পৃথিবীর বুকে অজানা রহস্যঘেরা যত স্থানের নাম সবার কাছে জানা তার মধ্যে অন্যতম বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। যা আধুনিক বিশ্বের কয়েকটি স্থানের মধ্যে অন্যতম এবং আজও নানা কুসংস্কার ও রহস্যে মোড়ানো। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল- যাকে কখনো কখনো ‘ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেল’, ‘লিম্বো অব দ্য লস্ট’, ‘দ্য টোয়াইলাইট জোন’ এবং ‘হুডু সাগর’ বলা হয়। বারমুডা, ফ্লোরিডা এবং পুয়েরতো রিকোর মধ্যে একটি ত্রিভুজ আঁকলে যে ৭ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা তার মধ্যে আসে, সেই সবগুলোকেই বলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। অবশ্য এই বিন্দু নির্ধারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সে যা-ই হোক, এ অঞ্চলটিকে মারাত্মক রহস্যময় এলাকায় পরিণত করেছে কিছু খবর। বলা হয়, এ ত্রিভুজ অঞ্চলে অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেছে মানুষ, জাহাজ আর উড়োজাহাজ। রেখে যায়নি কোনো ধ্বংসাবশেষ।
ধারণা করা হয়, ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর নামকরণ হয়েছে; যখন ভিনসেন্ট গ্যাডিস আর্গোসি ম্যাগাজিনের জন্য ‘দ্য ডেডলি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এর পৌরাণিক কাহিনি জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে, এটি কেবল একটি নির্জন দ্বীপ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। কাহো পাখির ডাক এবং তীরবর্তী বন্য শূকরের চিৎকারে ভীত হয়ে প্রথম দিকের সমুদ্র ভ্রমণকারীরা একে ‘দ্য ডেভিলস আয়ারল্যান্ড’ হিসেবে নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ভয়ংকর সব জাহাজডুবি আর বিমান নিখোঁজ কাহিনি একে বিশ্বের বুকে প্রকাণ্ড এক রহস্যময় স্থানে রূপ দিয়েছে। দ্বীপটির রহস্যময় খ্যাতি সম্ভবত শেকসপিয়রের দ্য টেম্পেস্টে রচনায় অমর হয়ে গিয়েছিল; যা ছিল জাহাজ ধ্বংস এবং জাদুবিদ্যার একটি গল্প - ‘এখনো বিরক্তিকর বারমুথস।’
ত্রিভুজ আকৃতির ওই অঞ্চলটিকে ডাকা হয় শয়তানের ত্রিভুজ বলে। সর্বপ্রথম এই জায়গার আবিষ্কার করেন আমেরিকার উদ্ভাবক কলম্বাস। তার বর্ণনা মতে, তার জাহাজের নাবিকরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল পাড়ি দেওয়ার সময় দেখেছিল আলোর নাচানাচি আর আকাশে ধোঁয়া। এ ছাড়া কলম্বাস আরও লিখেছেন, এই জায়গায় এসে তার কম্পাসও ভুল নির্দেশনা দিচ্ছিল। আজ পর্যন্ত অসংখ্য জাহাজ এবং উড়োজাহাজ মিলিয়ে গেছে এই ট্রায়াঙ্গেলে যার কোনো চিহ্ন আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ধারণা করা হয়, বিগত ৫০০ বছরে কমপক্ষে ৫০টি বাণিজ্যিক জাহাজ ও ২০টি বিমান হারিয়ে গেছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। বেশির ভাগই কোনো প্রকার চিহ্ন ছাড়াই হারিয়ে গেছে। নেই কোনো ধ্বংসাবশেষ কিংবা মৃতদেহ। অনেকে বলেন, গভীর পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে, কোনো বিপদ সংকেত না পাঠিয়েই। প্রচলিত ঘটনারগুলোর মধ্যে মারি সেলেস্ত নামের একটি ১০৩ ফুটের ব্রিগ্যান্টাইন পাওয়া গেছে ১৮৭২ সালে ভাসমান এবং পরিত্যক্ত অবস্থায়। কিন্তু মারি সেলেস্তের আসল রহস্য হলো, জাহাজটি আসলে পর্তুগালের উপকূলে পাওয়া গেছে। ধারণা মতে, ভিনগ্রহের মানুষ পৃথিবীতে এসে এ স্থানটিকে তাদের ঘাঁটি বানিয়ে নেয় এবং এ অঞ্চলের ভিতরে প্রবেশকারী সব কিছুর চিহ্ন তারা গায়েব করে দেয় যাতে কেউ তাদের ব্যাপারে কিছুই জানতে না পারে। মজার বিষয় হিসেবে এই জায়গাকে তুলনা করা যেতে পারে ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে। যেখানে একবার কেউ প্রবেশ করলে বের হওয়া তো দূরের কথা তার কোনো অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না।
যদিও রহস্য এখনো পুরোপুরি সমাধান করা যায়নি, তবে রহস্যময় স্থানটির যেসব সামুদ্রিক বিপর্যয় ঘটেছে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। অতি সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে বলা হয়, জাহাজ এবং বিমানের অদ্ভুতভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পেছনে সমুদ্রের তলের মিথেন গ্যাস দায়ী। কারণ মিথেন গ্যাসের উদ্গিরণ সমুদ্রকে উত্তপ্ত করে। ফলে জাহাজ ডুবে যায়। মাত্রাতিরিক্ত মিথেন গ্যাস দাহ্য হিসেবে বাতাসে উঠে যায়, এবং তা বিমানের ইঞ্জিনকে জ্বালিয়ে দেয়। ফলে বিমান বিস্ফোরিত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সর্বপ্রথম ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর আমেরিকার পাঁচটি যুদ্ধবিমান ১৪ জনসহ মিলিয়ে যায় এই ট্রায়াঙ্গেলে। সর্বশেষ তথ্য মতে খবর এসেছিল, বিমানগুলো যখন এই অঞ্চলের খুব কাছাকাছি এসে পড়ে তখন তারা বলছিল- তাদের সামনে খুবই ধোঁয়া। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না এবং তাদের শেষ কথা ছিল- ‘আমাদের বাঁচাও’। এ ঘটনার পর অনুসন্ধানী একটি দল সেখানে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৬২, ১৯৬৫, ২০০৫, ২০০৭ এবং ২০১৭ সালে ঘটে আরও বিমান দুর্ঘটনা। ১৮০০ সালে ঘটে প্রথম জাহাজ দুর্ঘটনা যেখানে প্রাণ হারায় ৯০ জনের মতো যাত্রী। এ ছাড়া ১৮১৪, ১৮২৪, ১৮৪০, ১৯১৮, ১৯২১, ১৯২৫, ১৯৪১, ১৯৬৩ এবং ২০১৫ সালে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে এই ট্রায়াঙ্গেলে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আজ অবধি প্রায় ১ হাজার জনের মতো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন, যা গড়ে প্রতি বছরে ১০ জনের সমান। আজ অবধি অনেক গবেষণা হয়েছে এই ত্রিভুজ স্থানটি সম্পর্কে। তার পরও সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানীর কাছ থেকে উঠে আসে এর আসল রহস্য। তারা বর্ণনা করেছেন, সমুদ্রের এ জায়গায় ষড়যন্ত্র মেঘের (Hexagonal Cloud) কারণে এক বায়ু গোলার সৃষ্টি হয় যার কারণে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়, তাতে আশপাশের সব কিছু এই বিশাল ঢেউ সহ্য করতে না পেরে মিলিয়ে যায় আটলান্টিক মহাসাগরের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অতল গহ্বরে। এ গবেষণাটিকেই আজ পর্যন্ত সব গবেষণার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হচ্ছে। ঘটনা হোক বা কল্পকাহিনি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল স্থানীয়দের মধ্যে রহস্যময় একটি স্থান; যা শিগগিরই অদৃশ্য হয়ে বা হারিয়ে যাবে না।
অদৃশ্য হয়ে যায় ফ্লাইট ১৯
মাত্র শেষ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর, প্রশিক্ষণ চলাকালে পাঁচটি অ্যাভেঞ্জার বোমারু বিমান রহস্যজনক-ভাবে হারিয়ে যায় আটলান্টিক মহাসাগরে। মার্কিন বিমান ঘাঁটির সঙ্গে সে সময় ফ্লাইট কমান্ডার লেফটেন্যান্ট চার্লস টেলরের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। মেলেনি কোনো সংকেত। এয়ারক্রাফটগুলো আকাশে উড়াল দেওয়ার আগে পরীক্ষা করা হয়েছিল। বিমানের ট্যাংকগুলোও ছিল ফুয়েল ভর্তি। মোট কথা ছিল না কোনো সমস্যা। তবুও অদৃশ্য হয়ে যায় সেসব বিমান। উদ্ধারকারী বাহিনী পাঠানো হলে তারাও ফিরে আসেনি। যা আজও অজানা রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।
নিখোঁজ হয় মেরিন সালফার কুইন
ভৌগোলিক রহস্যেঘেরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে নিখোঁজ জাহাজের ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো- মেরিন সালফার কুইন জাহাজের ঘটনা। ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ১৫ হাজার টন সালফার আর ৩৯ জন ক্রু নিয়ে রওনা হয় জাহাজটি। ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে জাহাজটি যখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মধ্যে অবস্থান করছিল তখন হঠাৎ রেডিও ট্রান্সমিশন অফ হয়ে যায়। অথচ কিছুক্ষণ আগেও জাহাজের নাবিক জানিয়েছিলেন, ‘কী সুন্দর আবহাওয়া! চমৎকার নেভিগেশন চলছে!’ এভাবে হঠাৎ ৬০০ ফুটের এই জাহাজটি এতগুলো মানুষকে নিয়ে একদম হারিয়ে গেল! বছরের পর বছর সন্ধানের পরও মেরিন সালফার কুইনের খোঁজ মেলেনি। যা আজও রহস্য হয়ে আছে।
মারি সেলেস্তের ভয়ংকর গল্প
মারি সেলেস্ত নামের একটি মালবাহী জাহাজ ১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক থেকে রওনা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জাহাজটি কখনই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও জাহাজ না পৌঁছানোয় শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। অনেক চেষ্টার পর জাহাজটিকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় খুঁজে পাওয়া গেল ভাসমান অবস্থায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেইসব মালপত্র ও খাবার-দাবার একদম অক্ষত ছিল। শুধু ১১ জন কর্মী উধাও। জাহাজের ক্রুদের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, খাবারের পাত্র, মূল্যবান পণ্যসম্ভার এবং লাইফবোট তখনো জাহাজে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- জাহাজের ডাইনিং টেবিলে প্লেটে থাকা খাবারগুলো পচা ছিল। বিশাল সমুদ্রের মাঝখানে কোথায় হারিয়ে গেল সেই জাহাজের কর্মীরা! আজও সেই রহস্যের কুলকিনারা করতে পারেনি উদ্ধারকারী জাহাজ কিংবা তাদের কর্মীরা।
এলেন অস্টিন এবং ভৌতিক কাহিনি
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে পৌরাণিক কাহিনীর কমতি নেই। অনেক ভীতিকর ও রহস্য ঘটনার জন্ম দিয়েছে স্থানটি। এলেন অস্টিন একটি জাহাজের ফাঁদে পড়েন যা অশুভ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ১৮৮১ সালে যখন এলেন অস্টিন যাত্রা করছিলেন, তখন ক্রুরা একটি পরিত্যক্ত জাহাজের মুখোমুখি হয়েছিলেন। যেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছিল। তবে সেখানে ছিল না কোনো ক্রু সদস্য। এলেন ও তার কয়েকজন ক্রু সদস্য নামহীন ওই জাহাজটি উদ্ধারে যান। সেখান থেকে তারা উদ্ধারকারী জাহাজের সাহায্য চান। কিন্তু পরবর্তীতে উদ্ধারকারী জাহাজ গন্তব্যে এলে কোনো জাহাজ দেখতে পায়নি। অর্থাৎ এলেন অস্টিন এবং ভৌতিক জাহাজ উভয়ই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
ইউএসএস সাইক্লোপসের পরিণতি
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আরেকটি বড় নৌ দুর্ঘটনা ঘটে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার ব্রিটিশদের সাহায্য করার জন্য ইউএসএস সাইক্লোপস নামক একটি জাহাজ পাঠায়। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে ৩০৬ জন যাত্রী নিয়ে বিশালাকৃতির ইউএসএস সাইক্লোপস ব্রাজিলের উদ্দেশে রওনা দেয়। পরবর্তীতে ৪ মার্চ বার্বাডোজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিচ্ছিল মার্কিন জাহাজটি। কিন্তু মাঝ পথে ওই ত্রিভুজ এরিয়ায় তা হারিয়ে যায়। জাহাজটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাছে এসে কোনো চিহ্ন না রেখে উধাও হয়ে যায়। জাহাজটি উদ্ধারে মার্কিন সরকার দুটি বড় অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা কোথাও জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়নি।
অতি প্রাকৃতিক ও আজগুবি সব তত্ত্ব
তত্ত্ব ১ : শয়তানের ত্রিভুজ
এটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ছদ্মনাম। একে পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় স্থান বলে মানা হয়। কারণ এ পর্যন্ত এখানে যত রহস্যময় ও কারণহীন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, অন্য কোথাও এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করা হয়। কথিত আছে, শয়তান এখানে আগত জাহাজ কিংবা বিমানকে টেনে নিয়ে যায়। তাই স্থানীয় অধিবাসীরা এ অঞ্চলটির নামকরণ করে শয়তান বা পাপাত্মাদের ত্রিভুজ।
তত্ত্ব ২ : এলিয়েনদের ঘাঁটি
কয়েকজন সাই-ফাই বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল আসলে একটি বহির্জাগতিক ঘাঁটি। তাদের মতে, সমুদ্রে নেমে আসা ভিনগ্রহের মহাকাশযান নাকি ধ্বংস করে দেয় জাহাজ ও বিমানগুলোকে। কলম্বাস লিখেছিলেন, তার জাহাজের নাবিকরা এ অঞ্চলে আলোর নাচানাচি এবং আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। স্থানীয়রা এখানকার আকাশে অদ্ভুত আলো দেখতে পায়। কখনো কখনো দুর্বোধ্য শব্দ ও অদ্ভুত আওয়াজ নাকি শুনতে পাওয়া যায়।
তত্ত্ব ৩ : চৌম্বক ক্ষেত্র
পৃথিবীর মধ্যে এটি এমন একটি স্থান যেখানে কম্পাস কিংবা অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো কাজ করে না। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভিতরে একটি সংকীর্ণ স্থানে কম্পাসের উত্তর মেরু ও ভৌগোলিক উত্তর মেরু এক হয়ে যায়। ফলে জাহাজ বা বিমান সঠিকভাবে দিক চিনতে না পারার জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভুল দিকে এগোয় ও ভয়ংকর দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। অনেকের মতে, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কাছ থেকে সর্বপ্রথম এলাকাটির বিষয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। তিনি কম্পাসের উলটাপালটা দিক নির্দেশের কথাও তার লেখনীতে বর্ণনা করেছেন।
তত্ত্ব ৪ : আটলান্টিসের হারিয়ে যাওয়া শহর
