রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অদ্ভুতুড়ে অভিশাপ

রণক ইকরাম

অদ্ভুতুড়ে অভিশাপ

পোর্ট্রেট অব দ্য ক্রাইং বয়

কখনো কখনো নিরপরাধ কোনো কিছুও হয়ে উঠতে পারে অভিশাপ কিংবা ভয়ংকর কোনো কিছুর কারণ। আবার সেই ভয়ংকর ঘটনা বা অভিশাপ অতি সাধারণ একটি জিনিসকেও রাতারাতি নিয়ে আসতে পারে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে। আর এটিকে পরিণত করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত এবং অভিশপ্ত পেইন্টিং হিসেবে।

১৯৮৮ সালের ঘটনা। ঘটনাস্থল ইংল্যান্ডের হ্যাসোয়েল। ওখানকার এমোস পরিবারের বাড়িটিতে হঠাৎ করেই এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। রহস্যময় এই অগ্নিকান্ডে বাড়িটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণ করার আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সাজানো-গোছানো বাড়িটি। এরপরও ফায়ার ব্রিগেড আর উদ্ধারকর্মীরা যখন আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ সরাতে শুরু করেন, তখন তারা একটি ফ্রেমে বাঁধানো পোট্রেটের সন্ধান পান। এই পোট্রেটটি ছিল ক্রন্দনরত একটি বালকের।

বালকটি ছিল খুব সুন্দর, যার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। স্বভাবতই শিশুটির চেহারা ছিল বিষণœ। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- আগুনের দোর্দ- প্রতাপে বাড়ির সবকিছু যেখানে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, সেখানে এই পোট্রেটটি একেবারেই অক্ষত অবস্থায় পড়েছিল। আশপাশের সব পুড়ে যাওয়া জঞ্জাল দেখে মনে হয়, এই ছবিটিও পুড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ছবিটি অক্ষত রয়ে যায়। তখনই উদ্ধারকর্মীরা ভড়কে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেবারের ঘটনা ওই অবাক হয়ে যাওয়া পর্যন্তই। কে জানত এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক নাটকের তখনো বাকি ছিল?

এরপর আরও একবার বিস্ময়ের জন্ম দেয় এই পোট্রেট। এবারের ঘটনাটি ঘটে ব্র্যাডফোর্ডে। এবারের ঘটনাটিও অগ্নিকান্ডের।

সেখানে এক অগ্নিকান্ডের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে আবারও এক ক্রন্দনরত ছেলের ছবি পাওয়া যায়। যথারীতি এবারও ছবিটি ছিল ধ্বংস্তূপের মাঝখানে একেবারেই অক্ষত। এবারের ঘটনাটি ফলাও করে ছাপা হয় ওখানকার সব পত্রিকায়। সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য জেঁকে ধরে ইয়র্কশায়ারের তৎকালীন ফায়ার ব্রিগেড প্রধানকে। প্রথমে মন্তব্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানালেও পরবর্তীতে তিনি একটি বিবৃতি প্রদান করেন। সেই বিবৃতিতে তিনি বলেন, পর পর বেশ কয়েকটি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে একই ধরনের ছবি অক্ষত অবস্থায় পেয়েছেন দমকল কর্মীরা। এই স্বীকারোক্তির পর সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল ছবিটি রহস্যময় কিংবা অশুভ কি-না। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। ১৯৯৮ সালে ডাবলিনে এক বাড়িতে অগ্নিকান্ড হয়। আর সেখানেও এই একই ছবি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

সমস্যা হলো- এই অভিশপ্ত ছবির ছেলেটির পরিচয় কিংবা ছবিটি কে এঁকেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছুই জানা যাচ্ছিল না। ডাবলিনের ঘটনার ৩ বছর আগে ১৯৯৫ সালে ডেভন শহরের একজন স্কুলশিক্ষক যিনি একই সঙ্গে প্রখ্যাত ও সম্মানিত একজন গবেষক, জর্জ ম্যালোরি দাবি করেন, তিনি অবশেষে ছবিটি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তিনি জানান, একজন বৃদ্ধ স্পেনিশ পোস্টকার্ড শিল্পী ফ্র্যাঙ্কট সেভিল এই ছবিটি এঁকেছিলেন। এ শিল্পী থাকতেন মাদ্রিদে। ১৯৬৯ সালে শিল্পীটি মাদ্রিদের রাস্তায় ছবির ছোট ছেলেটিকে ঘুরে বেড়াতে দেখতে পান। ছেলেটি কখনো কথা বলত না, তার চোখে থাকত রাজ্যের বিষণœতা। সেভিল এই ছেলেটির ছবি আঁকেন। এক পাদ্রী ছেলেটিকে চিনতে পারেন।

