বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

রহস্যময়ী নেফারতিতি

রণক ইকরাম

রহস্যময়ী নেফারতিতি

পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় সভ্যতা হচ্ছে মিসরীয় সভ্যতা। আর সেই রহস্যে ঘেরা সভ্যতার এক ঐতিহাসিক চরিত্র নেফারতিতি। মিসর তো বটেই গোটা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সুন্দরীদের একজন মানা হয় নেফারতিতিকে। আর মিসরীয় সভ্যতার ‘সিগনেচার’ বা চিহ্ন হিসেবে পিরামিড আর মমির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এই সুন্দরীর আবক্ষ মূর্তির ছবি বা প্রতিলিপি।  এই ফারাও সম্রাজ্ঞীর প্রহেলিকাময় আবক্ষ মূর্তিটি সারা বিশ্বে প্রচন্ড জনপ্রিয় এবং আগ্রহের বিষয়। মিসরের ফারাও সম্রাজ্ঞীদের মধ্যে,  এমনকি তখনকার মিসরবাসীর মধ্যেও তার রূপ ছিল কিংবদন্তির মতো

 

আখেনাতেন-নেফারতিতি

সেই আবক্ষ মূর্তির নারীটি...

মিসর তো বটেই গোটা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সুন্দরীদের একজন মানা হয় নেফারতিতিকে। আর মিসরীয় সভ্যতার ‘সিগনেচার’ বা চিহ্ন হিসেবে পিরামিড আর মমির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এই সুন্দরীর আবক্ষ মূর্তির ছবি বা প্রতিলিপি। এই ফারাও সম্রাজ্ঞীর প্রহলিকাময় আবক্ষ মূর্তিটি সারা বিশ্বে প্রচন্ড জনপ্রিয় এবং আগ্রহের বিষয়। মিসরের ফারাও সম্রাজ্ঞীদের মধ্যে, এমনকি তখনকার মিসরবাসীর মধ্যেও তার রূপ ছিল কিংবদন্তির মতো। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ১৩৭০ থেকে ১৩৩০ বছর আগ পর্যন্ত নেফারতিতির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গেছে। আর ঠিক এরপর থেকেই মিসরের সব ঐতিহাসিক দলিল, দস্তাবেজ থেকে তার নাম মুছে ফেলা হয়েছে। প্রত্নতাত্তি¡ক জিনিসপত্রে তার আর কোনো চিহ্ন রক্ষিত হয়নি যেমন রক্ষিত রয়েছে অন্য ফারাও আর তাদের সম্রাজ্ঞীদের স্মৃতি। নেফারতিতি নামের অর্থ হলো সুন্দর আসছে। নেফারতিতি বিয়ে করেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের সন্তান আখেনাতেনকে যিনি পরবর্তী ফারাও হিসেবে রাজত্ব করেন চতুর্থ আমেনহোটেপ হিসেবে। তিনি ছিলেন মিসরের অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও। তার সঙ্গে একাত্ম হয়েই মিসর শাসন করেন নেফারতিতি। ধারণা করা হয় নেফারতিতি ও আখেনাতেনের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না যা সাধারণত মিসরীয় ফারাওদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। নেফারতিতির জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি বলেই তিনি এত রহস্যের কারণ। তবে ধারণা করা হয়, তিনি রাজ রাজবংশের একজন ছিলেন। তিনি ঠিক কোথায় জন্মেছিলেন এখনো সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। কারও কারও মতে তিনি আখমিম শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি মিসরের বাইরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বেশির ভাগের মত হলো নেফারতিতি ছিলেন আয়ের কন্যা। আয় ছিলেন ফারাওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি তিন তিনজন ফারাওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন এবং ধরা হয় তিনি ফারাও তুতেনখামেনের রাজ্যের অন্যতম শক্তি ছিলেন। এই তুতেনখামেন হচ্ছে নেফারতিতির সৎ ছেলে। আর পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র তার মমি বা সমাধিই অবিকৃত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়।  আর এই মমির অভিশাপে অনেক মানুষের মৃত্যু হয় যেটি ইতিহাসে তুতেনখামেনের মমির অভিশাপ নামে বিখ্যাত।

 

পাল্টে দিলেন ধর্ম ব্যবস্থা

বহু ঈশ্বরের ধারা ভেঙে দেওয়া সেই সময়ের মিসরে সহজ কাজ ছিল না। শক্তিশালী পুরোহিতদের বিরোধিতা এবং জনগণের আপত্তির মুখেও এই কর্মযজ্ঞ চালিয়ে গেছেন আখেনাতেন। কিন্তু তার একার পক্ষে সব করা সম্ভব ছিল না। স্ত্রী নেফারতিতি সব সময় তার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আবার কারও কারও মতে, এই বিশাল কর্মকান্ডের মূল হোতা ছিলেন নেফারতিতিই। নতুন ধর্ম মতে আমূল বদলে গেল মিসরীয় জীবনধারা। প্রথমত আমেনহোটেপ তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন, আখেনাতেন। আখেনাতেন মানে হচ্ছে আতেনের পুত্র। আতেন [সূর্য দেবতা]-এর উপাসনার ধরন একটু অন্যরকম ছিল। এই দেবতার উপাসনা দিনের আলোতে বাইরে সবার সামনে হতো। এর আগে আমুন-রা এর উপাসনা পুরোহিতেরা অন্ধকার মন্দিরগুলোর ভিতরে রহস্যময় কায়দায় করতেন। সাধারণ মানুষের সেই উপাসনার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ থাকত না। নতুন দেবতা এবং নতুন উপাসনার ফলে সৃষ্টিকর্তা এবং জনগণের মাঝে শুধু একটি সত্তাই রয়ে গেল। তিনি হলেন ফারাও আমেনহোটেপ বা আখেনাতেন স্বয়ং। ফলে পুরোহিতদের গুরুত্ব চরমভাবে হ্রাস পেল। উপাসনার জন্য দেবতাকে উৎসর্গে পুরোহিতরা যে অর্থ জনগণ থেকে নিতেন, সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, আখেনাতেন হুকুম দিলেন কার্নাকের মন্দিরের সব জৌলুস সরিয়ে দিতে। সাম্রাজ্যের নানা প্রান্তে তার আদেশে আমুন-রা এবং অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি সরিয়ে ফেলা শুরু হলো। থেকে গেল শুধু এক ঈশ্বর আতেন বা সূর্য। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকল পুরোহিতদের ক্ষোভ। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না আখেনাতেনের।

খুব বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারলেন না তিনি। সূর্য দেবতার শহরের কাজ শেষ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। এরপরই ঘটে সেই অবিস্মরণীয় পরিবর্তন। মিসরের ফারাও হন নেফারতিতি।  নেফারতিতির তত্ত¡ বধানে আতেন দেবতার আখেতাতেন শহরের কাজ আরও জোরেশোরে শুরু হয়। এর মধ্যেই নেফারতিতির মৃত্যু হয়। আখেনাতেন এবং নেফারতিতির কোনো ছেলে ছিল না, ছিল ছয় মেয়ে। তাই নেফারতিতির মৃত্যুর পর পুরোহিতেরা আখেনাতেনের অন্য রানীর আট বছর বয়স্ক ছোট ছেলে তুতেনখামেনকে মিসরের ফারাও নির্বাচন করেন। বালক তুতেনখামেনকে সিংহাসনে বসিয়ে, পুরোহিতরা সমগ্র মিসরকে আগের অবস্থায় নিয়ে যান। আখেতাতেন শহরের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, আবার পুরোদমে উপাসনা শুরু হয় কার্নাকের মন্দিরে। সূর্য দেবতা আতেনের বিদায় হয় এবং  আবার শুরু হয় দেবতা আমুন-রা এবং অন্য সব দেবদেবীর উপাসনা।

 

চলছে সূর্য দেবতা আতেনের উপাসনা

বহু ঈশ্বর থেকে একেশ্বরে

ফারাওরা মিসরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে শাসন করতেন। তাদের ছিল অনেক দেবদেবী, অর্থাৎ তারা বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। ফারাওয়ের পরই ছিল শক্তিশালী পুরোহিত গোষ্ঠী। মূলত এদের দ্বারাই শাসিত হতো মিসর। তারা নানা দেবদেবীর উপাসনা করতেন। মন্দিরগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকত। জনগণ এবং ঈশ্বরের মাঝে থাকতেন শুধু ফারাও এবং তার পুরোহিত বাহিনী। এই বহু ঈশ্বরবাদে পরিবর্তন আসে নেফারতিতি-আখেনাতেনের সময়। তখন মিসরে নানা দেবদেবী এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা আমুন-রায়ের উপাসনা হতো। কার্নাকের মন্দির ছিল প্রধান উপাসনালয়। আমেনহোটেপ [আখেনাতেন] আমুন-রাকে দেবতা হিসেবে অস্বীকার করেন এবং অন্য সব দেবদেবীকেও নাকচ করে দেন। তিনি নিয়ে আসেন নতুন সৃষ্টিকর্তা আতেনের ধারণা। মিসরের এটাই প্রথম এলো একেশ্বরবাদী চিন্তাধারা। আতেন মূলত সূর্য দেবতা। আমেনহোটেপ একমাত্র দেবতা আতেনের উপাসনা করতেন। তখনই তার নাম পাল্টে আখেনাতেন হয়। এক্ষেত্রে তার স্ত্রী নেফারতিতিও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তারা দুজনে মিলে সূর্য পূজার নতুন ধর্মের প্রচলন করেন এবং তারা দুজন ছিলেন এই ধর্মের কান্ডারি। তাদের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ সূর্য দেবতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত।  তারা একটি শহরও প্রতিষ্ঠা করেন এই সূর্য দেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এই শহরে খোলা আকাশের নিচে এখনো কিছু সূর্য দেবের উপাসনালয় আছে।

 

ক্লিওপেট্রার চেয়েও সুন্দরী!

জন্ম বা বংশ বৃত্তান্ত যা-ই থাক তিনি যে সুন্দরী হিসেবে কিংবদন্তি ছিলেন তাতে দ্বিমত ছিল না কারও। পুরুষকে নাচানো তো বটেই রাজ্য শাসন এবং কূটনীতিতেও অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন নেফারতিতি। ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার তুলনা চলে না, কারণ নেফারতিতি ছিলেন ক্লিওপেট্রার চেয়েও প্রায় দেড় হাজার বছর আগের রানী। তবুও ইতিহাস দুজনকে এক বিন্দুতে দাঁড় করালে বারবার নেফারতিতির দিকেই পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে। কারণ ইতিহাসের প্রথম নারী ফারাও, ধর্ম সংস্কার, আখেনাতেনের প্রতি ভালোবাসা আর সর্বোপরি মোহনীয় সৌন্দর্যের কারণে অধিকাংশ দিক থেকেই ক্লিওপেট্রাকে হারিয়ে দিয়েছেন নেফারতিতি। জীবৎকালে মিসরের রাজনীতির জটিল পাশাখেলার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন নেফারতিতি। ফারাও আখেনাতেনের প্রধান স্ত্রী হয়ে মিসরের বহু ঈশ্বরবাদী ধর্মচেতনা থেকে একেশ্বরবাদী ধর্মের দিকে প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্বে ছিলেন নেফারতিতি। প্রাচীন হায়োরিগ্লিফিতে তাকে বলা হতো উত্তরাধিকারিণী, মধুরতার দয়িতা, মধুভাষিণী। নেফারতিতি মানে দুই ভূ-খন্ডের নারী। মিসরের উচ্চ ও নিম্নভূমির প্রিয় পাত্রী ছিলেন বলেই সম্ভবত তাকে এটা বলা হতো। অনেকেই বিশ্বাস করেন, আখেনাতেনের মৃত্যুর পর এবং তুতানখামেনের সিংহাসন আরোহণের আগে তিনি মিসর শাসন করেছিলেন।  আর এসব কিছুই আসলে নেফারতিতিকে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে।

