সোমবার, ৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

রবীন্দ্রনাথের প্রেম

আজ ২৫ বৈশাখ বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী

তানভীর আহমেদ

রবীন্দ্রনাথের প্রেম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্য বিশ্বের দরবারে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তার অমর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। কালজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠেছেন বিশ্বকবি। তার সাহিত্যে প্রেমের অপূর্ব উপস্থাপনা পাঠকদের বিমোহিত করে। ব্যক্তিজীবনে সৃষ্টিশীল রবীন্দ্রনাথ প্রেমের জন্য মরিয়া ছিলেন। স্ত্রী মৃণালিনীর সঙ্গে তো বটেই, জীবনে বেশ কয়েকবার প্রেমের উত্তাল সমুদ্রে ভেসেছেন বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ প্রথম প্রেমে পড়েন বোম্বাইতে থাকাকালীন। প্রেমিকার নাম আন্না তড়খড়। এই মারাঠি কন্যার প্রেম খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও বেশ তাত্পর্য ছিল কবিজীবনে। কারণ কবি তখন সবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। উল্টোদিকে আন্না তড়খড় বিদুষী, বুদ্ধিমতি, রূপলাবণ্যে ভরপুর এক তরুণী। এই মারাঠি কন্যা কবির কাছ থেকে ভালোবেসে একটি ডাকনাম চেয়েছিলেন। ‘নলিনী’ নামটি তার জন্য যেন তুলে আনেন কবি। সেই নাম পেয়ে আন্না বলেছিল, ‘কবি,  তোমার গান শুনলে আমি  বোধহয় আমার মরণদিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।’

বলা বাহুল্য, ‘নলিনী’ নামটি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। কবির প্রথম জীবনে রচিত বহু কাব্য-কবিতা-নাটকে এই নামের উল্লেখ পাওয়া যায় সে কারণেই। বহুকাল পরে অতুলপ্রসাদ সেন এবং দিলীপ কুমার রায়ের সঙ্গে একান্ত আলাপে এই তরুণীর কথা কবিকে স্মরণ করতে দেখা যায়। আন্না তড়খড় ছিল ডা. আত্দারাম পাণ্ডুরংয়ের কন্যা। তার সঙ্গে কবির প্রেম ছিল মাত্র এক মাসের সামান্য কিছু বেশি। জানা যায়, বহুদিন তার সঙ্গে কবির যোগাযোগ ছিল পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের স্থপতি বলে অভিহিত করা হয় জ্যোতিদাদার সহধর্মিণী কাদম্বরী বৌঠানকে। কাদম্বরী এবং রবীন্দ্র দুজনে প্রায় সমবয়সী ছিলেন। জীবনস্মৃতিতে কবি নিজেই লিখেছেন— ‘সাহিত্যে বউঠাকুরানীর প্রবল অনুরাগ ছিল, বাংলা তিনি যে পড়িতেন, কেবল সময় কাটাইবার জন্য তাহা নহে, তাহা যথার্থই তিনি সমস্ত মন দিয়া উপভোগ করিতেন। তাঁহার সাহিত্যচর্চায় আমি অংশী ছিলাম।’ কবির অনেক সাহিত্য সৃষ্টি, কবিতা এই নিঃসঙ্গ, রিক্ত নারীটিকে ঘিরেই। কবি তাকে নিয়ে ভারতী পত্রিকায় লিখলেন— ‘সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই  তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটাকতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।’ অনেক রবীন্দ্র গবেষকই বলেছেন, এই লেখাটি প্রকাশের পরেই ঠাকুরবাড়িতে আগুন জ্বলে উঠেছিল। ‘চারুলতা’ আর ‘নষ্টনীড়ে’ সেই ছাপই স্পষ্ট হয়েছে যেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গুঞ্জন ছিল। আর্জেন্টিনার প্লাতানদীর ধারে বিদেশিকন্যা ভিক্টোরিয়াকে বেশ আপন করে নিয়েছিলেন। নোবেল লাভের পর রবীন্দ্রনাথ তখন বিশ্বকবি। তার নাম ও সাহিত্যকর্মের সুভাস ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। বিশ্বজুড়ে তার ভক্ত সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থে বিমুগ্ধ ছিলেন ওকাম্পো। সে কোনো এক ফরাসি সাহিত্যিকের অনূদিত গীতাঞ্জলি পড়েই প্রেমে পড়েন রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভ্রমণের এক পর্যায়ে আর্জেন্টিনায় পা ছোঁয়ান। সেখানে পৌঁছেই প্রচুর সংবর্ধনা পেলেন বিশ্বকবি। প্রিয় কবিকে কাছে পেয়ে ওকাম্পো উদ্বেলিত হলেন। ক্রমেই কবির কাছে নিজের ভালো লাগার যে আবেদন প্রকাশ করেছেন তাতে দুজনের মধ্যে বেশ গোছানো একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। প্লাতানদীর তীর ঘেঁষে বিশ্বকবির পথসঙ্গী হয়েছেন ওকাম্পো। এরপর একটি বিতর্ক রয়েছে যে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় গান, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’ তাকে ভেবেই লেখা। কিন্তু গানটি লেখা হয়েছিল ১৮৯৫ সালে, শিলাইদহে। প্রচলিত যে, আর্জেন্টিনার কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে মনে করে রবীন্দ্রনাথ এই গানটি লিখেছিলেন, সেটি আসলে ভুল কারণ রবীন্দ্রনাথ তো আর্জেন্টিনায় যান আরও অনেক পরে, সম্ভবত ১৯২৪ সালে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমন্তবালা রায় চৌধুরীর সম্পর্কের কথাও তুলে এনেছেন রবীন্দ্রজীবনী বিষয়ক গবেষকরা। স্ত্রী মৃণালিনীর সমবয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার জন্যও রবীন্দ্রনাথের মন পুড়ত— এমনটা বলেন অনেকে। ইন্দিরা বয়সে ছোট হলেও মনের দিক থেকে এই  মেয়েটির সঙ্গে কবির আত্মিক সম্পর্ক ছিল। ইন্দিরাকে লেখা বেশ কিছু চিঠি পড়েই সেটা স্পষ্ট হয়। স্ত্রী মৃণালিনীর সঙ্গে কবির জীবন ছিল সরল, স্বাভাবিক। সেখানেও প্রেমের ছোঁয়া এতটুকু কম পড়েনি। জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে কবির প্রেমের সারল্য সাক্ষ্য দেয় কবি প্রেমকে স্বভাবজাত আবেগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, এই আবেগকে দিয়েছেন অনন্য উপমায়, অনন্য উপস্থাপন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর