়াশোনাটা হতো ছেলেবেলা থেকেই। ১৯৬০ সালের দিকে, আজাদ সুলতান নামে আমার এক মুরবি্ব ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, প্যাট্রিস লুমুম্বা মারা গেছে তুমি আমাকে কবিতা দাও। বরিশালে তার ইমদাদীয়া লাইব্রেরি ছিল। ওই দোকান থেকে আমি কবিতার বই কিনতাম। তিনি ভাবতেন, যেহেতু আমি কবিতার বই পড়ি, হয়তো আমি কবিতা লিখতে পারব। তখন প্যাট্রিস লুমুম্বাকে নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখি। এমন সময় এক ভদ্রলোক এলেন পাজামা, শার্ট আর চাদর গায়ে দেওয়া। তাকে কবিতাটা দিলেন। তিনি কবিতাটা পড়ে কোনো মন্তব্য না করে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে সুলতান সাহেব বললেন, উনি রণেশ দাশগুপ্ত। আমার বুক কেঁপে উঠল।
আমি ইতিমধ্যে তার লেখা পড়েছি। পর দিনই দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয় পাতায় কবিতাটি ছাপা হয়ে গেল। তারপর, কবিতার মান যাই হোক না কেন, আমি প্রচুর অভিনন্দন পেলাম। এমনকি জেলখানা থেকে কয়েকজন কমিউনিস্ট কর্মী আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থে লেখালেখি শুরু করেছি মুক্তিযুদ্ধের পর, বুড়ো বয়সে। আমি যখন দেখলাম কবি বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাকে নামে চেনেন। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম লেখালেখি করব।
আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তবক দেওয়া পান' বের হয় পঁচাত্তরে। বইটি বেশ প্রশংসিত হয়।
এটা আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতা থেকে নির্বাচিত কবিতার সংকলন 'তবক দেওয়া পান'। লেখাগুলো নির্বাচন করে দিয়েছিলেন কবি রফিক আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অরুণাভ সরকার ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। কাজেই খারাপ হওয়ার কথা ছিল না। খারাপ যদি হয়ে থাকে সে আমার লেখার দোষে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক শুভাশিস যেমন পেয়েছি, ঠিক বিপরীতে সমান সমালোচনাও পেয়েছি।
আপনি প্রচুর অনুবাদ করেছেন।
অনুবাদ আমাকে স্বস্তি দেয়। এখনো সময় পেলে আমি অনুবাদ করার চেষ্টা করি। লেখার ফাঁকে এই অনুবাদ আমার একটা খেলার মতো। অন্য ভাষার প্রতি আমার আগ্রহ বরাবর একটু বেশি। ইংরেজি কিংবা উর্দু থেকে অনুবাদের চেষ্টা করেছি। বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কবীর চৌধুরীসহ অনেকের অনুবাদ আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে। হাতে সময় ও সামর্থ্য থাকলে হয়তো আরও ভাষা শিখতাম। আরও অনুবাদ করতাম। তা ছাড়া আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক লেখকের একাধিক ভাষা জানা থাকা ভালো।
আপনার 'শহীদের প্রতি' কবিতা এক সময় রাজনৈতিক পোস্টার হয়েছে।
১৯৭৫-পরবর্তী কবিতাটি লেখা। যখন আমি দেখলাম আমরা যা ছিলাম আমরা তা না। এর পর দেখলাম এই বাংলাদেশ তো আমাদের বাংলাদেশ না। চারদিকে রাজকারদের আস্ফালন। তখন আমি নিরূপায় হয়ে লিখি, 'তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ'। এটা আমি এখনো বলি।
তরুণদের প্রতি আপনার উপদেশ কী।
প্রচুর পড়াশোনা ও প্রস্তুতি নিয়ে লেখা উচিত।