রাশিয়ায় শীতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে পশুপাখিও
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় ভয়াবহ তুষারপাতের সাক্ষী হয়েছে বসবাসকারী মানুষ, এমনকি পশু-পাখিও। পান্ডা, খেঁকশিয়ালসহ অন্যসব প্রাণীও শীত থেকে বাঁচতে যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশের অধিকাংশ শহর শুভ্র তুষার বৃষ্টিতে ঢেকে গেছে। বন, মূর্তি, স্থাপনা, সাদা তুষারে আবৃত সেগুলোর বেশির ভাগই। বিপর্যয়ে আছে প্রধান রাস্তাঘাট। যানবাহন চলাচলেও ব্যাপক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সেখানে। বারবার বরফ সরানোর ব্যবস্থা করা হলেও জনজীবনের স্বাভাবিক যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ঘরবন্দি জীবন কাটছে কিছু অঞ্চলের বাসিন্দাদের।
পাকিস্তানে প্রবল তুষারপাতে বিপর্যয়
ইসলামাবাদ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে মুরি শহর। এ বছর দেশটির মুরি শহরে ঘুরতে গিয়ে তুষারপাতে আটকা পড়েন কয়েক হাজার পর্যটক। গাড়িসহ বরফের নিচে আটকে যান। সেখানে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। রাস্তায় বরফ জমে ৪ ফুট। সেই ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়। পরে সেনাবাহিনী সেখানকার রাস্তা পরিষ্কার করে, গাড়িতে আটকা পড়াদের উদ্ধার করে। পাকিস্তানের একাধিক শৈলশহরে চলতি বছরে প্রবল তুষারপাত লক্ষ্য করা যায়।
জনজীবন বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রে
তুষারপাত ও ঠান্ডা বাতাসে ভয়াবহ অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে। তুষারপাতের সঙ্গে আছে প্রচ- বাতাস। বরফে ঢেকে আছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। কোথাও কোথাও আটকে আছে গাড়ি। কেন্টাকি ও নাশভিলে শহরের অবস্থাও ভয়াবহ। বরফময় হয়ে আছে সবকিছু। সাদা বরফে ঢেকে আছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন। এতে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ৩ থেকে ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বরফের স্তর জমে গেছে। পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করায় যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। তীব্র শীতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পড়া তুষারে ৫ থেকে ১০ ইঞ্চি পুরু আস্তরণ হয়েছে। এতে মাইলের পর মাইল মহাসড়কে আটকা পড়েছেন মার্কিনিরা। ভার্জিনিয়া থেকে নিউইয়র্কগামী ট্রেন আটকা পড়ে যায়। নিউইয়র্কসহ পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে দেড় ফুটেরও বেশি বরফের স্তরে ঢেকে যেতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছিলেন। রাস্তায় যানবাহন আটকে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস বন্ধসহ অনেক বিমানের সময়সূচি বাতিল করা হয়। তুষারপাতের সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা বাতাস বাফেলোর অধিকাংশ বাসিন্দাকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে। এখন পর্যন্ত মহাসড়কগুলোয় কয়েক শ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সতর্কতায় জানানো হয়, নিউইয়র্ক এবং এর আশপাশের এলাকায় বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বরফ পড়ল সৌদিতে