 

ঐতিহাসিক জুটি

ইতিহাস বলছে মিসরীয় ফারাওদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার বিষয়টি কখনই মুখ্য ছিল না। বিশেষ করে ক্লিওপেট্রার আগের সময় পর্যন্ত। তখনকার মিসরীয় ফারাওদের একাধিক পত্নী এবং অসংখ্য উপপত্নী থাকত। ফলে এতজনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসে একজন নারী ফারাওয়ের আকুণ্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত হবেন, এমনটা মোটামুটি অসম্ভবই ছিল। কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন নেফারতিতি। তার স্বামী আখেনাতেনের প্রধান স্ত্রী ছিলেন তিনি। আর কেবল নামেই প্রধান স্ত্রী নয়, সত্যিকার স্ত্রী হিসেবে নিজের অধিকারের প্রায় পুরোটাই আদায় করে নিতে পেরেছিলেন তিনি।  আর মিসরের ইতিহাসে তাই প্রেমিক দম্পতি হিসেবে অন্যরকম স্থান দখল করে আছেন আখেনাতেন-নেফারতিতি দম্পতি।

 

আজও রহস্য সমাধি ঘিরে

পুরাতত্ত্ববিদরা প্রাচীন মিসরের রানী নেফারতিতির সমাধির খোঁজ করছেন বহুদিন ধরে। কিন্তু কিছুতেই খোঁজ পাননি। নানান সময়ে এটির খোঁজ পাওয়ার দাবি উঠলেও অধিকাংশ সময় এই দাবি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে যে কথাটি না বললেই নয়, সেটি হলো এখন পর্যন্ত এ ক্ষমতাশালী নারীর মৃতদেহ বা সমাধি নিয়ে রহস্যই থেকে গেছে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এখনো এ নিয়ে গবেষণা করছেন। দ্বিতীয় আমেনহোতেপের মন্দিরে যাকে ‘কেভি ৩৫’ বলা হয়, সেখানে তিনটি মমি পাওয়া যায়। যার মধ্যে দুটি ছিল নারীর এবং একটি ছিল অল্প বয়সী কোনো ছেলের। তখন চারদিকে হইচই পড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে এই মমিগুলোর মধ্যে একটি আখেনাতেনের মা তুতেন খামেনের দাদি এবং আমেনহোতেপ তৃতীয় স্ত্রী রানী তিয়ার। আর একটি ছিল তারই ছেলে। ধারণা করা হয় তিনি আখেনাতেনের ছোটভাই ছিলেন। তৃতীয় মমিটা ছিল খুবই আশ্চর্যজনক। ডক্টর ফ্লেচার বলে একজন গবেষক ধারণা করেন মমিটা ছিল রানী নেফারতিতির। ফ্লেচার প্রাচীন মিসরীয় নারীদের চুল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। প্রাচীন রানীরা বিভিন্ন পরচুলা এবং মুকুট পরিধান করতেন যা তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উৎসব বা আয়োজনে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত করত। এই পরচুলা এবং মুকুট নিয়ে গবেষণা করে নিজের মতবাদ দাঁড় করান ড. ফ্লেচার। তিনি খেয়াল করে দেখেন এক ধরনের বিশেষ মুকুট পরলে মাথার একটা অংশে দাগ তৈরি হয়। আশ্চর্যজনকভাবে অচিহ্নিত মমির গায়ে এরকমই একটি দাগ রয়েছে। এই যুক্তিকে সামনে রেখে ড. ফ্লেচার দাবি করলেন এই মমিটি নেফারতিতির। আর সেই অনুসারে কেভি থার্টি ফাইভই আসলে নেফারতিতির সমাধিক্ষেত্র। তবে ফ্লেচারের এই দাবিকে রীতিবিরুদ্ধ বলে মানা হয়। এই মমিটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সম্পূর্ণ মমিটা ক্ষতবিক্ষত ছিল। কে বা কারা যেন এর মুখমন্ডলে আঘাতের পর আঘাত করে তার একপাশ ধসিয়ে দিয়েছে। তার বক্ষজোড়া যেন কারা কেটে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেই মমির শরীরে কোনো ব্যান্ডেজ ছিল না। প্রাচীন মিসরের বিশ্বাস অনুযায়ী ‘যদি কোনো মমিকে নষ্ট বা তাতে ক্ষত তৈরি করা হয়, তাহলে পরবর্তী জীবনে দেবতারা তাকে চিনতে পারবেন না এবং সে দেবতাদের সামনে নিজের নাম বলতে পারবে না। এর ফলে সে মৃত্যুর পর জীবন ও মৃত্যুর জগতের মাঝে আটকা পড়ে যাবে।’ তার মানে যারা এই মৃতদেহটিকে মমি করেছে, তারা প্রচন্ড ঘেন্নাভরে কাজটি করেছে। তারা কখনই চায়নি মৃত্যুর পরের জীবনে এই মানুষটি দেবতাদের অনুগ্রহ পাক। আর নেফারতিতির মৃত্যুর পর তার চিহ্ন মুছে ফেলাসহ ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ থেকে গায়েব করে দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। ফলে ওই সময়ের লোকজন কোনো মতেই চায়নি রানী নেফারতিতি পরবর্তী জীবনে স্বর্গে যান। এমনকি এটাও চায়নি যে তার মমি কেউ শনাক্ত করতে পারুক। এসব যুক্তি দিয়ে ডক্টর জোয়ান ফ্লেচার ক্ষত-বিক্ষত মমিটিকে নেফারতিতির মমি প্রমাণের চেষ্টা চালান। তবে শেষ পর্যন্ত ফ্লেচারের গবেষণা ভুল প্রমাণিত হয়। আদতে ওই মমিটি নেফারতিতির ছিল না। ফ্লেচারের ভুল পথে গবেষণার জন্য তাকে বর্তমানে মিসরে গবেষণার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাহলে এই ক্ষতবিক্ষত মমিটি কার?

ধারণা করা হয় রানী নেফারতিতি নিজের প্রধান রানীর ক্ষমতা রক্ষা করতে কোনো এক সময় তুতেনখামেনের মা এবং তার স্বামী আখেনাতেনের বোন ও স্ত্রী ‘দ্য ইয়ংগার লেডি’-কে হত্যা করেন। গবেষকরা দেখেছেন সেই নারীর মৃত্যু হয় সে জীবিত থাকা অবস্থায়। তার বুকের বামদিক দিয়ে ছুরির ঘায়ের দাগ থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু মমিফিকেশনের অনেক পরে তার মুখমন্ডলের ওপর আঘাত করা হয়। পরবর্তীতে বক্ষ ছিন্ন করে ফেলা হয়। কারও কারও মতে সেই খুন নেফারতিতি সংগঠিত করেন অথবা কাউকে দিয়ে করিয়ে নেন। আর কোনোভাবে সেই লাশকে নিজের নামে চালিয়ে দেন। কারণ সেই মমির মৃত্যুর সময়কাল রানী নেফারতিতির গায়েব হওয়ার সময়কাল এক ছিল। এ ধারণার সঙ্গে আরও বেশ কিছু ইজিপ্টোলজিস্ট সমর্থন দিয়েছেন। তারা তাদের জার্নালেও একই কথা উল্লেখ করেছেন।

কিছুদিন আগে বিশেষজ্ঞরা সম্রাট তুতেনখামেনের সমাধির ভিতরেই তার গোপন কবরের কিছু ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। সেই অনুসন্ধানের সূত্র ধরেই এই সমাধির ভিতরে ফাঁপা জায়গার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে এবং সেখানে সম্ভাব্য জৈব পদার্থ রয়েছে বলে জানিয়েছেন মিসরীয় অনুসন্ধানকারীরা। তবে বহু অনুসন্ধান চালানোর পরও গবেষকদের শেষ পর্যন্ত হতাশ হতে হয়েছে। কারণ সেখানে নেফারতিতির মমির কোনো অস্তিত্ব এখনো পাওয়া সম্ভব হয়নি। ইতিহাস থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছিল নেফারতিতিকে তেমনই যেন হাওয়ায় মিইয়ে গেছে তার মৃতদেহ কিংবা সমাধি। এমন করে নেফারতিতির সমাধি গায়েব হয়ে যাওয়ার কোনো ব্যাখ্যাই  এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

 

মুছে দেওয়া রানী!

রহস্যে ঘেরা এই রানী নেফারতিতির রহস্যময় জীবনের মতো তার মৃত্যুও রহস্যময়। ঠিক কবে তার মৃত্যু হয়েছিল জানা যায়নি। ঠিক কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল তাও কেউ জানে না। অনেকটা হঠাৎ করেই ইতিহাস থেকে হারিয়ে যান এই রানী। এরপর আর তার সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ধরে নেওয়া হয় তখন তার মৃত্যুই ঘটেছিল।   নেফারতিতির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার সব মূর্তি, স্তম্ভ, প্রাসাদ অর্থাৎ নেফারতিতির বানানো সব সভ্যতার চিহ্নকে ধ্বংস করা হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন পুরোহিতরা। কারণ ‘আতেন’-কে পেতে হলে ফারাও আর তার স্ত্রীকে (নেফারতিতি) পূজা করাও ছিল বাধ্যতামূলক। এ বিষয়টি পুরোহিতরা কোনো মতেই মানতে পারেননি। তাই ইতিহাসে নেফারতিতির কোনো উল্লেখ নেই সেই দিন থেকে, যেদিন তার মৃত্যু ঘটে। আর তার সম্পর্কিত সব তথ্য মুছে ফেলেন পুরোহিতরা। পুরোহিতদের কাছে এটা চরম অপমানজনক ছিল যে, একজন নারী তাদের ফারাও ছিলেন। তাই এ তথ্য তারা ইতিহাসে রাখতে চাইলেন না। তারা সমগ্র মিসরে যেখানেই নেফারতিতির নাম ছিল সেখানেই পরিবর্তন করেন। মিসরের বর্ণমালায় নেফারতিতির ছবিতে একজন নারীর প্রতিচ্ছবি থাকার কথা। পুরোহিতেরা নেফারতিতির ছবিগুলোতে বিকৃত করল- মাথায় সাপ এঁকে দিল। যাতে মনে হয় এই ফারাও একজন পুরুষ। এতকিছুর পরও সৃষ্টিকর্তার ভয়ে তারা নেফারতিতির মমি তৈরি বন্ধ করল না। তারা নেফারতিতির মমি তৈরি করে কিন্তু সেটিকে এমন এক জায়গায় ভ্যালি অব কিংসে রাখে যেন ভবিষ্যতে কারও চোখে না পড়ে। আর পড়লেও তাদের পক্ষে যেন এটা ধরা সম্ভব না হয় এই ফারাও একজন মহিলা। তাই সব জায়গায় লিখে রাখা হয় তিনি একজন পুরুষ। তবু ইতিহাসে নেফারতিতি সৌন্দর্য আর রহস্যের রানী হিসেবেই স্বীকৃত।  তার অদ্ভুত মায়াজাল ছিন্ন করে এমন সাধ্য কার আছে?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর