সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রযুক্তির রাজধানী সিলিকন ভ্যালি

প্রযুক্তির রাজধানী সিলিকন ভ্যালি

প্রযুক্তি বিশ্বের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করা হয় সিলিকন ভ্যালি থেকে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত এই সিলিকন ভ্যালি। যেখানে ঠাঁই করে নিয়েছে হাজার হাজার প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠান।  ফেসবুক, গুগল ও অ্যাপল এর মধ্যে অন্যতম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।

সিলিকন ভ্যালি, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত প্রযুক্তির রাজধানী। নব্বই দশক থেকে শহরটি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত একটি জরুরি উপাদান সিলিকন থেকে এই ভ্যালির নামকরণ। যেখানে রয়েছে কয়েক হাজার প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। বর্তমান প্রযুক্তি বিশ্বের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করা হয় সরাসরি সিলিকন ভ্যালি থেকে।

সিলিকন ভ্যালি নামটি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক থেকে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, সে সময় এক নীরব বিপ্লব ঘটে, আর তা হলো প্রযুক্তি বিপ্লব। গুগল, অ্যাপলের মতো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তখন জনপ্রিয় হওয়ার পর এই শহরের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বদরবারে। ফেসবুক, গুগল, অ্যাপল টুইটার, ইয়াহু, নেটফ্লিক্স, সিসকো, পেপাল, ইন্টেল, এইচপি, ইউটিউবের মতো প্রযুক্তি দানবের সদর দফতর সিলিকন ভ্যালিতে।

১৯৯৫ সালের পর সিলিকন ভ্যালি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। কিন্তু এর শুরুটা হয়েছিল তারও বহু আগে। তখন থেকেই ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার, উৎপাদন গবেষণার অগ্রগতি এবং প্রযুক্তিগত কোম্পানি গঠনের জন্য বিখ্যাত ছিল। ১৯৩৯ সালের দিকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রেডরিক টারম্যান এবং তার সাবেক ছাত্র ডেভিড প্যাকার্ড ও উইলিয়াম হিউলেট মিলে একটি ছোট্ট ইলেকট্রনিক কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন। তারাই প্রথম গবেষণার উদ্দেশ্যে এখানকার পলো আল্টোর এই ছোট্ট গ্যারেজ একটি কোম্পানি গড়ে তোলে। পরবর্তীকালে এই পলো আল্টোর গ্যারেজই সিলিকন ভ্যালি নামে পরিচিতি পায়।

১৯৪৭ সালে প্রফেসর উইলিয়াম ডব্লিউ হ্যান্ডসিন নতুন মাইক্রোওয়েভ ল্যাবরেটরি নির্মাণ করেন। এরপর ১৯৫১ সালে জ্যরিয়েন্ট অ্যাসোসিয়েট উদ্ভাবন ও গবেষণার জন্য স্ট্যানফোর্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করেন। ১৯৭০ সালে ইন্টারনেটের জনক অধ্যাপক ভিনটন জি কার্ফ তাঁর এক সহপাঠীকে নিয়ে সিলিকন ভ্যালিতেই ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। এরপর ১৯৮০ সালে জন কিউফি ও তাঁর ছাত্র টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ডাটা ট্রান্সফারের কাজ শুরু করেন। এখান থেকেই আধুনিক ইন্টারনেট ব্যবস্থার উৎপত্তি ঘটে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত অনেক নোবেলজয়ী গবেষক এবং অধ্যাপকদের নানা গবেষণা আর আবিষ্কারের মাধ্যমে হাইটেক তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন চলতে থাকে সিলিকন ভ্যালিতে। যার ফলে নয়নাভিরাম সেই পাহাড়ে ঘেরা এলাকাটি আজকের বিশ্বের হাইটেক প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