তিনি বলেন, এই ছেলেটির নাম ডন বনিলো, যে কি না নিজের চোখে তার বাবা-মাকে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখে। পাদ্রীটি আরও বলেন, ছেলেটিকে এক জায়গায় বেশি দিন যেন থাকতে না দেওয়া হয়। কারণ যেখানেই সে কিছু দিন অবস্থান করে সেখানে রহস্যময়ভাবে আগুন লেগে যায়।  যে কারণে গ্রামবাসী ছেলেটিকে পিশাচ নামে সম্বোধন করত।

তবে পিশাচ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর ছেলেটিকে এক জায়গায় খুব বেশি দিন দেখা যেত না।

আর যেখানেই ছেলেটিকে দেখা যেত সেখানেই কোনো না কোনো অগ্নিকান্ড ঘটত।  ছেলেটির পরিচয় সম্পর্কে ধারণা করা গেলেও ইউরোপজুড়ে অগ্নিকান্ড আর তার সঙ্গে অশুভ এই ছবি উদ্ধারের কোনো ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

 

 

টাইটানিক রহস্য

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজের নাম টাইটানিক। কোনো দিনও ডুববে না দাবি করেছিল টাইটানিক। কিন্তু ১৯১২ সালে প্রথম বিহারেই ১৫০০ যাত্রী নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায় বিলাসবহুল টাইটানিক। এরপর শুরু হয় ডুবে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান। প্রাথমিকভাবে এবং সর্বাধিক মতানুসারে আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা লাগার ফলেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু এর বাইরেও অনেক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কাহিনিটি জানায় ১৯৯৮ সালের ১৯ অক্টোবরে টাইমস। সে অনুসারে টাইটানিক জাহাজে নাকি ছিল মিসরীয় এক রাজকুমারীর অভিশপ্ত মমি।

বলা হয়, মমির অভিশাপের কারণেই ভাসমান বরফদ্বীপের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল টাইটানিক। গল্পটি বহু বছর প্রচারিত হলেও নতুন করে আলোচনায় আসে অস্কারজয়ী টাইটানিক ছবিটির ব্যাপক জনপ্রিয়তার পর। গল্পানুসারে অভিশপ্ত সেই রাজকুমারীর নাম ছিল আমেন-রা। তার মৃত্যু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে। ১৮৯০ সালের শেষার্ধে এক ধনী ইংরেজ লুক্সরের কাছে এক প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ দেখতে যান। তিনি সেখান থেকে কফিনশুদ্ধ রাজকুমারীর এই মমিটি ক্রয় করেন। মমিটিকে জাহাজে করে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেও পরবর্তীতে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর তাকে আর কোনো দিন দেখা যায়নি। লোকটির সঙ্গী ছিলেন তিনজন। মমির অভিশাপ তাদেরও রেহাই দেয়নি। একজন কিছু দিন পরই মারা যান, দুর্ঘটনায় একজনের হাত কাটা পড়ে। অন্যদিকে আরেকজন দেউলিয়া হয়ে যান। এর মধ্যেই কফিনটি ইংল্যান্ডে পৌঁছে যায়। একজন ব্যবসায়ী তা কিনেও নেন। বাদ যাননি তিনিও। সেই ব্যবসায়ীর পরিবারের তিনজন মোটর দুর্ঘটনায় আহত হন এবং তার বাড়িতে আগুন লাগে। মমিটিকে অভিশপ্ত মনে করে সেই ব্যক্তি এটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দান করে দেন। মিউজিয়াম এটিকে সাদরে গ্রহণ করলেও সেখানেও শুরু হলো রহস্যময় ঘটনা। মিউজিয়ামের কর্মচারীরা রাতের বেলা কফিনের ভিতর থেকে তীব্র কান্নার শব্দ শুনতে পেতেন। সকালবেলা প্রদর্শনী কক্ষের জিনিসপত্রগুলো সব এলোমেলোভাবে পড়ে থাকতে দেখা গেল। এরই মধ্যে মারা গেল এক প্রহরী। এসব জানতে পেরে এক ফটোগ্রাফার কফিনের ছবি তুললেন। কিন্তু ছবি ডেভেলপ করার পর তিনি কী দেখেছিলেন কে জানে? শেষমেশ আত্মহত্যা করেছিলেন সেই ফটোগ্রাফার। ব্রিটিশ মিউজিয়ামও আর এসব সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু মমিটির কুখ্যাতি এতটাই ছড়িয়েছিল যে, এ থেকে তারা খুব সহজে মুক্তি পায়নি। অবশেষে একজন আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ সবকিছুকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়ে কিনে নিলেন মমিটি আর টাইটানিকে চড়িয়ে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।  আর এরপরের ঘটনা তো সবারই জানা। গল্পটি নিয়ে মানুষের মনে অনেক সন্দেহ আর দ্বিধা থাকলেও বছরের পর বছর ধরে এটি মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হয়ে আসছে।

 

তুতেন-খামেনের মমি

১৯২২ সালে ভ্যালি অব দ্য কিংস এ হাওয়ার্ড কার্টারের নেতৃত্বে একদল খননকারী আবিষ্কার করলেন তুতেন খামেন নামক এক ফারাওয়ের মমি। তুতেন খামেন খুবই অপরিচিত ফারাও রাজা ছিলেন বলে চোর-ডাকাতরা তার সমাধি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাই হয়তো করেনি। এ কারণেই আধুনিক বিশ্বের আবিষ্কৃত একমাত্র অক্ষত সমাধিই হলো তুতেন খামেনের সমাধি। প্রাচীন মিসরের ফারাও তুতেন খামেনের অভিশাপে অনেকের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। যারাই তার পিরামিডে ধন-সম্পদের লোভে গেছে তাদের জীবনে নেমে এসেছে অভিশাপের থাবা। ঘটেছে করুণ ঘটনা। এ এক রহস্য। কারনাভানের অর্থায়নে হাওয়ার্ড কার্টারের মমি আবিষ্কারের পেছনে একটি হলুদ ক্যানারি পাখির অবদান ছিল। ইংরেজিতে ‘ক্যানারি’র একটি অপ্রচলিত অর্থ হলো গুপ্তচর। এই পাখিটি তাদের গুপ্তধন পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছিল। আর মমির অভিশাপের বিষয়টিও তাই হলুদ ক্যানারি পাখিকে দিয়েই শুরু হলো। যেদিন অভিযাত্রী দল প্রথম তুতেন খামেনের মমি আবিষ্কার করল, সেদিনই শুরু হলো অদ্ভুত আর রহস্যময় কাণ্ড-কারখানা। সেদিন রাতেই হাওয়ার্ড কার্টার তার বাসায় ফিরে এসে কাজের লোকের হাতে কয়েকটি হলুদ পালক দেখতে পান। সেই পালকগুলো ছিল গুপ্তচর ক্যানারি পাখির। ভয়ে আতঙ্কিত কাজের লোকটির কাছে হাওয়ার্ড জানতে পারেন, একটি কোবরা তার ক্যানারি পাখিটিকে খেয়ে ফেলেছে। পরের শিকার লর্ড কারনাভান। যিনি এই খননকার্যে অর্থায়ন করেছিলেন। তিনি জানতেন ফারাওদের অভিশাপের কথা। কিন্তু বিশ্বাস করতেন না। তুতেন খামেনের সমাধিতে প্রবেশ করার অল্প দিনের মধ্যে মারা গেলেন কারনাভান। কায়রোর একটি হোটেলে তার মৃত্যু ঘটে। বলা হয়েছিল, একটি মশার কামড়েই নাকি তার মৃত্যু ঘটে। অভিশাপের ব্যাপারটি নিয়ে হৈ হৈ পড়ে গেল। লর্ড কারনাভানের মৃত্যুর দুই দিন পর খামেনের মমিকৃত দেহটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, মমিটির বাম গালে কারনাভানের মতো ঠিক একই জায়গায় একটি ক্ষত রয়েছে। তুতেন খামেনের মমির অভিশাপের গল্প যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, তখন অনেক নামিদামি ব্যক্তি অভিশাপের অস্তিত্বের পক্ষে তাদের মতপ্রকাশ করলেন। এদের অন্যতম হলেন স্যার আর্থার কোনান ডায়েল।

এর মধ্যেই লর্ড কারনাভানের মৃত্যুর পর আরও অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে লাগল। যারা মমির অভিশাপ বিশ্বাস করত, তাদের ধারণা মমির অভিশাপেই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একের পর এক মানুষের জীবনাবসান হচ্ছে। লর্ড কারনাভানের মৃত্যুর কিছুদিন পর এ অভিযানের আরেক নেতৃস্থানীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ আর্থার ম্যাক একই হোটেল কন্টিনেন্টালে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করতে থাকেন। প্রথমে বিষয়টিকে কেউ আমলে নেয়নি। বরং অভিযাত্রী দলের ডাক্তার এবং স্থানীয় ডাক্তারকে হতবুদ্ধি করে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি। কারনাভানের এক বন্ধু তার মৃত্যুর কথা জানতে পেরে মিসরে যান সমাধি দেখতে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, সমাধিটি দেখার পরদিনই তিনি প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হলেন। আর এর মাত্র বারো ঘণ্টার মধ্যে তারও মৃত্যু হয়। তখন অনেকেই তুতেন খামেনের সমাধির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এমনই এক আগ্রহী ব্যক্তির নাম জুয়েল উড। তিনি একজন শিল্পপতি ছিলেন। সমাধিটি ভ্রমণ করে দেশে যাওয়ার পথে জুয়েলও আক্রান্ত হন প্রচণ্ড জ্বরে। এরপর তারও মৃত্যু হয়। ডাক্তাররা তার এমন জ্বর ও মৃত্যুর কোনো সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি। আর্কিবাড রিড নামক এক রেডিওলজিস্ট তৎকালীন সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তুতেন খামেনের এক্স-রে রিপোর্ট করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তুতেন খামেনের বয়স এবং মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানা। কিন্তু এই কাজ পুরোপুরি শেষ করার আগেই প্রচণ্ড ক্লান্ত এই অভিযোগে ইংল্যান্ডে ফিরে যান রিড। কিন্তু ইংল্যান্ডে অবতরণের কিছুক্ষণ পরই রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। সমাধিটি আবিষ্কারের চার মাস পর কারনাভানের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি রিচার্ড ব্যাথেলকে তার বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আর ব্যাথেলের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তার পিতা আত্মহত্যা করেন। সমাধিটি উন্মোচনের সময় কয়েকজন লোক উপস্থিত ছিলেন, তার মধ্যে ১২ জনই অস্বাভাবিকভাবে পরবর্তী ছয় বছরের মধ্যে মারা যান।  পরবর্তীতে ধীরে ধীরে খনি খননের কাজে বিভিন্নভাবে জড়িত প্রায় ২১ জনই মৃত্যুবরণ করে। একজনই কেবল রক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি প্রত্নত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে তুতেন খামেনের অভিশাপ নামে পরিচিত।

 

বরফ মানব ওটজি

পরীক্ষাকারী ফরেনসিক টিমের প্রধান রেইনার হেন (৬৪) পর্যন্ত। তিনি যখন ওটজিকে নিয়ে একটি বক্তব্য প্রদানের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন, তখন এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর পর্বতারোহী কার্ট ফ্রিটজ (৫২) যিনি হেনকে ওটজির মমির সন্ধান  দিয়েছিলেন, পর্বতারোহণের সময় তুষারধসে চাপা পড়ে মারা যান।

