সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

দক্ষিণ এশিয়া পুড়ছে তীব্র গরমে

দক্ষিণ এশিয়া পুড়ছে তীব্র গরমে

গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একা নয়; দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোও তীব্র দাবদাহের কবলে পড়েছে। ‘এল নিনো’র আগুনে ঝলসে যাচ্ছে এসব দেশের শহর-নগর এবং গ্রাম। বলা হচ্ছে, ২০২৪ সালের উষ্ণতা ছাড়িয়ে যেতে  পারে বিগত বছরগুলোকেও। লিখেছেন - আবদুল কাদের

 

দাবদাহে ঝলসে যাচ্ছে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোটি কোটি মানুষ তীব্র গরম আবহাওয়ার কবলে পড়েছে। কেবল বাংলাদেশ একা নয়, ফিলিপাইন এবং ভারতেরও বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার সপ্তাহব্যাপী স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে। বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএমও) জানিয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এশিয়া মহাদেশভুক্ত দেশগুলোর। ২০২৪ সালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

২০২৩-২০২৪ সালের এপ্রিল মাস দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জন্য ছিল ভোগান্তির মাস। তীব্র দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান,   মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর,  চীন, লাওস, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপপ্রবাহ দীর্ঘ, আরও ঘন ঘন এবং আরও তীব্র হয়ে উঠছে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু হতাহতের পাশাপাশি ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া সবচেয়ে খারাপ তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছে। অঞ্চলটি দীর্ঘমেয়াদি গড় তাপমাত্রা  থেকে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপপ্রবাহের মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি সাত থেকে নয় বছর পরপর গ্রীষ্মন্ডলীয় অঞ্চলগুলোয় ‘এল নিনো’র প্রভাব দেখা দেয়। বৈশ্বিক খরা, তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যার মতো যত বিপর্যয় ঘটেছে, সেসবের অধিকাংশই ঘটেছে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।

 

ভারত

এপ্রিলে গোটা ভারতে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গেল ২৪ এপ্রিল থেকে গরম এক প্রকার আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। বলা হচ্ছে, পরবর্তী পাঁচ দিন এমন তাপপ্রবাহ পূর্ব-ভারতজুড়ে অব্যাহত থাকবে। ভারতের আবহাওয়া দফতরের মতে, সপ্তাহের শুরুতে ওডিশা এবং রায়ালসীমাতে সর্বাধিক তাপমাত্রা (৪২-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) দেখা গেছে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, দক্ষিণ-পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ইয়ানামে কয়েকটি অঞ্চলে একই রকম গরম দেখা গেছে। সেখানকার তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। রাজধানী দিল্লিতে তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস না থাকলেও তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি বেশি ছিল। উষ্ণ, গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়ার জন্য সরকার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে।

 

থাইল্যান্ড

তীব্র গরমে বিপর্যস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড। মেট্রো-পলিটন প্রশাসন জানিয়েছে, গেল বৃহস্পতিবার থাই রাজধানী ব্যাংকক অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছে। সেদিন তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। থাই সরকার জানায়, চলতি বছরে হিট স্ট্রোকে কমপক্ষে ৩০ জন মারা গেছেন। পাশাপাশি ‘খুব বিপজ্জনক’ আবহাওয়ার কারণে দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি ‘উচ্চ সতর্কতা’ অব্যাহত রয়েছে। বলা হচ্ছে, তাপজনিত মৃত্যুর সংখ্যা গত বছরের সংখ্যার কাছাকাছি পৌঁছেছে। ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৭ জন। থাইল্যান্ডের সরকার শিশু, বয়স্ক, রোগী এবং স্থূলকায় ব্যক্তিদের ঘরে থাকার এবং নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পানের অনুরোধ করছেন। থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব উদন থানি প্রদেশের কর্তৃপক্ষও তীব্র এই তাপপ্রবাহের কারণে ‘উচ্চ সতর্কতা’ জারি করে।

