ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় পেলে। একে একে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক তিনি। তার ঝুলিতে রয়েছে অসংখ্য দুর্দান্ত জয়ের গল্প। লিগে সর্বোচ্চ ১১ মৌসুমে গোলদাতাদের তালিকায় শীর্ষে থাকার কৃতিত্বও দেখিয়েছেন তিনি। এছাড়া তিনি ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩২টি অফিশিয়াল দলীয় শিরোপা জয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফুটবলে পেলের কৃতিত্ব একজন কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। অথচ এই পেলেরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা দারিদ্র্যপীড়িত বস্তিবাসী বাবা-মায়ের ঘরে। বস্তি থেকে পেলের ফুটবল কিং হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে আজকের রকমারি।
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা
কালো মানিক খ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। তার পুরো নাম এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের মিনাস গেরাইসের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মেছিলেন পেলে। বাবা ডোনডিনহো ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। খুব বেশি দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন পেলে। একজোড়া ভালো জুতা, একটি জার্সি কেনার সামর্থ্য তখন একদমই ছিল না। তবে খেলার প্রতি ছিল আজন্ম আগ্রহ। অনুশীলনের জন্য সাও পাওলোর গলিই ছিল তার একমাত্র ভরসার জায়গা। খেলার উপকরণের অভাব থাকলেও কঠোর পরিশ্রমের ভিতর দিয়ে ঠিকই নিজেকে তুলে ধরেন।
ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান
ম্যাচ খেলেছেন
১৩৬৬টি (অফিশিয়ালি, ফ্রেন্ডলিসহ অন্যান্য)
গোল দিয়েছেন
১২৮৩টি
ব্রাজিলের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন
৯২টি
ব্রাজিলের পক্ষে গোল করেছেন
৭৭টি
সান্তোস এর হয়ে ম্যাচ খেলেছেন
১১১৬টি (অফিশিয়াল, নন অফিশিয়াল, ফ্রেন্ডলিসহ অন্যান্য)
সান্তোসে গোল করেছেন
১০৯১টি
নিউইয়র্ক কসমস এর হয়ে ম্যাচ খেলেছেন
১১১টি
নিউইয়র্ক কসমসে গোল করেছেন
৬৫টি
অন্যান্য ম্যাচ খেলেছেন
২৫টি
গোল করেছেন
৩২টি
ব্রাজিলের হয়ে যত অর্জন
১৩টি। এর মধ্যে বিশ্বকাপ তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সাল), রোকা কাপ জিতেছেন দুইবার (১৯৫৭ ও ১৯৬৩ সাল), ক্রুজ কাপ জিতেছেন তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৬৮ সাল), বেরনান্দ্রো ও হিগিনস কাপ জিতেছেন একবার (১৯৫৯ সাল), এ্যাটলান্টিক কাপ জিতেছেন একবার (১৯৬০) এবং ওসায়লেদা কাপ জিতেছেন তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৬৮ সাল)।
সান্তোস এর হয়ে ট্রফি জিতেছেন
২৭টি
কোপা লিবেরাটা ডোরেস কাপ জিতেছেন
দুইবার (১৯৬২ ও ১৯৬৩ সাল)
ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছেন
দুইবার (১৯৬২ ও ১৯৬৩ সাল)
ইন্টারকন্টিনেন্টাল সুপারকাপ
একবার (১৯৬৮ সাল)
কম্পিওনাটো ব্রাসিলিয়েরো সিরি’আ জিতেছেন
ছয়বার (১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৮ সাল)
টর্নেয়িও রিও সাও পাওলো জিতেছেন
চারবার (১৯৫৯, ১৯৬৩, ১৯৬৪ ও ১৯৬৬ সাল)
কম্পিওন্যান্টো পুলিস্টা জিতেছেন
১০ বার (১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯ ও ১৯৭৩ সাল) অন্যান্য একটি।
নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে
দুইটি ট্রফি জিতেছেন।
নর্থ আমেরিকান সকাল লীগ
জিতেছেন একবার (১৯৭৭ সাল)।
তার হাতে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপে পেলের অভিষেক ঘটে ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। ম্যাচটি ছিল বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর। কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিপক্ষে পেলের করা গোলে ব্রাজিল পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। বিশ্বকাপ ফাইনালে জোড়া গোল করেন ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় পেলে। এতেই ১৯৫৮ সালের ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক বনে যান ১৭ বছর বয়সী পেলে।
প্রথম ম্যাচেই বিশ্বরেকর্ড
ব্রাজিলের হয়ে পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। বিপক্ষে ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা। পেলে বিশ্বরেকর্ডও গড়ে নেন প্রথম সেই ম্যাচেই। মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড। সেবার অবশ্য ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে যায়।
বিশ্বকাপ জয়ের তিন আসর
১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপে খেলেন পেলে। তিনিই এমকাত্র খেলোয়াড় যিনি তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) সালে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তবে ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ম্যাচে গুরুতর আঘাত পান পেলে। এ আঘাতেই তিনি বিশ্বকাপ দল থেকে ছিটকে পড়েন। কিন্তু তাতে কি, ব্রাজিল সেবারও বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে। সে কারণে অনেকে পেলে সেই দলের সদস্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক তোলে। অবশেষে ১৯৯৭ সালে ফুটবলের বিশ্ব সংস্থা ফিফা বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে ১৯৬২’র বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ঘোষণা করে।
ক্লাব ফুটবলার পেলে
ক্লাব ফুটবলেও পেলে অসাধারণ ছিলেন। দলগতভাবে ক্লাবের হয়ে শিরোপা জিতেছেন ২৬টি। ঘরোয়া লিগে ১১ বার সর্বোচ্চ স্কোরার হওয়ার কৃতিত্ব তার অর্জনের সামান্যটুকুই বোঝাতে সক্ষম। পেলের সম্পর্কে অনেকের একটা অভিযোগ আছে যে, তিনি ইউরোপীয় ফুটবলে কখনো খেলেননি, যা কিনা তার জন্য একটা সীমাবদ্ধতা। তিনি ইউরোপে খেলেননি, কিন্তু ইউরোপে তার পারফরমেন্স বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট। জাতীয় দল ছাড়াও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে তো তার পারফরমেন্স মুগ্ধ করার মতো। তবে এগুলো ছাড়াও পেলের আরও কিছু ম্যাচ আছে ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে। এসব দলের বিপক্ষে ১৩০ ম্যাচ খেলে পেলের গোল ১৪২টি।
হাজারের অধিক গোল
ফুটবল ক্যারিয়ারে পেলে ১২৮৩টি গোল করেছেন ১৩৬৩টি ম্যাচ খেলে। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে ভাস্কো-দা-গামা ক্লাবের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান লিগের এক ম্যাচে যেদিন করলেন তার হাজারতম গোল, সেদিন পুরো ব্রাজিল মেতে উঠেছিল উৎসবে। কোনো একক খেলোয়াড়ের গোল করার ব্যাপারে এটিই ছিল বিশ্বরেকর্ড।
কৌশলের রাজকুমার
ফুটবল খেলায় পেলের কৌশল ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে তার হেডিং কৌশল ছিল সবচেয়ে ভিন্ন। অধিকাংশ ডিভেন্ডারের চেয়ে বেশি উচ্চতায় লাফিয়ে বলে হিট করতে পারতেন ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বার এ মানুষটি। এছাড়াও পেলের বেন্ডিং শট ফ্রি কিক ও পেনাল্টি কিক নিতে সহায়তা করত। তবে পেলে পেনাল্টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন সবসময়। কারণ এ পদ্ধতিকে তিনি কখনোই বিরোচিত ভাবতে পারতেন না।
কোন পজিশনে খেলতেন পেলে
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কিংবা কোচদের সর্বকালের একাদশে তাকে মূলত স্ট্রাইকার হিসেবেই রাখা হয়। তবে পেলে দুর্দান্ত একজন প্লে-মেকারও ছিলেন। তবে সবচেয়ে মজার উত্তর দিয়েছিলেন কোচ সালদানা। তিনি ১৯৬৯-১৯৭০ সালে ব্রাজিলের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। ব্রাজিলের একজন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন- তার স্কোয়াডের সবচেয়ে সেরা গোলকিপার কে? উত্তরে তিনি পেলের নাম নিয়েছিলেন। তার মতে, পেলে যে কোনো পজিশনেই খেলতে পারতেন। পশ্চিম জার্মানির গ্রেট বেকেনবাওয়ার পেলেকে নিয়ে বলেছিলেন, পেলে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। তিনি ২০ বছর সবার চেয়ে এগিয়ে থেকে ফুটবল বিশ্বে রাজত্ব করেছেন। দিয়েগো ম্যারাডোনা, ক্রুয়েফ, প্লাতিনির মতো খেলোয়াড়রাও তার পেছনে থাকবে। পেলের সঙ্গে তুলনা করার মতোও কেউ নেই।
দেশের জাতীয় সম্পদ
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান পেলেকে একবার হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ করেন। স্বাগত জানানোর সময় তিনি বলেন, ‘আমার নাম রোনাল্ড রিগান, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তোমার তো নিজের পরিচয় বলার দরকার নেই। সবাই জানে পেলে কে।’ ব্রাজিলিয়ান লীগে পেলের পারফরম্যান্স এতটাই নজরকাড়া ছিল যে, তার কদর বুঝেছিলেন স্বয়ং ব্রাজিল সরকার। তার পারফরম্যান্স সরকারের কাছে অমূল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই দেশে আইন করে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এ কারণে তিনি কখনো ইউরোপিয়ান লীগে খেলতে পারেননি। এমনকি দীর্ঘ ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় একই ক্লাবে কাটিয়ে দেন। ১৯৫৬ সাল থেকে তার খেলা শুরু এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ক্যারিয়ারের শেষ অব্দি কাটান সান্তোস ক্লাবে।
দেশপ্রেম ও মানবসেবা
দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে ঠাসা অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী পেলে। ক্যারিয়ারের সোনালি সময়েই দেশ, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা পৃথিবীতে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দর্শকদের নজরও কেড়ে নেন তিনি। সব শ্রেণির মানুষ তার খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে ভিড় জমাতো। শুধু দেশের স্বার্থের কথা ভেবে ইউরোপের লিগে খেলার হাতছানি উপেক্ষা করেছেন। ফিরিয়ে দিয়েছেন অঢেল অর্থ উপার্জনের সুযোগ। দারিদ্র্যপীড়িত নিজের ছোটবেলাকেও তিনি ভুলে যাননি। তাইতো ব্রাজিলের দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে খেলোয়াড় জীবনেই গড়ে তুলেছেন বিশেষ ফাউন্ডেশন। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর হয়েছেন ইউনিসেফের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত। ব্রাজিলের ‘বিশেষ’ ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সরকার তাকে সম্মান দেয়, সেখানে পালন করেছেন নিজের একনিষ্ঠ ভূমিকা।
অর্জিত যত সম্মাননা
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের নজরে ১৯৯৯ সালে তিনি নির্বাচিত হন গত শতকের সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বিবেচনায়ও একই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। ফ্রান্সের বিখ্যাত ফুটবল সাময়িকী ফ্রান্স ফুটবলের গোল্ডেন বলজয়ী ফুটবলারদের ভোটেও পেলেই গত শতকের সেরা ফুটবলার, ইউনিসেফ আর বিবিসির জরিপেও একই।
সংসার জীবন
১৯৬৬ সালে পেলে বিয়ে করেন রোজমেরিকে। বিয়ের ১৬ বছর পর তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় পেলের। রোজমেরির গর্ভে জন্ম নেয় ছেলে এডসন এবং দুই মেয়ে ক্রিস্টিনা ও জেনিফার। বৈবাহিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও পেলেকে একা থাকতে হয়নি। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চুটিয়ে প্রেম করেন ব্রাজিলিয়ান মডেল জুজার সঙ্গে। তবে ১৯৯৪ সালে পেলে দ্বিতীয় ঘর বাঁধেন সাইকোলজিস্ট অ্যাসারিয়া লেমসের সঙ্গে। মাঠ কাঁপাতে দক্ষ হলেও সংসার জীবনে সে সফলতা দেখাতে পারেননি পেলে। শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায় তার দ্বিতীয় বিয়েও।
পেলের জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র
পেলের জীবনটা এক আশ্চর্য রোমাঞ্চে ভরপুর। বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেও হয়ে গেলেন ফুটবল বিশ্বের সম্রাট। পেলের বস্তির জীবন থেকে শুরু করে ফুটবল সম্রাট হওয়া পর্যন্ত বহু চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে। পেলের জীবনের সেই দিনগুলো উঠে এসেছে হলিউডের পর্দায়। এ গল্পটাই সিনেমার পর্দায় নতুন করে বলেন পরিচালক মাইকেল ও জেফ জিম্বালিস্ট ভ্রাতৃদ্বয়। ছবিতে ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী পেলের চরিত্রে অভিনয় করছেন ব্রাজিলিয়ান কিশোর লিওনার্দো লিমা কারভালহো। ২০১৩ সালের অক্টোবরের শুরুতে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে শুটিং হয় এ ছবির। পেলের জীবনী নিয়ে প্রথম কোনো বাণিজ্যিক ছবি হলেও রুপালি পর্দার সঙ্গে তার যোগাযোগটা বেশ পুরনো। ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলিয়ান টেলিভিশনের ধারাবাহিক ওস এস্ত্রানহোতে প্রথম দেখা যায় কালো মানিককে। হলিউডের কাঁপানো সিনেমা এসকেপ টু ভিক্টোরিতে মাইকেল কেইন, সিলভেস্টার স্ট্যালোনদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধবন্দীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সেগুলো ছিল ফুটবলার পেলের অভিনেতা হয়ে ওঠার চেষ্টা।
পেলের প্রেমে যুদ্ধ বন্ধ
ফুটবলপ্রেমীদের কাছে পেলে কতটা পছন্দের হতে পারে তা হয়তো কিছুটা ধারণা করা যায়, তবে পুরোপুরি হয়তো আন্দাজ করা সম্ভব নয়। একজন খেলোয়াড়কে দেখার জন্য কোনো দেশের যুদ্ধ বিরতি চলতে পারে তা হয়তো কেবল পেলের ক্ষেত্রেই সম্ভব। ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন একবার পেলে সে দেশে গিয়েছিলেন। শুধুমাত্র তার আগমন উপলক্ষে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলগুলো যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এ ঘটনায় প্রমাণ করে পেলের প্রতি ভক্তদের অপরিসীম ভালোবাসা।
আজীবন ফুটবল প্রেম
পেলের ফুটবল খেলা থেকে অবসর গ্রহণের বহুদিন হলো। তাই বলে নিজেকে ফুটবল থেকে দূরে রাখতে পারেননি। ফুটবলের উন্নয়নে বয়ঃজ্যেষ্ঠ পেলে ছুটে বেড়ান বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মূলত তিনি ফুটবলকে ধারণ করেন হৃদয়ের গভীরে, যাকে নাড়ির টান বলা যেতে পারে। তাইতো ফুটবলে পেশাদারিত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেও ফুটবলের জন্য তার মেধার প্রয়োগ ও পরিশ্রম থেমে থাকেনি।
পেলেকে নিয়ে কাড়াকাড়ি
পেলে ১৬ বছর বয়সে সান্তোসের মূল দলে যোগ দেন। সে বছরই ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার অর্জন করেন। পায়ের কারুকাজে ফুটবল বোদ্ধাদের নজরও কেড়ে নিলেন নিমিষে। আর তখনই বস্তির সেই দরিদ্র ছেলেটিকে নিয়ে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মতো দলগুলোও তাকে হাতছাড়া করতে চায়নি। সবাই যে কোনো মূল্যে পেলেকে দলে নিতে উঠেপড়ে লাগে।
ছিলেন চায়ের দোকানের কর্মচারী
দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের প্রথম সন্তান ছিলেন পেলে। তাই পরিবারের অভাব অনটনের ভার তিনি এড়াতে পারেননি কোনোভাবেই। ছেলেবেলাতেই পেলেকে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। এছাড়া রেলস্টেশন ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিষ্কারের কাজও করেছিলেন তিনি।
বদলে গেল জীবন
পেলের প্রতিভা ফুটে ওঠে গলির ফুটবলেই। একদিন চোখে পড়ে যায় সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। জীবনের মোড় ঘোরা শুরু। সে সময় পেলে মাত্র ১৫ বছর বয়সের এক কিশোর। পেলেকে গলি থেকে উঠিয়ে ব্রিটো নিয়ে গেলেন সান্তোস ক্লাবে। সেখানে পেলেকে অন্তর্ভুক্ত করে দেন সান্তোসের ‘বি’ টিমে। এখানেও সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মধ্যেই সান্তোসের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন পেলে।
ডিকো থেকে পেলে
প্রথম সন্তানের বেলায় সবারই কমবেশি আদিখ্যেতা থাকে। সে হিসেবেই হয়তো বাবা-মা পেলের নাম নির্ধারণ করেন ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট’। নামটি রাখা হয় বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিল রেখে। বাবা মায়ের দেওয়া শখের নাম এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট থেকে পরবর্তীতে তিনি কীভাবে পেলে হয়ে গেলেন তা নিজেও বলতে পারেন না। নাম বদলের ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বস্তিতে থাকার সময় বন্ধুরা তাকে চিনতো ‘ডিকো’ নামে।
মোজার বলে অনুশীলন
ছেলেবেলায় পেলের ছিল অদম্য ইচ্ছা। দুর্নিবার ফুটবল প্রেমের কাছে অভাব কোনো বিষয়ই ছিল না। অভাবী সংসারে বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে হয়তো একটি ফুটবল কেনার টাকা নিতে পারেননি। ব্রাজিলের আর ১০টা সাধারণ ছেলের মতোই গলির ফুটবল ছিল তারও অবসরের সঙ্গী। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না। তাই মোজার ভিতরে খবরের কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চলত তার অনুশীলন। ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে জন্মেও কালো ছেলেটির জীবনের গল্প শুরু হয় এভাবেই।
আত্মজীবনীর ওজন ১৫ কেজি
বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে পেলে নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি রচনা করেছেন আত্মজীবনীমূলক একটি বই। বইয়ের ওজন ১৫ কেজি। ফুটবলজীবনে মোট ১২৮৩টি গোল করেছেন, তাই বইটির নামও দিয়েছেন ‘১২৮৩’। এ বইয়ের পাতায় রয়েছে তার ফুটবলজীবনের পাঁচ শতাধিক ছবি। ৫০০ পৃষ্ঠার এ বইয়ে রয়েছে ১২৮৩টি টেক্সট। বইটি ছাপানো হয়েছে ১২৮৩ কপি। প্রতিটি বই বিখ্যাত ফুটবলারদের অটোগ্রাফ-সংবলিত। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ২২৫ ইউরো। ব্রাজিল ছাড়াও নিউইয়র্ক, সংযুক্ত আমিরাতের দুবাই ও যুক্তরাজ্যের লন্ডনসহ বিশেষ কিছু লাইব্রেরিতে বইটি পাওয়া যাবে।