শতবর্ষী বটগাছটার আজ মন ভালো নেই। কে যে এখানে তাকে রোপণ করেছিল সেটা কারও জানা না থাকলেও, শত বছর ধরে সে বাজারের মাঝখানে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। কত পথিককে ছায়া দিয়েছে, কত ক্লান্ত পথিক তার নিচে বসে দু’দন্ড বিশ্রাম নিয়েছে, তার হিসাব নেই। শত বছর ধরে এ বটগাছ সবাইকে দিয়েই গেছে। তবুও মেয়র সাহেব ঘোষণা দিয়েছেন, আগামীকাল তাকে কেটে তার স্থানে ট্রাফিক আইল্যান্ড নির্মাণ করা হবে।
এ ঘোষণা শোনার পর বটগাছটার নিজের জন্য যতটা না খারাপ লাগছে, তার অধিক খারাপ লাগছে তার ডালে বসবাস করা পাখিদের জন্য। ওরা বহু বছর ধরে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এই গাছে বসবাস করছে। সকাল-সন্ধ্যায় এসব পাখির কিচিরমিচিরে এ এলাকা মুখরিত হয়ে থাকে। কত রকমের পাখি, কত রকমের ডাক। যত শোনা যায় ততই ভালো লাগে।
সকালে সক্ষম পাখিদের সবাই খাদ্যের সন্ধানে দূরদূরান্তে চলে গিয়েছিল। বিকালে এসে যখন বটগাছটার মন খারাপ দেখল, তখন সবাই একে একে জেনে গেল মন খারাপের আসল কারণটি। এরপর বটগাছটার মতো অন্যরাও কাঁদতে শুরু করল। কেউ নতুন সঙ্গী নিয়ে এখানে থাকতে শুরু করেছে, কেউ নতুন ডিম পেড়েছে। কদিন পরেই ডিম ফুটে মিষ্টি ছানা বের হবে। কারও আবার ছোটো ছানারা এখনো উড়তে শেখেনি। কদিন পরেই ডানা মেলে নীল আকাশে উড়তে শুরু করবে। অন্যদিকে বৃদ্ধ পাখিরা অসুস্থতার জন্য চলতে ফিরতে পারে না। বাসার অন্যান্যরা যে খাবার এনে দেয় তাই খায়। এখন গাছ কাটা হলে এসব শিশু ও বৃদ্ধ পাখিদের অনেকেই মারা পড়বে।
বয়স্কদের আশ্রয়হীন হয়ে এগাছে ওগাছে ঘুরে বেড়াতে হবে। সহজে কোথাও আশ্রয় পাওয়া যাবে না। যা দু’চারটা গাছ আছে, সেখানে আগে থেকেই অন্যান্য পাখি কষ্টেসৃষ্টে বসবাস করছে। যারা কাছে কোথাও থাকার জায়গা পাবে না তাদের হয়তো এ শহর থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। সেখানে খাদ্য পাবে কি না? শিকারিরা আছে কি না? এসব অনিশ্চয়তা তো আছেই। অন্যদিকে এত বছরের সাথি এ বটগাছের জন্যেও খারাপ লাগছে। পাখিরা এমন বিপদে বহু বছর পড়েনি। সাত পুরুষ ধরে এ গাছে বাস করছে তারা। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ গাছ ঘিরে, তা কি একদিনে বলে শেষ হবে?
পাখিরা কী করবে? কী করে এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে? তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কারও কারও কান্না থামছেই না। কেউ মুখ ভার করে বসে আছে।
এমন সময় চালাক কাক বলে উঠল, তোমরা কাঁদছ কেনো? চলো, আমরা সবাই মিলে মেয়র সাহেবের কাছে যাই। তিনি বড়ো মনের মানুষ, তিনি নিশ্চয় আমাদের কথা বুঝবেন।
প্রথমে কয়েকজন একটু আপত্তি করলেও, পরে সবাই নগর ভবনের দিকে উড়ে গেল। মেয়র সাহেব তখন সভাকক্ষে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নগরের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কত জ্ঞানী-গুণী মানুষ সেখানে বসে আছেন। নগরের অলিগলিতে সড়ক বাতি বসবে, রাস্তা চওড়া হবে, সেসব রাস্তার দুই পাশ দিয়ে নির্মাণ হবে পাকা ড্রেন। সড়কের মোড়ে মোড়ে বসবে ট্রাফিক আইল্যান্ড। ড্রেনের ওপর দিয়ে হবে ফুটপাথ। আরও কত কি!
মেয়র সাহেবের প্রতিশ্রুতি শুনে উপস্থিত সভ্যরা মুগ্ধ হচ্ছেন। মেয়র সাহেব শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে পাবলিক লাইব্রেরি ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি চান শহরের যুবকেরা সেখানে গিয়ে বই পড়ুক। সংস্কৃতিচর্চা করুক। যুবকরা পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, গান, আবৃত্তি, নাচ, নাটক, লেখালেখি মতো সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ে জীবনের সুন্দর সময়গুলো কাটাক। তিনি বলেছেন শহরের প্রতিটি বাড়িতে তিনটি করে ডাস্টবিন দেবেন। একটি ডাস্টবিনে পচনশীল দ্রব্য থাকবে, একটি ডাস্টবিনে বিপজ্জনক দ্রব্য থাকবে আর একটি ডাস্টবিনে প্লাস্টিক জাতীয় অপচনশীল দ্রব্য থাকবে। প্রতিদিন তিনটি গাড়ি একসঙ্গে যেয়ে শহরের বাড়ি থেকে এসব দ্রব্য সংগ্রহ শোধনাগারে নিয়ে যাবে। সেখানে পচনশীল দ্রব্য দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপাদন হবে। বায়োগ্যাস দিয়ে ছোটো গ্যাস টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। অবশিষ্ট বর্জ্য দিয়ে হবে জৈব সার। একই শোধনাগারে তিনি শহরের পয়োবর্জ্যরে লাইন নিয়ে যাবেন। তা থেকেও হবে বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ আর জৈব সার। তিনি খেলাধুলার জন্য খেলার মাঠ সংস্কার করবেন। পার্ক সাজিয়ে তুলবেন আরও মনোরম করে। পাঠাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি করবেন। বৃদ্ধি করা হবে পাঠাগারের বইয়ের সংখ্যা কিংবা বইয়ের ভান্ডারও।
মেয়র সাহেব ও সুধীজনের নগর উন্নয়ন আলোচনায় যখন সভা মুখরিত তখন হঠাৎ শত শত পাখি এদিকে আসতে দেখে সভায় উপস্থিত সভ্যরা চমকে গেলেন।
কারও মুখে কথা নেই। কৌতূহলী দৃষ্টিতে সবাই যখন পাখিদের দিকে তাকালেন তখন কাক সব প্রজাতির একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সভাকক্ষে প্রবেশ করল। একে একে সবাই সবার কথা খুলে বলল। নতুন ডিমের কথা, ছানাদের কথা, বৃদ্ধ পাখিদের কথা, শতবর্ষী বটগাছটির কথা, ক্লান্ত পথিকের কথা। সবাই মন দিয়ে শুনলেন পাখিদের কথা।
সবার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হলো। সবাই মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করেছেন, কেউ পাখিদের কথা চিন্তা করেননি। নিজেদেরকে স্বার্থপর মনে হতে লাগল সুধীজনদের। সভাকক্ষের সবাই চুপচাপ বসে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে মেয়র সাহেব কথা বলে উঠলেন। এ বিষয়ে সুধীজনদের সঙ্গে আলাপ করলেন। মেয়র সাহেব সভার মধ্যে পুনরায় ঘোষণা দিলেন, তোমাদের ভয় নেই। তোমরা নিশ্চিন্তে বাসায় ফিরে যাও। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। এ রকম গাছ একদিনে কেটে ফেলা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে নকলে মিলে শত চেষ্ট করলেও শত বছরের আগে এ রকম গাছ হয়ে ওঠে না। প্রকৃতি ধ্বংস করা যতটা সহজ, প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, বন সৃষ্টি করা, ঠিক ততটাই কঠিন। তোমরা ভয় পেয়ো না, আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি। আজ থেকে প্রকৃতি এবং পশুপাখির ক্ষতি হয় এমন কাজ আমি আর করবো না।