মরুভূমির বুকেও এ বছর বরফ পড়ছে। সৌদি আরবের তাবুক অঞ্চলে শুরু হয় তুষারপাত। তুষারের সাদা চাদরে ঢাকা পড়ে যায় পর্বতগুলো। সৌদি নাগরিকরা এ তুষারপাত নেচে-গেয়ে উদযাপন করেন। তুষারপাত দেখতে তাবুক অঞ্চলে আসেন পর্যটকরা। তাবুক বাদেও দেশটির অন্যান্য অঞ্চলেও এ বছর তুষারপাত হচ্ছে। মরুভূমিতে বরফের মধ্যে উটে চড়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি শেয়ার করছেন। দেখা যায়, জাবাল আল-লাজ, জাবাল আল-তাহির এবং জাবাল আল-কান পর্বতগুলো সম্পূর্ণ বরফের চাদরে ঢাকা।
বরফ, বৃষ্টিতে নাকাল আফগানিস্তান
ভারী তুষারপাত ও প্রচন্ড বাতাসের কারণে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের সঙ্গে উত্তরের প্রদেশগুলোকে যুক্ত করা সালাং বিশ্বরোডটি বন্ধ হয়ে যায়। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ৩২টি প্রদেশে বৃষ্টি ও তুষারপাত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন বাসিন্দারা। অনেক রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যা ও অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তুষারপাতের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সচল করতে সহায়তা চেয়েছে দেশটির সরকার।
জাপানে রেকর্ড তুষারপাত
সাধারণত বছরে দুবার তুষারপাতের আশঙ্কা থাকলেও এ বছর যেন হিসাব অনেকটাই পাল্টে গেছে জাপানে। জাপানের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল এক দিনে রেকর্ড তুষারপাত হয়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। কয়েক ফুট উঁচু বরফের আস্তরণে বন্ধ হয়ে গেছে মহাসড়ক, বাতিল করতে হয়েছে ফ্লাইট। জাপানের নিগাতা ও গুনমা জেলায় তিন দিন ভারী তুষারপাত হয়। ফলে প্রায় ১০ হাজার পরিবার বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জরুরি বৈঠকের ডাক দেন। চার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো টোকিও এবং আশপাশের এলাকায় ভারী তুষারপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। টানা সাত দিনের নিম্নচাপ এবং কম তাপমাত্রার কারণে সেখানে তীব্র ঠান্ডা পড়তে শুরু করে। এর পরই শুরু হয় তুষারপাত। দেশটির আবহাওয়া বিভাগ বলছে, তাপমাত্রা কমা অব্যাহত থাকবে। ভারী তুষারপাতের কারণে জাপানে শতাধিক অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
তুষারপাতের সৌন্দর্য ভারতে
জম্মু-কাশ্মীরে ভারী তুষারপাতে ঢাকা পড়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। কাশ্মীর ৪ ফুট বরফে ঢেকে গেছে। শ্রীনগরেও তুষারপাত হয়েছে। গুলমার্গে রাতের বেলায় তাপমাত্রা মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেছে। সিমলাতে ঘুরতে গিয়ে পর্যটকরা ঘুম থেকে জেগে দেখতে পান তুষারপাত। দার্জিলিংয়ের তাপমাত্রা রয়েছে ৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সান্দাকফুতেও হয়েছে তুষারপাত। উত্তর সিকিমের লাচুং, লাচেংয়ের মতো বিভিন্ন এলাকা ঢেকেছে বরফের চাদরে। রাজস্থানের চুরুতে তাপমাত্রা নেমেছে মাইনাস ৫ ডিগ্রিতে। লাদাখে হয়েছে প্রবল তুষারপাত। উত্তরাখন্ডের যমুনোত্রী ধামে যমুনা নদীর পানি জমে বরফ।
চীনের নানা জায়গায় তুষারপাত
দক্ষিণ চীনের নানা জায়গায় তুষারপাত হয়েছে। চেচিয়াং, ইউনান, চিয়াংসি ও হুপেইসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশে ভারী তুষারপাত হয়। লিয়াওনিং প্রদেশের রাজধানী শেনইয়াংয়ে গড় তুষারপাত হয় ৫১ সেন্টিমিটার বা ২০ ইঞ্চি। পাশের ইনার মঙ্গোলিয়ায় ভারী তুষার ঝড় হয়েছে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে উত্তর-পূর্ব চীনের কিছু অংশে তাপমাত্রা কমপক্ষে ১৪ ডিগ্রি কমে যায়।
মরক্কোর পাহাড়ে বরফ
তুষার জমে জীবনযাত্রা বদলে গেছে মরক্কোর পাহাড়চূড়ায় থাকা গ্রামবাসীর। সেখানে বরফের ওপরে কাপড় শুকাতে দিচ্ছেন অনেকে। কারণ আকাশে ঝলমলে রোদ। রুটি ভাজতে গিয়ে আগুন পোহাচ্ছে মানুষজন। বরফ-রাজ্যে কষ্টে আছে গৃহপালিত পশু-পাখি। তাদের খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে পানি না থাকায় বৃষ্টির জন্য আকাশে চোখ রাখছেন কৃষকরা। সামর্থ্যবানরা সোলার বিদ্যুৎ ব্যবহার করে রুম হিটার থেকে উত্তাপ নিচ্ছেন।
ভুটানে বরফের চাদর
তুষারপাত হয়েছে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতেও। বরফের চাদরে দোকানপাট, গাড়ি, হোটেল ঢেকে গেছে সেখানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই দৃশ্য দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ৭০০ ফ্লাইট বাতিল
শীতকালীন ঝড়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ২ হাজার ৭০০-এর বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। দেশটির পূর্ব উপকূলে তীব্র বাতাস ও বরফের সমন্বয়ে শীতকালীন ঝড়ের আঘাতের আশঙ্কায় গত রবিবার এসব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এক দিনেই এয়ারলাইনসটি তাদের ছয় শতাধিক ফ্লাইট বাতিল করে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ, বহির্গমন এবং অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও রয়েছে। এ ছাড়া দেড় হাজারের বেশি ফ্লাইট নির্ধারিত শিডিউলের চেয়ে বিলম্বে যাত্রা শুরু করেছে বলেও পরিসংখ্যানে দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ফ্লাইট বাতিল করা এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে আমেরিকান এয়ারলাইনস। নর্থ ক্যারোলিনার শার্লোট ডগলাস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি আমেরিকান এয়ারলাইনসের অন্যতম কেন্দ্র বলে পরিচিত। গত রবিবার এই বিমানবন্দরের নির্ধারিত প্রায় ৯৫ শতাংশ ফ্লাইটই বাতিল হয়ে গেছে। ওই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের বিমানবন্দরে আসার আগে এয়ারলাইনসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। শীতকালীন এই ঝড়ের সময় ক্যারোলিনা অঞ্চলে সর্বোচ্চ তুষারপাতের আশঙ্কা করছে দেশটির আবহাওয়া দফতর।
কানাডায় বিদ্যুৎহীন লাখো মানুষ
কানাডায় আঘাত হেনেছে তুষার ঝড়। ভারী তুষারপাতের কারণে সেখানে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। কানাডার অন্টারিও প্রদেশের দক্ষিণের বেশির ভাগ অংশে ঝড়ের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কানাডার বৃহত্তম শহর টরেন্টোতে সাত ইঞ্চি তুষারপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সতর্কবার্তায় জানানো হয়েছে, তুষারপাত ও বরফের কারণে ভ্রমণ করা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সংকট ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তুষার ঝড়ে নাকাল বড় শহরগুলোর বাইরের দৃশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই দিন না রাত। তাপমাত্রা কমতে থাকায় বিপর্যস্ত কানাডার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন। বেশ কয়েকটি অঞ্চলে তাপমাত্রা সর্বনিম্ন মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছে দেশটির আবহাওয়া বিভাগ। তাই প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঝড়ো হাওয়া ও বাতাসের কারণে ঘরবন্দি জীবন কাটছে অনেকের।