১৯৯১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জার্মানির নুরেমবার্গ থেকে আসা দুই পর্যটক হেলমুট আর এরিকা সিমন হিমালয় পর্বতমালা আল্পসে আরোহণ করছিলেন। হঠাৎ সেখানে এক আদি মানবের সন্ধান পান তারা। অবশ্য জীবন্ত নয়, একটি মমি। তারা ভেবেছিলেন, এই দেহটি হয়তো কোনো হতভাগ্য পর্বতারোহীর হবে, যে পাহাড়ে চড়তে গিয়ে মারা গিয়েছিল। ২২ সেপ্টেম্বর মমিটিকে পুরোপুরি উদ্ধার করা হয়। আইসম্যানের সঙ্গে বরফের নিচে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তার ব্যবহƒত কিছু জিনিসপত্র। ওটজির দেহ ইতালির বোলজ্যানোতে বিশেষভাবে তৈরি এক জাদুঘরে সংরক্ষণ করা আছে। বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হিমায়িত ঘরে রাখা ওটজির দেহকে দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন। আইসম্যান বা বরফ মানব ওটজি সম্পর্কে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে- ওটজির মমি কি অভিশপ্ত? ওটজির দেহ আবিষ্কার, বরফের নিচ থেকে উঠিয়ে আনা ও পরবর্তীতে তার মমি নিয়ে গবেষণার ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে প্রশ্নটি আসাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই অস্বাভাবিকভাবে একই বছর মৃত্যুবরণ করেন। অনেক মৃত্যু যেমন রহস্য, সন্দেহ আর প্রশ্নের উদ্রেক করেছে-তেমনি কয়েকটি মৃত্যুকে অবশ্য স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেওয়া যায় নিমিষেই। ৬৩ বছর বয়সে যদি কেউ মারা যায়, তবে সেটিকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সেই ব্যক্তি যদি হন একজন বিজ্ঞানী যিনি ৫,৩০০ বছর আগের বরফে জমে যাওয়া এক মৃত সৈনিকের মমি আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত, তখন একটু প্রশ্নের উদ্রেক হতেই পারে! শুধু কী তাই? তার সঙ্গে সঙ্গে একই বছর সেই মমির সঙ্গে সম্পর্কিত আরও সাতজন ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু খুব স্বাভাবিকভাবেই ভয়াবহ একটা কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। আর সেটিই আসলে অভিশাপ।

বরফ মানব ওটজিকে নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন আমেরিকান বংশোদ্ভূত মলিকুলার প্রত্নতত্ত্ববিদ টম লয়। কিন্তু এই বইটি চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার মাত্র পনেরো দিন আগে তাকে তার ব্রিজবেনের বাসায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তখন চারদিকে ওটজির অভিশাপ নিয়ে নানা রকম কানাঘুষা শুরু হয়। কিন্তু অনেকেই একে উড়িয়ে দেন। টম লয়ের এক সহকর্মী বলেন, ‘লয় এসব অভিশাপে বিশ্বাস করতেন না। এগুলো কেবলই কুসংস্কার। যারা মারা যাচ্ছে এটার সঙ্গে অভিশাপের কোনো সম্পর্ক নেই।’

কিন্তু আস্তে আস্তে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হতে থাকে আরও কিছু নাম। বরফ মানব ওটজির মমি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন আরেক প্রত্নতত্ত্ববিদ-কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের পরিচালক। আর এই গবেষণা শুরুর পর পরই তিনি রক্তের নানা সমস্যায় আক্রান্ত হন, যেটি টানা ১২ বছর ধরে তাকে ভোগাতে থাকে।

৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন হেলমুট সিমনও। তিনিই প্রথম ওটজির দেহটিকে আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীতে হাইকিংয়ে বেড়িয়ে প্রবল তুষারপাতের কারণে মারা যান। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- সিমন যেখানে মৃত্যুবরণ করেন, ঠিক একই জায়গায় ওটজির দেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। ফলে মানুষের মনে ওটজির অভিশাপের বিষয়টি দানা বেঁধে ওঠে। এখানেই শেষ নয় সিমনের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের মাত্র এক ঘণ্টার মাথায় আরও একটি অপমৃত্যু ঘটে। এবারকার শিকার ডিয়েটার ওয়ারন (৪৫)। তিনি দেহ উদ্ধারের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর সুস্থ ডিয়েটারের মৃত্যু হয় এক আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে। এরপর এপ্রিলে প্রত্নতত্ত্ববিদ কনরাড স্প্লিন্ডার (৫৫) মাল্টিপল সেক্লরোসিসে ভুগে মারা যান। এই লোকটিও বরফমানবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনিই প্রথম ওটজির দেহ পরীক্ষা করেছিলেন। বাদ যাননি ওটজিকে পরীক্ষাকারী ফরেনসিক টিমের প্রধান রেইনার হেন (৬৪) পর্যন্ত। তিনি যখন ওটজিকে নিয়ে একটি বক্তব্য প্রদানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, তখন এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর পর্বতারোহী কার্ট ফ্রিটজ (৫২) যিনি হেনকে ওটজির মমির সন্ধান দিয়েছিলেন, পর্বতারোহণের সময় তুষারধসের নিচে চাপা পড়ে মারা যান।

ওটজিকে তার বরফাচ্ছাদিত সমাধি থেকে ওঠানোর ছবিধারণকারী অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক রেইনার (৪৭) মারা যান মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত হয়ে। এসব মৃত্যুর রহস্য এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানীরা অভিশাপের বিষয়টিকে পাত্তা  না দিলেও অনেকের বিশ্বাস, এই মানুষগুলোর মৃত্যুর সঙ্গে ওটজির মমির কোনো না কোনো একটা যোগসাজশ অবশ্যই রয়েছে।

 

ভুতুড়ে গাড়ি

অভিশাপের কবল থেকে রেহাই হয়নি গাড়িরও। বলা হয়ে থাকে কেবল একটি রহস্যময় গাড়ির কারণেই নাকি সংগঠিত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। শুধু তাই নয়, ভয়াবহ এই গাড়িটির কারণে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গাড়িটি ছিল মূলত অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চ ডিউক ফার্দিনান্দের। রাজকীয় এই গাড়িটি শেষ পর্যন্ত এর অদ্ভুত সব কীর্তিকলাপের জন্য আলোচিত হয়ে ওঠে। গাড়িটি ব্যবহারের প্রথম দিনেই ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রী ডাচেস হোহেন নিহত হন আততায়ীর গুলিতে। এরপরই ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অস্ট্রিয়া সরকার এও ঘোষণা করল যে, ফাইভ-বি দলের সেনা অধিনায়ক হবেন পোতারেক। অধিনায়ক পোতারেক সেই গাড়িটিকে সারাজিত গভর্নরের কাছ থেকে কিনে নেন। দুর্ভাগ্যবশত তিনি যুদ্ধে পরাজিত হন এবং মারা যান। ১৯১৫ সালে গাড়িটি প্রদান করা হয় ফাইভ-বি সেনা দলের ক্যাপ্টেনকে। তিনি এটি ব্যবহার করতে পেরেছিলেন মাত্র ৯ দিন। ১০ দিনের মাথায় দুজন যাত্রীসহ মৃত্যু হয় তার। এরপর ১৯১৮ সালে যুগোস্লাভের গভর্নর অস্ট্রিয়া সফরে আসেন এবং গাড়িটি কিনে নেন। ১৯১৯ সালে তিনিও ব্রেকফেল করে মারা যান। এরপর সারকিন্স নামে একজন সরকারি ডাক্তারের মালিকানায় আসে গাড়িটি। সেই ডাক্তার রোগী দেখতে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের খালে পড়ে নিহত হন। তারপর হাতবদল হয়েছে গাড়িটি আর প্রতিবারই মালিকের মৃত্যু হয়েছে। এত দুর্নাম থাকা সত্ত্বেও গাড়িটি কিনে নেন এক শৌখিন সংগ্রাহক। সেখান থেকে গাড়িটি আসে এক মোটর মেকানিক্সের কাছে। মেকানিক গাড়িটিকে নতুন করে গড়ে তোলেন এবং এক ধনী কৃষকের কাছে বিক্রি করে দেন। সারায়েভো শহরে যে দিন তিনি গাড়িটি নিয়ে প্রথম প্রবেশ করলেন সেদিনই শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সবাই ধরে নিল ভৌতিক ওই গাড়িটির জন্যই শুরু হলো আরেকটি যুদ্ধ। শহরের সবার প্রতিবাদের মুখে জেলা প্রশাসক আদেশ দেন ওই কৃষককে হয় শহর ত্যাগ করতে হবে, নয়তো গাড়ির মায়া ত্যাগ করতে হবে। প্রথম শর্তকে বেছে নিয়ে শহর ত্যাগ করে অন্য শহরে রওনা দিলেন গাড়ির মালিক। কিছুদূর এগোতেই গাড়িটি বিগড়ে গেল। কোনো উপায় না দেখে দুটি বলদ গাড়ির সঙ্গে জুড়ে দিলেন। আর তিনি বসলেন বনেটের ওপর। কিছুদূর এগোতেই গাড়িটি হঠাৎ স্টার্ট হয় এবং মুহূর্তেই বলদ দুটোকে ধাক্কা দিয়ে বনেটের ওপর বসে থাকা মানুষটিকে পিষে ফেলে। এরপর ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে ওই গাড়িটি কিনে নেন হস ফল্টি নামের একজন মোটর মেকানিক্স। মেরামত করে বন্ধুর জন্মদিনে যাওয়ার পথে একজন মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে তিনিসহ নিহত হন ছয় বন্ধু।  এরপর অস্ট্রিয়া গাড়িটি কিনে মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৫ সালের ২২ জুলাই বোমা পড়ে গাড়িসহ পুরো মিউজিয়ামটিই পুড়ে যায়। আর গাড়িটির এই রহস্যময় কীর্তিকলাপের ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

চেয়ারে বসলেই মৃত্যু

ইংল্যান্ডের উত্তর ইয়র্কশায়ারের বাসবি স্টুপ ইন নামের একটি সরাইখানা রয়েছে যেটি অনেক রহস্যময় মৃত্যুর জন্য দায়ী। ১৭০২ সালে থমাস বাসবি নামে একজন অপরাধী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে তার শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে সে তার প্রিয় পানশালাতে গিয়ে প্রিয় চেয়ারে বসে জীবনের শেষ খাবার খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। খাবার শেষ করে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে ওঠে, ‘যে এই চেয়ারে বসবে সে হঠাৎ করেই মারা যাবে।’ এরপরের ২০০ বছর পার হয়ে গেলেও চেয়ারটি সেই পানশালাতেই রয়ে যায়। কেউ তাতে বসত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একজন বৈমানিক সেই পানশালাতে এসে অভিশপ্ত চেয়ারে বসলেন। এরপর তিনি আর যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেননি।  এ ছাড়া যে সৈন্যই এই চেয়ারে বসেছে তাদের সবার পরিণতিই একই হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর দুজন পাইলট ওই চেয়ারে বসেছিলেন। কিছুক্ষণ পরই ট্রাক দুর্ঘটনায় মারা যান দুজন।

 

অভিশাপের হোপ ডায়মন্ড

পৃথিবীর ইতিহাসে অভিশপ্ত এক হীরার নাম হোপ ডায়মন্ড। ইতিহাস বলছে, এই হীরা যার কাছেই গেছে সে-ই অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে। প্রায় ১.২ বিলিয়ন বছর আগে কার্বন দিয়ে তৈরি এই হীরা গভীর খনিতে তৈরি হয়। সময়ের পরিক্রমায় এই হীরকখণ্ড ফরাসি রত্নপাথর সংগ্রাহক ও ব্যবসায়ী জিয়ান ব্যাপ্টিস্টের কাছে আসে। ওই সময় এর ওজন ছিল ১১৫ ক্যারেট কিংবা ২৩ গ্রাম। কিছু সূত্র অনুসারে, এই হীরার টুকরোটি রামের স্ত্রী সীতার একটি মূর্তি থেকে চুরি করে এক দরিদ্র পুরোহিত। এক সময় সে ধরা পড়ে ও তাকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এরপর এটি ১৬৪২ সালে ফ্রান্সে আগমন করে। এর মালিক কুকুরের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেন। হীরার পরবর্তী মালিক ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই।  তিনি হীরাটিকে কেটে কমিয়ে ৬৭.৫ ক্যারেটে নিয়ে আসেন। কিন্তু অভিশাপ তাতে কমেনি। নিকোলাস ফুঁকো নামে এক রাজকীয় কর্মকর্তাকে হীরা চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন দণ্ডের আদেশ দিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর