বুধবার, ১৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

আমাজন কাহিনি

আবদুল কাদের

আমাজন কাহিনি

ল্যাটিন আমেরিকা বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছে এক নারী যোদ্ধা, নাম অ্যামাজন। পৃথিবীব্যাপী বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ দূষণকে মুক্ত করতে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত এই যোদ্ধা নারী। এর ভূখন্ডে বসবাস করে প্রায় ৬০০-এর বেশি জনজাতি গোষ্ঠী। যারাও এখন যুদ্ধ করছে বিশ্বের আতঙ্ক অদৃশ্য ভাইরাস কভিড-১৯ এর সঙ্গে।

 

 

বিলুপ্তির পথে প্রাচীন উপজাতি

করোনাভাইরাস তান্ডব চালাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয়। প্রতি মুহূর্ত বাড়ছে কভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সঙ্গে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। করোনা ঠেকাতে প্রশাসন একাধিক ব্যবস্থা, লকডাউন ইত্যাদি করেও থামানো যাচ্ছে না কভিড-১৯।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইতিমধ্যে আফ্রিকা মহাদেশকে করোনাভাইরাসের হট স্পট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় করোনার ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে আমাজন জঙ্গলে। করোনাভাইরাসের জেরে বিলুপ্তি হওয়ার পথে অ্যামাজন জঙ্গলের একটা উপজাতি। যুক্তরাজ্যের একটি রিপোর্ট বলছে, করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন জনজাতি এবং ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর মানুষ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। তন্মধ্যে ১৬০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে দেশটিতে।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে ইকুয়েডর-পেরু সীমান্তের কাছে সেইকোপাই নামের একটি প্রাচীন উপজাতি বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে এই উপজাতির সংখ্যা ৭৪৪ জন। করোনা থাবা বসিয়েছে এই উপজাতির দলে। জানা যায়,  সেইকোপাই জনগোষ্ঠিীর মধ্যে ইতিমধ্যে ১৫ জনের করোনা ধরা পড়েছে। আর এই উপজাতিটির দুই প্রবীণ নেতাও ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন করোনায়।

অ্যামাজনে বসবাসরত এই উপজাতির সভাপতি জাস্টিনো পিয়াগুয়াজের অভিযোগ, তারা স্থানীয় শহরের প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এখানে করোনার প্রভাব দেখা দেয় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু প্রশাসন তাদের কথায় কান দেয়নি। স্থানীয় কয়েকজন ডাক্তার বলেছিলেন, এটি এমনি সিজনাল ফ্লু, করোনা নয়। এরপর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়েই প্রথম যখন তাদের এক প্রবীণ নেতার মৃত্যু হয় করোনা আক্রান্ত হয়ে তখনো তারা ইকুয়েডরের সরকারের কাছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সাহায্য চায়। সরকার তাদের সাহায্যে কোনো সাড়া দেয়নি। জাস্টিনোর ভাষ্য মতে, ‘আমাদের এই উপজাতির আর মেরেকেটে ৭০০ জন রয়েছে। এর আগেও আমাদের এই ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমরা চাই না ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হোক। প্রাচীন এই জাতির বিলুপ্ত হওয়া মানে ইকুয়েডর সরকারের লজ্জা। করোনা থেকে বাঁচতে অনেকেই অ্যামাজনের জঙ্গলে পালিয়েছে।’

তবে জানা গেছে, ইকুয়েডরে অ্যামাজনের জঙ্গলে আরও কিছু উপজাতির মধ্যে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে।

 

অপার বিস্ময়ের অরণ্য

অ্যামাজন জঙ্গল। অপার বিস্ময়ের অরণ্য। কী নেই এখানে! প্রাণী বৈচিত্র্য, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য আরও কত কি! সম্প্র্রতি বিজ্ঞানীরা জাপ্রণ, অ্যামাজনের জঙ্গলে গাছের প্রজাতির সংখ্যার তালিকা তৈরি করতে তিনশ বছর লেগে যাবে। এরই মধ্যে জাদুঘরে রাখা ৫ লাখেরও বেশি উদ্ভিদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত গাছের প্রায় ১২ হাজার প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরও প্রায় চার হাজার বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের দেখা মিলতে পারে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত অ্যামাজনে। বিজ্ঞানীরা আরও নতুন নতুন আবিষ্কার এবং সেসব লিপিবদ্ধ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অ্যামাজনে আছে মাংসখেকো গাছ। এই গাছের আঠায় প্রজাপতি, ফড়িংয়ের  মতো ছোট প্রাণীরা আটকে যায়। তখন গাছের পাতা ঢেকে গিলে নিতে শুরু করে। অ্যামাজনে শুধু ভয়ঙ্কর প্রাণী আর গাছের দেখাই মিলবে না, মিলবে চোখ ধাঁধানো ফুল এবং ফুলগাছেরও। তেমনি একটি গাছ ‘লবস্টার ক্ল ফ্লাওয়ার’। এই ফুলটি লম্বায় দেড় থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। একেকটি পাতা ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এ ছাড়া অ্যামাজনে ৩ হাজারেরও বেশি প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। আছে রাবার গাছ। অ্যামাজন জঙ্গলের রাবার গাছগুলো একেকটা ১০ তলা দালানের সমান উঁচু হয়ে থাকে। চকো-বীন বা চকলেট উৎপাদনকারী গাছেরও ঠিকানা অ্যামাজন। অ্যামাজনের গভীরে আছে কফি গাছও। দৈত্যাকার পদ্মফুলের দেখা মিলবে এখানে। ভিক্টোরিয়া অ্যামাজোনিকা অ্যামাজনের আরেক বিস্ময়। প্রায় ৩ ডায়ামিটারের এই পদ্মফুল শুধু অ্যামাজনের গহিনেই দেখা মেলে। রয়েছে পাসিফ্লোরাও। এটি এক ধরনের ফ্রুট ফ্লাওয়ার। প্রতি বছর এ ফুলগাছ প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত বাড়ে।

 

মহামারীতে উজাড় হচ্ছে

সারা বিশ্বে চলছে করোনা মহামারী। এর মধ্যেও পৃথিবীর ফুসফুস উজাড়ে লেগে আছে মানুষ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশেরই উৎপত্তি অ্যামাজনে। গবেষকদের মতে, এই বন প্রতি বছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। সে কারণে একে ডাকা হয়ে থাকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে। তবে স্থানীয় অনেক সংস্থার অভিযোগ, সরকারি আইন অমান্য করে ব্রাজিলে অ্যামাজন জঙ্গলে বেড়ে গেছে বন উজাড়ের হার। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির স্পেস এজেন্সির তথ্য মতে, ২০১৯ সালের এপ্রিলের তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিলে বন উজাড়ের হার ৬৪ ভাগ বেশি। ফলাফল স্বরূপ এ বছরের প্রথমার্ধে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে অ্যামাজনের বন উজাড়ের হার ৫৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এদিকে ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট স্পেস রিসার্চের তথ্য মতে, গেল এপ্রিল মাসে প্রায় ৪০৫ বর্গকিলোমিটার বন নিঃশেষ হয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে যার পরিমাণ ছিল ২৪৮ বর্গকিলোমিটার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে উজাড় হয়েছে ১ হাজার ২০২ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল। সংরক্ষক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে খুব অল্পসংখ্যক সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে অ্যামাজনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হারকে ধীর করতে অ্যামাজনের ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যদিও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো এসব অভিযোগ পাত্তা দিচ্ছেন না। চলতি সপ্তাহের প্রথম দিকে তিনি অ্যামাজন অঞ্চলে সেনা মোতায়েনের অনুমতি দিয়েছেন। তখন থেকে সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি চলছে। এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে এখনো সেনা মোতায়েন করা সম্ভব হয়নি।

 