 

ফিলিপাইন

সাধারণত মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাস দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সবচেয়ে উষ্ণ-শুষ্কতম মাস হিসেবে বিবেচিত। তবে চলতি বছর ‘এল নিনো’র প্রভাবে তাপপ্রবাহ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফিলিপাইনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়েছে, অন্তত ৩০টি শহর ও পৌরসভায় তাপপ্রবাহ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। তবে দক্ষিণের ক্যাভিট প্রদেশে গেল সপ্তাহে তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। দেশটির সরকার ৬ হাজার ৭০০ স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে। রাজ্যের প্রধান জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আনা সোলিস বলেছেন, আগামী দিনগুলোয় গরম আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সমুদ্র-তীরবর্তী রিসোর্টের কর্মী এরলিন তুমারন বলেন, ‘এত গরম যে শ্বাস নেওয়াও কষ্ট। আশ্চর্যজনক হলেও সুইমিংপুলগুলো খালি। লোকেরা আসবে, সাঁতার কাটবে। কিন্তু তীব্র গরমে তারা বাইরে বেরোতে নারাজ।’

 

শ্রীলঙ্কা

রাজধানী কলম্বোর সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ জানান দিচ্ছে, ‘এল নিনো’র মতো খারাপ আবহাওয়ার প্রভাব আঘাত হেনেছে শ্রীলঙ্কায়ও। কমপক্ষে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ‘উচ্চ তাপমাত্রা’ বজায় থাকবে। গেল সপ্তাহে সর্বাধিক তাপমাত্রা ছিল ৩৩ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক শহর অনুরাধাপুরার বিমানবন্দর অঞ্চলের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনকি সাবারাগামুওয়া প্রদেশের রাজধানী শহর রতœপুরায় সবচেয়ে বেশি উষ্ণতা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মধ্যাঞ্চল প্রদেশের ক্যান্ডিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ত্রিঙ্কোমালি শহরেও একই তাপমাত্রা দেখা গেছে। দেশটির দক্ষিণ-মধ্য উচ্চভূমি বাদ দিয়ে আগামী দিনগুলোয় গোটা রাজ্যের বাকি অংশের তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে।

 

পাকিস্তান

তীব্র গরমে নাজেহাল দক্ষিণ এশিয়ার আরেক রাষ্ট্র পাকিস্তান। চলতি বছর দেশটির আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, সিন্ধু প্রদেশের একাধিক অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। সিন্ধুর নওয়াব শাহতে গেল সপ্তাহে তাপমাত্রা ছুঁয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং মহেঞ্জোদারোতে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লাহোরে সতর্কতা না থাকলেও তাপমাত্রার পারদ ৩৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছিল। পাকিস্তানের উষ্ণতম শহরের তালিকায় বেলুচিস্তানের তুরবত অঞ্চলের নাম অনেক আগেই লেখা হয়েছে। সেখানে গেল  সপ্তাহে তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই প্রদেশের নকুন্দি অঞ্চলে ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সিব্বিতে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। অন্যদিকে করাচির তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।

 

নেপাল

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে পাহাড়ে আবৃত দেশ নেপালেও। চলতি মাসে দেশটির তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করেছে ৩৯ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। তন্মধ্যে রাজধানী কাঠমান্ডুর গড় তাপমাত্রা ছিল ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কাঠমান্ডুর বাগমতি অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৩০-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনকি লুম্বিনী অঞ্চলের গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিরাটনগর বিমানবন্দর এলাকায়ও তাপমাত্রা ছিল ৩৫ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। নেপালের জ্বালানি, জলসম্পদ ও সেচ মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের জলবায়ু রিপোর্ট অনুযায়ী, নেপালের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ০.৬ শতাংশ বেড়েছে।  তরাইয়ের নাওয়ালপারাসির দামকাউলির তাপমাত্রা ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখা গেছে। যা গত ৪৪ বছরেও দেখা যায়নি।

সর্বশেষ খবর