বলা হয় যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের নিচে আটলান্টিসের হারিয়ে যাওয়া শহর রয়েছে। এটি নাকি আটলান্টিসের সব ক্ষমতা এবং এ যাবৎকালের সব পরিণতির জন্য দায়ী। অনেক পৌরাণিক গল্পে বলা হয়, আটলান্টিসে অতৃপ্ত আত্মা এবং রাক্ষস এই শহরের ধ্বংসাবশেষের প্রতিশোধ নিতে জাহাজ এবং বিমান আক্রমণ করে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের এই তত্ত্বটিকে সুদূরপ্রসারী বলে মনে করা হয়। কিন্তু বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে কি আসলেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে? যা মানুষের মাঝে এখনো কৌতূহল জাগায়।
তত্ত্ব ৫ : মিথেন গ্যাস
অনেকে মনে করেন এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মিথেন হাইড্রেট গ্যাস রয়েছে। এই মহাসাগরের তলদেশ থেকে উৎপন্ন হওয়া মিথেন হাইড্রেট গ্যাস পানির ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাহাজ ডুবে যায়। তবে এটি বিমান হারিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ নয়। এ ছাড়াও নিখোঁজ জাহাজ ও ক্রু সদস্যদের ঘটনাগুলো আজও অমীমাংসিত থাকত না।
তত্ত্ব ৬ : নিজস্ব বায়োস্ফিয়ার
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে এতটাই ভয়ংকর বলা হয় যে, এর নিজস্ব আবহাওয়া এবং পরিবেশ রয়েছে। এই অঞ্চলে মারাত্মক টর্নেডো এবং হিংসাত্মক ঝড়ের খবর পাওয়া গেছে। প্রকৃতির এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগে হারিয়ে গেছে বহু প্রাণ ও মূল্যবান জিনিসপত্র।
তত্ত্ব ৮ : গোপন সংস্থা
অনেকে বিশ্বাস করেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের গভীরে একটি গোপন সংস্থা রয়েছে। যারা তাদের ঘাঁটির কাছাকাছি বা তাদের গোপনীয়তায় হাত বাড়ায় তাদের অপহরণ করে। বলা হয়, তারা ইন্টারসেপ্টর স্থাপন করেছে যা কম্পাস নেভিগেশনসহ ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোকে নষ্ট করে দেয়। যদিও এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। তবে এই রহস্যের সঙ্গে এর মিল রয়েছে।
প্রকৃতির বিরূপ আচরণ
সারগাসো সমুদ্র : এটি হলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মধ্যবর্তী আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে থাকা একটি অদ্ভুত সমুদ্র। চারদিকে কোনো তীর নেই। এটা প্রকৃতির তৈরি ফাঁদ। এই এলাকায় ঢুকে পড়লে জাহাজ বা বোট আর নিজের ইচ্ছায় চলতে পারে না। সমুদ্রের ইচ্ছায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে বেড়াতে হয়। এক সময় খাবার ও পানীয় ফুরিয়ে গেলে মরতে হয় নাবিকদের।
জলের দানব ঘূর্ণি : বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের পশ্চিম প্রান্তে এক অদ্ভুত জিনিস দেখা গেছে। এখানে পানিতে তৈরি হওয়া অতিকায় ঘূর্ণিগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী। এরা আশপাশে থাকা জাহাজগুলোকে অনায়াসে তার অতলস্পর্শী গহ্বরে টেনে নিতে পারে। আগের দিনের মানুষরা এমন অতিকায় ঘূর্ণি দেখেই সমুদ্রের নিচে থাকা দৈত্যের নানা গল্প শোনাতেন।
নীল গহ্বর : বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের পানির নিচে রয়েছে অজস্র গুহা। ভৌগোলিক কারণে এগুলোর আকার বোতলের মতো। বোতলের মুখটা থাকে ওপরের জলস্তরের ঠিক নিচে। এই বোতলগুলোর নিচ দিয়ে আবার সুড়ঙ্গ পথ আছে। যেগুলো সংযুক্ত থাকে অন্য বোতল গুহার সঙ্গে। এগুলোকে নীল গহ্বর বলা হয়। যেগুলোর মধ্যে বিচিত্রভাবে সমুদ্রের জল ঘোরাফেরা করে। সময় অসময়ে ভয়ংকর শক্তিশালী স্রোত তৈরি করে সব কিছু টেনে নেয়।
বিস্ময়কর তলদেশ : আটলান্টিক মহাসাগরের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অংশের তলদেশের গঠন কিছুটা বিস্ময়কর। বিজ্ঞানীরা Sonar Mapping প্রযুক্তিতে বা শব্দ তরঙ্গ ছুড়ে তৈরি করা ম্যাপে কিছু অস্বাভাবিক বৈচিত্র্য বা বৈশিষ্ট্য পেয়েছেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভিতরে ভয়ংকর কিছু খাদ পাওয়া গেছে যেগুলো বেশ গভীর। এর ভিতরে জাহাজ বা বিমান ডুবে গেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ এর তলদেশে পৌঁছনো এখনো সম্ভব হয়নি।
গালফ স্ট্রিম : এটি মেক্সিকো উপসাগর থেকে Straits of Florida হয়ে উত্তর আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত উষ্ণ জলের স্রোত। যা নদীর স্রোতের মতো ভাসমান বস্তুকে স্রোতের দিকে নিতে পারে। ১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর উইচক্রাফট নামের একটি প্রমোদতরী মিয়ামি উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরে ইঞ্জিনের সমস্যায় পড়ে। জাহাজের ক্যাপ্টেন তখন বিষয়টি মিয়ামি কোস্টগার্ডকে জানায়। কিন্তু তারা সেখানে দ্রুত পৌঁছেও জাহাজটিকে খুঁজে পায়নি।
বিস্ময়কর আবহাওয়া : বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ছোটো এলাকাজুড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে বিপজ্জনক ঝড় উঠতে পারে। ফলে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ঝড়ের আগাম সতর্কতা দিতে পারেন না। স্যাটেলাইটও ওই এলাকার আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি চিহ্নিত করতে পারে না। কিন্তু এই মারাত্মক ঝড় মুহূর্তের মধ্যে জাহাজ ও বিমান ধ্বংসের শক্তি রাখে। তা ছাড়াও এই এলাকায় দেখা যায় সামুদ্রিক টর্নেডো। ফলে সমুদ্রে তৈরি জলস্তম্ভ আকাশ ছোঁয়। তার গতিপথে জাহাজ ও বিমান এসে পড়লে ধ্বংস অনিবার্য।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সমাধান কী?
কেন এই বিশেষ এলাকায় গেলেই অদৃশ্য হয়ে যেত বিভিন্ন জাহাজ এবং বিমান? যুগের পর যুগ ধরে এর পেছনে নানা তত্ত্ব দেওয়া হতো।
কেন এই এলাকায় জাহাজ এবং বিমান অদৃশ্য হয়ে যেত? যুগের পর যুগ ধরে এর পেছনে নানা তত্ত্ব দেওয়া হতো। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, নরওয়ের গবেষকরা উত্তর মেরুর ব্যারেন্টস সাগরের তলদেশে বেশ কিছু বড় গর্তের সন্ধান পেয়েছেন। আর্কটিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, এই গর্ত বা আগ্নেয়গিরির মুখগুলোর ব্যাস ৩ হাজার ২৮০ ফুট ও গভীরতা ১৩১ ফুট হতে পারে। রাশিয়ার গবেষক ভ্লাদিমির পোতাপভের তত্ত্ব অনুযায়ী, মিথেন গ্যাসের উদ্গীরণ সমুদ্রকে উত্তপ্ত করে। ফলে জাহাজ ডুবে যায়। এ ছাড়া বায়ুমণ্ডলেও বিশেষ পরিবর্তনের ফলে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। তবে রহস্যের জট খোলেন অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী কার্ল ক্রুজেলনিকি। তিনি বলেছেন, এই ত্রিভুজের একপাশেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র আমেরিকা। ফলে এই এলাকায় জাহাজ চলাচলের পরিমাণ বেশি হবেই। সেটিই পরিসংখ্যানের নিরিখে বাড়িয়ে দিয়েছে ওই এলাকায় দুর্ঘটনার পরিমাণ। আর সেটিই তৈরি করেছে এমন বিস্ময়কর তত্ত্ব। রহস্য ভেদ করতে গিয়ে কার্ল ক্রুজেলনিকি যা বলেছেন, তার সারমর্ম দাঁড়ায়, আসলে ওখানে কোনো রহস্যই নেই।