সিলিকন ভ্যালির মধ্যে আবার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি এলাকা হলো- পলো আল্ট্রো, কোপাটিনো, মেনলো পার্ক, মাউন্টেন ভিউ ইত্যাদি। পলো আল্ট্রোতে রয়েছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। মেনলো পার্কে রয়েছে ফেসবুকের অফিস। কোপাটিনোতে অ্যাপলের অফিস আর মাউন্টেইন ভিউতে গুগলের অফিস। বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ কম্পিউটার ও প্রযুক্তি পণ্য এই সিলিকন ভ্যালি থেকেই উদ্ভাবিত হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তি সফটওয়্যার মাইক্রোচিপস বা ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানকারী প্রায় সব বৃহৎ প্রতিষ্ঠানেরই এখানে কার্যালয় রয়েছে। ধীরে ধীরে বড় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি অনেক ছোট ছোট সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে সিলিকন ভ্যালিতে। একপর্যায়ে এই স্থানটি হয়ে উঠে ইন্টারনেট অর্থনীতি এবং উচ্চ প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রধান বাণিজ্য  কেন্দ্র। সিলিকন ভ্যালি ছোট-বড় বিভিন্ন স্টার্ট-আপ কোম্পানি বা তরুণ উদ্যোক্তাদের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তি বিশ্বে রাজত্ব করা ফেসবুক, গুগল, অ্যাপল ও এইচপির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সিলিকন ভ্যালির স্টার্ট আপ হিসেবে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। এ ছাড়া বর্তমানে সিলিকন ভ্যালিতে আছে- মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, টুইটার, নেটফ্লিক্স, পেপাল, উবার, এডোবি, এএমডি, ইয়াহু, এনভিডিয়া, এইচপি, ইনটেল, ইবে, টেসলা, ওরাকল, সনি, ওপেরা, সিমেন্স ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়, এ ছাড়াও আরও হাজারো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আছে সিলিকন ভ্যালিতে। সিলিকন ভ্যালিতে যেসব প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের জন্ম হয়েছে সেগুলো যদি না হতো তবে হয়তো বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তি কখনই আজকের পর্যায়ে আসতে পারত না। সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তারা শুধু তাদের নিজেদের ভাগ্য আর ব্যবসা নয়, বদলে দিয়েছে পুরো বিশ্বের চেহারা।  বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাটাসেন্টার বা তথ্য কেন্দ্রগুলোও আছে এই ভ্যালিতেই। অর্থাৎ এই প্রযুক্তির উপত্যকা থেকেই বিশ্বের কয়েক শ কোটি মানুষের ভার্চুয়াল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

 


৩০টি শহর আর ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত এই প্রযুক্তির শহর

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকো বে-র দক্ষিণের অঞ্চলটিই বিশ্ব প্রযুক্তির শহর সিলিকন ভ্যালি। মাত্র পাঁচ দশক হলো অঞ্চলটি এমন নাম পেয়েছে। গত শতকের শুরুর দিকেও শহরটিকে বলা হতো ‘ভ্যালি অব হার্টস ডিলাইট’। বিখ্যাত সিলিকন ভ্যালির বুকে প্রায় ৩০টি শহর ঠাঁই করে নিয়েছে। সান হোসে, কুপার্টিনো, রেডউড সিটি, পালো অল্টো, মেনলো পার্ক, লস গ্যাটোস, মাউন্টেন ভিউ, সানিভেল, সান্তা ক্লারা, সান্তা ক্রুজসহ আরও বেশ কিছু শহর সিলিকন ভ্যালির অন্তর্গত। ভৌগোলিকভাবে ভ্যালিটি সান ফ্রান্সিসকো থেকে সান হোসে পর্যন্ত বিস্তৃত। ভ্যালির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, অ্যাডব, ইবে, নেটফ্লিক্স, সিসকো, পেপাল, ইন্টেল, এইচপি, ইউটিউব, উবার, প্যান্ডোরার মতো প্রতিষ্ঠান। দিন যত যাচ্ছে, ভ্যালিতে বাড়ছে নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের পরিধিও। নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের আস্তানা নিয়ে এসেছেন সিলিকন ভ্যালিতে। ফলে শহর এবং আশপাশের শহরগুলো দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। শহর ছাড়াও বিখ্যাত সব বিদ্যাপীঠও গড়ে উঠেছে এখানে। এর মধ্যে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি অন্যতম, যা পশ্চিমের হার্ভার্ড হিসেবে সুপরিচিত। আরও আছে নর্থওয়েস্টার্ন পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি, কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি, সান হোসে স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটি। আর সব বিদ্যাপীঠ তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি পরিকল্পনা নিয়ে আগ্রহী উদ্যোক্তায় পরিপূর্ণ।

 


‘ভ্যালি অব ডেথ’.!!

প্রযুক্তির শহর, এটা ‘ভ্যালি অব ডেথ’ বা ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হয় কীভাবে? এমনটাই ভাবছেন তো! এর পেছনে রয়েছে একটি ছোট্ট গল্প। ১৯৮৫ সাল, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান HP তখন প্রথবারের মতো বাজারে নিয়ে আসে পার্সোনাল কম্পিউটার। নতুন প্রযুক্তিতে মানিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, বেশি দক্ষতার কর্মীর অভাব। আর এ কারণেই শহরটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ভ্যালি অব ডেথ’।

 


ধনকুবেরদের বাড়ি

একসময় সিলিকন ভ্যালি ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান ও লাতিন আমেরিকানদের আবাসস্থল। প্রযুক্তির বাজার যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তত বেশি মিলিয়নিয়ারদের ঠিকানা হয়ে উঠছে এই শহর। এর অন্যতম কারণ অবশ্য আইটি, বায়োটেকনোলজি এবং আউটসোর্সিংয়ে এই শহরের উত্তরোত্তর সাফল্য। শুধু প্রযুক্তি নয়, এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যও আকৃষ্ট  করছে বিশ্বব্যাপী ধনীদের। তাই এখানে বাড়ছে ধনকুবেরদের বসবাস।

 


জানা-অজানায় সিলিকন ভ্যালি

♦  ১৯৬০ সাল। এখানে প্রথম তৈরি হয়েছিল বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার। জব ও তাঁর পরিবার সে সময় এখানেই বসবাস করতেন। ২০১৩ সালে তাঁদের বাড়িটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

♦  ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি একটি ইলেকট্রিক পত্রিকায় প্রথম সিলিকন ভ্যালি শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সাংবাদিক ডন হফলার সে সময় সেমিকন্ডাক্টরের ইতিহাস নিয়ে লিখছিলেন। তিন পর্বের একটি সিরিজে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।

♦  সিলিকন ভ্যালিতে ৪০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। চীন, জাপান, ভারত, কিউবাসহ নানা দেশের মানুষ এখানে বসবাস করে, কাজ করে।

♦  এক জরিপে দেখা গেছে, সিলিকন ভ্যালিতে কম্পিউটার ও গণিতের মতো ক্ষেত্রগুলোয় মোট কর্মী গোষ্ঠীর ৬০ শতাংশই বিদেশি বংশোদ্ভূত।

♦  সিলিকন ভ্যালির প্রতিষ্ঠানগুলোয় পুরুষের তুলনায় নারী কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। এই সংস্কৃতিকে বলা হয় ‘ব্রো কালচার’ বা ‘ভাই সংস্কৃতি’।

♦  এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে সিলিকন ভ্যালির ২৪ শতাংশ কারিগরি কাজের দায়িত্ব পালন করেছেন নারীরা। ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

♦  সিলিকন ভ্যালির মোট বার্ষিক আয় প্রায় ২৭৫ বিলিয়ন ডলার (২ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার), যা ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডের বার্ষিক আয়ের সমান।

♦  নান্দনিক আর দৃষ্টিনন্দন ভবনের জন্য সিলিকন ভ্যালি বিশ্বদরবারে ব্যাপক সমাদৃত। আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ‘ফরচুন ১০০০’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে সিলিকন ভ্যালির ৩৯টি বাড়ি।

♦  ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সিলিকন ভ্যালিতে কর্মসংস্থান ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অর্থ, এই সময়ে শহরটি ক্যালিফোর্নিয়ার রপ্তানি-বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আয়ে ভূমিকা রেখেছে।

♦  সিলিকন ভ্যালিতে বাসা ভাড়া তুলনামূলক বেশি। তাই এখানে লোকেরা মোটরগাড়ি বা ভ্যানে বসবাস করেন। ফলে বাসা ভাড়ার খরচ বেঁচে যায়।

♦  সিলিকন ভ্যালিতে কর্মরত কর্মীদের বার্ষিক গড় বেতন ১ লাখ ২২ হাজার ডলার থেকে ১ লাখ ৭৪ হাজার ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের গড় বেতন প্রায় ৬৭ হাজার ৩৪০ ডলার।

লেখা : রকমারি ডেস্ক

সর্বশেষ খবর