ছয় মাস দিন ছয় মাস রাত
উত্তর মেরুর বিস্ময়
পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরতম বিন্দু উত্তর মেরু। আর্কটিক বরফ অঞ্চল। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের এই বিন্দুতে এর ঘূর্ণন অক্ষ পৃষ্ঠতলের সঙ্গে মিলেছে। বরফের স্রোত কখনই স্থির রাখে না উত্তর মেরুকে। বরফের ওপর উত্তর মেরুর বিন্দুটি নির্দেশ করলেও, এর নিচে কোনো মাটি নেই। রয়েছে সমুদ্র। এ ছাড়া কৌণিক অবস্থানের কারণে অন্তত দুটি উত্তর মেরু ধরে হিসাব করা হয়। একটিকে বলা হয় নর্থ পোল অন্যটিকে ডিপ নর্থ পোল। এ ছাড়া উত্তর মেরু বলতে অনেকে আবার উত্তর চৌম্বক মেরুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। আর্কটিক মহাসাগরের বুকের মাঝখানে এই উত্তর মেরু ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় জমে থাকে সারা বছর। পৃথিবীর ৯০ ডিগ্রি অক্ষাংশ উত্তর মেরু, তাই একেবারেই ভিন্ন পরিবেশ এখানে। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোয় বছরজুড়ে দিন-রাতের যে হিসাব তার কিছুই নেই এখানে। এখানে গ্রীষ্মকাল আর শীতকাল ছাড়া আর কোনো প্রধান ঋতু নেই। উত্তর মেরুতে গ্রীষ্মকাল থাকে ১৮৭ দিন। এ সময় ২৪ ঘণ্টাই সূর্য থাকে আকাশে। এ সময় দিন থাকে একটানা। শীতকালের ব্যাপ্তি ১৭৮ দিন। এ সময় একটানা রাত থাকে এখানে।
নেই কোনো টাইমজোন
অবিশ্বাস্য শোনালেও এটা সত্যি যে, উত্তর মেরুতে কোনো ঘড়ির সময় ধরা হয় না। নির্দিষ্ট টাইমজোন না থাকায় এমনটি ঘটে। সময় বোঝাতে তাই পছন্দমতো একটি টাইমজোন ধরে নিতে হয়। যারাই এই বিন্দুতে পৌঁছান তারা তাদের দেশ বা যেখান থেকে এসেছেন সে স্থানের সময় ধরে উত্তর মেরুর সময় নির্ধারণ করে নেন। কেন এমন হয়? সহজ করে বললে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সময় নির্ধারণের জন্য যে অক্ষাংশ মেনে হিসাব করা হয় তার কেন্দ্রবিন্দু উত্তর মেরুতে। পৃথিবী ঘূর্ণন, কৌণিক অবস্থান মাটির সঙ্গে ঠিক ৯০ ডিগ্রি ধরা হয় এখানে। এই কৌণিক অবস্থানের কারণে উত্তর মেরুতে দিনরাতের হিসাবে প্রায় ৬ মাস টানা দিন আর রাত হয়। বছরে একবার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয় এখানে। সময় নির্ধারণের জন্য ঘড়ির কাজ এখানে অকেজো। স্বাভাবিকভাবে সন্ধ্যার পর সূর্য অস্ত যাওয়ার কথা হলেও উত্তর মেরুতে সূর্য ডোবে না। তবে কখনই মাথার ওপরে সূর্য পৌঁছায় না। গ্রীষ্মকালের টানা প্রায় ছয় মাসের দিন শেষে যখন শীতকাল আসে তখন উল্টো ঘটনা ঘটে। প্রায় ছয় মাস সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। এ সময় উত্তর মেরু ঢেকে থাকে আঁধারে। রাতে কখনো কখনো হালকা আভা দেখা গেলেও রাত কাটে না প্রায় ৬ মাস। এ সময় মাইনাস ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, ভয়াবহ ঠান্ডায় ডুবে থাকে উত্তর মেরু। গতকাল উত্তর মেরুতে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস
আর্কটিকের বরফের ছোট-বড় দ্বীপগুলো ভেসে চলে গ্রীষ্মে। আর শীতে এসে জমে দাঁড়িয়ে যায়। দুই ঋতুর উত্তর মেরুতে প্রায় ছয় মাসের গরম আর ঠান্ডা আবহাওয়া বলা হলেও, এখানকার গরমতম দিনেও তাপমাত্রা থাকে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। বরফ জমে থাকা এই গ্রীষ্মের দিনে ছয় মাস সূর্যের দেখা পাওয়া যায়। শীতকাল এলে রাতের আঁধার নেমে আসে ছয় মাসের জন্য।
যদিও ঠিক হিসাবটি ভিন্ন। শীতকাল থাকছে নয় মাস আর বাকি তিন মাস গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্ম কি শীত, সব সময়ই অবিশ্বাস্য ঠান্ডায় মোড়ানো থাকে উত্তর মেরু। শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ থেকে শুরু করে মাইনাস ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই সে সময়ের পরিবেশের চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়া সব প্রচেষ্টাকেই বাধাগ্রস্ত করেছে। শীতকালে তুষারঝড়ের কবলে উত্তর মেরুর পরিবেশ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। গ্রীষ্ম ও শীত ছাড়াও আরও দুটি ঋতু উত্তর মেরুতে খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। শরৎ ও বসন্ত। তবে এই দুটি ঋতুর ব্যাপ্তিকাল কয়েক সপ্তাহ মাত্র। শীতকালে আকাশ থাকে পরিষ্কার। সমুদ্র বরফ হয়ে জমে আছে, তাই বাষ্প নেই, নেই মেঘ, নেই বৃষ্টি। গ্রীষ্ম আসার আগে তুষারঝড় বয়ে যায় উত্তর মেরুতে। শীতে উত্তর মেরুতে যতটা না ঠান্ডা, তার চেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ে আশপাশের এলাকায় (সাইবেরিয়ায়)।
এস্কিমোদের অবাক জীবন
বরফের দেশ বললে উত্তর গোলার্ধের উত্তর আলাস্কা, কানাডা এবং সাইবেরিয়ায় অবস্থিত আর্কটিক তুন্দ্রা অঞ্চলের কথা আসে। ইনুইট জাতির বসবাস এখানে। বরফে ঢাকা পুরো অঞ্চল। মাটি বলে কিছু নেই। বরফের নিচে বইছে সমুদ্র। সারা বছরই এই অঞ্চল ঢাকা থাকে বরফে। তাই চলাচল খুবই বিপজ্জনক। এই বরফ এলাকায় এখনো যোগাযোগের অন্যতম বাহন হলো নৌকা এবং কুকুরের গাড়ি বা স্লেজ। এ গাড়িকে তারা বলে কামুতিক। কুকুরের গাড়ি, এমন এক ধরনের গাড়ি যা বরফের ওপর দিয়ে টেনে নিলেই চলে। ইঞ্জিনের এই যুগে, মোটরগাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজপথে। সেখানে স্লেজ গাড়ি, কোনো তেল লাগে না, গ্যাস লাগে না। এর কোনো ইঞ্জিন নেই। এমনকি নেই কোনো চাকা। পশুর চামড়া, শক্ত হাড় এসব সাধারণ জিনিস দিয়েই তারা তৈরি করে একেকটি গাড়ি। এই গাড়িকে জুড়ে দেয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরের গলায়। আমাদের দেশের ঘোড়ার গাড়ির মতো তারা কুকুরের গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ায় বরফের দেশে। তাদের এই কুকুর কিন্তু যে সে কুকুর নয়। কুকুরগুলো বেশ শক্তিশালী। সাধারণ কুকুরের চেয়ে অনেক বেশি ঘন এবং পুরু এদের গায়ের লোম। নিজেদের প্রয়োজনে ইনুইটরা বাড়িতে এই কুকুর পোষে। এরা নদীতে শিকারে যায় ছোট নৌকায় চড়ে। নাম কায়াক। মালামাল পরিবহন, লোক আনা-নেওয়া এবং অন্যসব জিনিস পরিবহনে এরা বড় নৌকা ব্যবহার করে, যাকে ‘উমিয়াক’ বলে। উমিয়াক লম্বায় প্রায় ছয় থেকে ১২ মিটার। বিশেষ এই নৌকার তলদেশ সমান। ফলে নদী তীরের খুব কাছাকাছি ভিড়তে পারে সহজেই।
উত্তর মেরুতে জীবন অনেক কঠিন। গাছপালা না থাকায় নেই কাঠ। যে সামান্য পরিমাণ কাঠ এস্কিমো বা ইনুইটরা জোগাড় করে সেসব জ্বালানি হিসেবেই কাজে লাগায়। বাড়ি বানাতে যে কাঠের দরকার তা আর জোগাড় হয় না। তাই বাধ্য হয়ে বরফই হলো তাদের বাড়ি তৈরির জন্য সবচেয়ে ভালো উপাদান। প্রচ- শীতে শক্ত বরফের খন্ড দিয়ে তারা তৈরি করে বিশেষ এক ধরনের ঘর। একে বলা হয় ‘ইগলু’। ছোট ছোট ফাঁকফোকরে ছোট ছোট বরফের টুকরা ঢুকিয়ে তৈরি করা হয় এই বাড়ি। টুকরাগুলো টালির ফাঁকে ফাঁকে জমে হাওয়া ঢোকার পথ বন্ধ করে দেয়। আর জানালা তৈরি করে একখন্ড স্বচ্ছ বরফের টুকরা দিয়ে। ইগলুতে ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। চার-পাঁচ হাত লম্বা একটা সুড়ঙ্গপথ পেরিয়ে তবেই পাওয়া যায় ইগলুর দরজা। সাধারণত ইগলুর উচ্চতা পাঁচ থেকে ছয় ফুট। বাড়ির ভিতর সব সময় জ্বলতে থাকে পাথরের তৈরি প্রদীপ। প্রদীপের সলতে তৈরি করা হয় সমুদ্রের শেওলা দিয়ে। আর প্রদীপ জ্বলে সিলের তেলে। বরফের বাড়ির ভিতরে ইনুইটদের মেলে কিছুটা উষ্ণতা আর হিংস্র প্রাণীদের আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা। ভয়ঙ্কর তুষারঝড়ে এই বাড়ি তাদের প্রাণ বাঁচায়। অবশ্য বছরের অর্ধেক সময় পেরোতে না পেরোতে এই বাড়ি গলে যায়। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লে বরফ গলে নদীতে চলে যায় ইগলু বাড়ি। তখন তাদের বাইরে খোলা মাঠে তাঁবু টানিয়ে বসবাস করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। যেনতেনভাবে তৈরি একটা ফ্রেমের ওপর পশুর চামড়া দিয়ে ঢেকে তারা তৈরি করে এই তাঁবু।
খাবার কাঁচা মাংস আর মাছ
বরফের দেশে কোনো গাছ নেই, তাই শিকার করেই খাবার জোগাড় করতে হয় তাদের। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী তিমি, সিল, পেঙ্গুইন, পাখি, পাখির ডিম, বরফ অঞ্চলের খরগোশ, মেরু ভালুক ও মাছ তাদের প্রধান খাদ্য। সামুদ্রিক উদ্ভিদ, হার্ব জাতীয় ঘাস, ঘাসের শিকড়, বেরি জাতীয় ফল দূর থেকে সংগ্রহ করে তারা। পশু আর মাছের তেল ব্যবহার করে আগুন জ্বালায়। হিংস্র প্রাণী তীর-বর্শা দিয়ে শিকার করে। তিমি ও সিল শিকারে তারা সিদ্ধহস্ত। এস্কিমোরা শীতের সময় খাওয়ার জন্য খাবার সংরক্ষণ করে। গ্রীষ্মকালে মাছ ও মাংস শুকিয়ে নেয়। এ সময় তারা থাকে চামড়ার তৈরি ‘টুপিক’ নামক তাঁবুতে। সাদা বরফে ঢাকা নদীর বুকে ওতপেতে অপেক্ষা করে একটি গর্তের কাছে। এই গর্ত থেকে মুখ বের করে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় সিল, তখনই তারা সেটাকে শিকার করে। এই কৌশল সেখানকার শ্বেত ভালুকরাও অবলম্বন করে। এ ছাড়া তারা শিকার করে ওলরুস, ক্যারিব্যু। এসব প্রাণীর মাংস তারা কখনো সিদ্ধ করে আবার কখনো কাঁচাই খেয়ে থাকে। প্রচন্ড ঠান্ডা থাকায় তারা দীর্ঘদিন খাবার সঞ্চয় করে রাখতে পারে। উত্তর মেরুতে খাবারের ভয়াবহ সংকট। বরফের নিচে থাকা মাছ ধরে সাময়িক ক্ষুধা মেটালেও দিন দিন তাদের খাবার সংকট চরম আকার ধারণ করছে। ঘাস জাতীয় খাবার চিবিয়ে তারা কাটিয়ে দেয় দিনের পর দিন। সারা পৃথিবীর মানুষ যখন ফ্যাট জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলছে, তখন ইনুইট জাতির মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছে ফ্যাট জাতীয় খাবার, কাঁচা মাংস- যা এক বিস্ময়। তারা কখনো একা খাবার খায় না। যে বা যারাই শিকার বা খাবার জোগাড় করে সবাই ভাগ করে খায়। বরফ গলিয়ে পানি নয়তো সিলের গরম রক্ত। আর কিছু নেই পানীয় বলতে।