করোনায় সংকটাপন্ন অ্যামাজন অধিবাসীরা

দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে অ্যামাজন বন। অনেক দেশের মধ্যে ছড়িয়ে। সেই জঙ্গলের প্রাচীন উপজাতিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে মরণ রোগ করোনাভাইরাস। যুক্তরাজ্যের একটি রিপোর্ট বলছে, করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। কৃষ্ণাঙ্গদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও বেশি। তবে যুক্তরাজ্যের রিপোর্টে স্পষ্ট নয়, বিষয়টি কেবল সে দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, সময় মতো করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি স্থানীয় দেশগুলোর সরকার। ফলাফল বিস্তীর্ণ অ্যামাজনেও ছড়িয়ে পড়েছে কভিড-১৯ ভাইরাসটি।

পৃথিবীর ফুসফুস নামে খ্যাত অ্যামাজন জঙ্গল। যা দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে আশপাশের আরও নয়টি দেশে। বহু শতাব্দী ধরে অ্যামাজনের জঙ্গলে আদিবাসী মূলবাসীদের বসবাস। যার মধ্যে বেশ কিছু জনজাতি এখন বিলুপ্তপ্রায়। করোনাভাইরাসের প্রকোপ ইতিমধ্যে তাদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। জঙ্গলে ভয়ানক জীব-জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করা এ উপজাতিরা অদৃশ্য এই ভাইরাসে শঙ্কিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যামাজন জঙ্গলে প্রায় ৬০০টি জনজাতি গোষ্ঠীর বসবাস। যার মধ্যে ১৮০টি গোষ্ঠীর মধ্যে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। এসব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার অভিযোগ, কোনো দেশের সরকারই এই মানুষদের নিয়ে চিন্তিত নয়। সামান্য ওষুধ, খাবার, এমনকি স্বাস্থ্যবিধির অন্যতম অংশ মাস্কও পাঠানো হচ্ছে না তাদের জন্য। ফলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জনজাতিগুলো নিজেরাই অর্থ সংগ্রহ করে নিজেদের সুরক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে ব্রাজিলের অংশের আমাজন জঙ্গলের আদিবাসী নারীরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমেছেন।

 

রহস্যের লীলাভূমি

মানুষের জানার আগ্রহ প্রখর। অজানা, গোপন বা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতূহলের কমতি নেই। সেই কৌতূহল থেকেই অভিযাত্রীরা চষে বেড়ান পৃথিবী। খুঁজে বেড়ান রহস্যময়তার পেছনের রহস্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জঙ্গল অ্যামাজন তেমনি এক রহস্য। পৃথিবীর মানচিত্রে সবুজে ঘেরা সবচেয়ে বড় অংশটি অ্যামাজনের। যা প্রায় নয়টি দেশজুড়ে বিস্তৃত। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগে ছড়িয়ে আছে জঙ্গলটি। বনের প্রায় ৬০ শতাংশই আবার ব্রাজিলের অধীনে। ব্রাজিল ছাড়াও পেরু, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্জ গায়ানা অ্যামাজন বিস্ময়ে ডুবে রয়েছে। ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই বনের অনেক স্থানেই এখনো মানুষের পা পড়েনি। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশই হলো এই দুর্গম অ্যামাজন জঙ্গল। পৃথিবীজুড়ে রেইন ফরেস্টের যত আয়তন, তার অর্ধেকটাই এই অ্যামাজন। বিস্ময়কর এই বনের আয়তন যেমন বিশাল তেমনি বিশাল এই বনের প্রাণী ও উদ্ভিদ-বৈচিত্র্য। রেইন ফরেস্ট অ্যামাজনে মাত্র দুটি ঋতু রয়েছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষা। গরমপ্রধান এই বনে ছয় মাস গ্রীষ্ম ও বর্ষা থাকে। এই বনে গুমোট গরম আবহাওয়া কখনই সরে যায় না। প্রায় সব সময় ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকায় এই বনে পথচলা খুবই কষ্টের। এ ছাড়া এখানকার আর্দ্রতা থাকে ৭৭ থেকে ৮৮ শতাংশ। যে কারণে অল্পতেই হাঁপিয়ে যান বনে প্রবেশকারীরা। অ্যামাজনকে রেইন ফরেস্ট বলা হয়। কারণ, এখানকার আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে।

 

রহস্য নয়, সত্যি!

বিচিত্র অ্যামাজনে রয়েছে বিচিত্র প্রাণীও। অভিযাত্রীদের মধ্যে যারা বেঁচে ফিরেছেন, তারা বলেছেন এই জঙ্গলে আছে বিষাক্ত পানি। আছে মানুষখেকো সাপ। ফুটন্ত নদী, যার পানি নিচ থেকে টগবগিয়ে ফুটছে। সে রহস্য এখন সবারই জানা। অ্যামাজন বনে সত্যিই রয়েছে ফুটন্ত নদী। এই রহস্যময় নদীর পানির তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পানি এত গরম যে তাতে মানুষ মারা যেতে পারে। অ্যামাজনের অ্যানাকোন্ডা নিয়েও নানা রকমের কল্পকাহিনী রয়েছে। বাস্তবে এরা মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকারের এই সাপ অ্যামাজনের আতঙ্ক বলেই জানেন সাধারণ মানুষ। অ্যামাজনের গ্রিন অ্যানাকোন্ডার ওজন প্রায় ১৫০ থেকে ২২৭ কেজি। লম্বায় ২৭ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। দৈত্যাকার প্রাণীটি রাতে শিকারে বের হয়। তবে সাপটির তেমন বিষ নেই। এ ছাড়া অ্যামাজনে আছে ব্ল্যাক কেইম্যান কুমির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কুমির এটি। দৈর্ঘ্যে ৯ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ওজন প্রায় ৪০০ কেজি। অ্যামাজনের নদীতে রয়েছে গোলাপি ডলফিন।  সাড়ে আট থেকে সাড়ে নয় ফুট লম্বা গোলাপি ডলফিন। এদের মস্তিষ্কের আয়তন মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে বেশি। আমাজনের রয়েছে পিরানহা। ছোটখাটো হলেও মাংসাশী পিরানহা খুবই হিংস্র। মাত্র ১৮ ইঞ্চি লম্বা এবং প্রায় ৬০ রকমের প্রজাতি শুধু অ্যামাজনের নদীতেই রয়েছে।

 

দাবানলে অ্যামাজন

‘পৃথিবীর ফুসফুস’-খ্যাত অ্যামাজন জঙ্গল। কিন্তু মানুষের লোভ-লালসা আর প্রকৃতির রোশানলে পুড়ে ছাই হচ্ছে প্রায়সই। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ ২০১৩ সাল থেকে অ্যামাজন জঙ্গলে আগুন লাগা নিয়ে গবেষণা করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, রেকর্ড হারে পুড়ছে অ্যামাজন জঙ্গল। এরই মধ্যে ব্রাজিলের রোন্ডানিয়া, অ্যামাজোনাস, পারা, মাতো গ্রোসো অঞ্চলের কিছু অংশে আগুনে পুড়ে উজাড় হয়েছে অরণ্য। অ্যামাজনে আগুন লাগা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, কিন্তু গেল ২০১৯ সালের আগস্টের মতো আগুন আগে কখনো ছড়ায়নি জঙ্গলে। গত বছর পর্যন্ত ব্রাজিলে প্রায় ৭২,৮৪৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আগুনের ঘটনা অ্যামাজন জঙ্গলের, যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ মতে, দাবানলে প্রতি মিনিটে অ্যামাজনের প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকা পুড়ে গেছে। গেল বছর সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, সেখানকার আকাশ কালো, সূর্য ঢেকে গেছে ধোঁয়ায়। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতি জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী লড়াইয়ে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

 

গোপন ‘সোনার শহর’

অ্যামাজনের ইতিহাস পড়লে জানা যাবে, এই বনের বয়স প্রায় ৩ হাজার বছর হতে চলল। প্রাচীনকাল থেকেই অ্যামাজন অত্যন্ত দুর্গম। আগের দিনের অভিযাত্রীরা অ্যামাজনে প্রবেশ করতেন সোনা, রুপা এবং ধন-রতেœর খোঁজে। এখনো সেটি অব্যাহত আছে। এই রহস্যঘেরা বনে অফুরন্ত সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমনটাই বিশ্বাস মানুষের। যেমন পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করতেন, বিশাল এই জঙ্গলে লুকিয়ে আছে ‘এলডোরাডো’ নামের গুপ্ত শহর। ধারণা করা হয়, শহরটি পুরোটা সোনায় মোড়ানো। সেই সোনার শহরের খোঁজ আজও অভিযাত্রীরা। এ নিয়ে অবশ্য অনেক কল্পকাহিনী মুখে মুখে প্রচলিত। সোনার শহরের ধারণাটি আসলে এসেছে গ্রিক পৌরাণিক গল্প থেকে। সে গল্পে বলা হয়েছে ‘এলডোরাডো’ নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহারা দেয় একশ্রেণির বিশেষ নারীযোদ্ধা। যাদের গল্পে ‘অ্যামাজন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগিতায় নামেন এই ‘এলডোরাডো’ শহর আবিষ্কারের জন্য। যদিও এখনো কেউ এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পাননি।

 

আদিবাসীরাই অ্যামাজনের প্রাণ

অ্যামাজানের অধিবাসীরা আধুনিক সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। অ্যামাজনে বসবাস করা এসব উপজাতিকে নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রবল কৌতূলের শেষ নেই। কেউ বলেন কীভাবে বসবাস করে ওরা! সভ্যতার বাইরে থেকে কতটা পিছিয়ে তারা! কেউ কেউ তো বলেন, অ্যামাজনের গহিনে মানুষখেকো মানুষের বসবাস রয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকলেও এটা সত্যি যে, মানুষের অজানা অনেক নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে অ্যামাজনে। অ্যামাজনের বলিভিয়া অঞ্চলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্থ হার্টের মানুষেরা বসবাস করেন। ধারণা করা হয়, অ্যামাজনে প্রায় ৪০০-এর বেশি আদিবাসী গোত্রে ভাগ হয়ে অন্তত ২ লাখ মানুষের বসবাস। এদের সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি। কিছু নৃগোষ্ঠী যাযাবর প্রকৃতির। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এদের যোগাযোগ তেমন একটা নেই বললেই চলে। মোট ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়।  এ ছাড়া তারা পর্তুগিজ, স্প্যানিস ইত্যাদি ভাষায়ও কথা বলে এসব আদিবাসী। এ ছাড়াও এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু যাযাবর। যাদের অনেকের সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ নেই সভ্য দুনিয়ার। যাদের পরনে এখনো কোনো কাপড় নেই। সম্প্রতি আলোচিত হয়েছে ব্রাজিলের অ্যামাজন জঙ্গলে সন্ধান পাওয়া এক আদিবাসী গোত্রের। ব্রাজিল সরকারের ধারণা মতে, দেশটির অ্যাকরি রাজ্যের দুর্গম গভীর অরণ্যে বাস করা এই মানবগোষ্ঠীটির লোকসংখ্যা প্রায় ২০০। ব্রাজিল সরকার তাদের দিকে সুনজর না দিলেও, ছোট্ট গোষ্ঠীটি সভ্য মানুষদের অরণ্যধ্বংস, মাইনিং, গবাদি পশু পালন, মাছধরা, অবৈধ শিকারসহ স্বেচ্ছাচারিতার বলি হয় কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখছে। তারা অ্যামাজন অরণ্যের পেরুর সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করেন। গোত্রটির নাম ‘আনকন্টাকটেড’। তারা জঙ্গলে বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করে জীবন কাটান। আধুনিক সভ্যতা কিংবা অ্যামাজন জঙ্গলে তাদের এলাকার বাইরের রাজ্য সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এ বছর ব্রাজিলের আক্রে রাজ্যের জিনানে নদীর অববাহিকায় বিমানে করে একদল ফটোগ্রাফার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় তাদের দেখতে পান এবং তাদের ছবি তোলেন। এসব ছবিতে দেখা যায় আদিবাসীরা বিমান দেখে ঘাবড়ে গেছেন এবং সবাই একসঙ্গে বর্শা উঁচিয়ে বিমানকে ভয় দেখাচ্ছেন। এমন আদিবাসী গোত্রের কথা প্রায়ই জানা যায়। সত্যি বলতে, অ্যামাজনের আদিবাসীদের উৎপাত করতে চায় না কেউ। তারা নিজেদের মতোই বনে বসবাস করছেন যুগের পর যুগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর