মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

রোজা ও তাকওয়ার আলোকে মানবিক ব্যাংকিং

ড. মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন

আল্লাহতায়ালার সব বিধান ব্যক্তি ও সমাজের এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য কল্যাণকর। মানুষ কিছু বিষয়ে নিজ পছন্দ বা ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগাতে পারে। এই ইচ্ছাশক্তি ব্যবহারেও মানুষকে আল্লাহর বিধানের অনুগত হতে হবে। শরীয়ার উদ্দেশ্য হলো কল্যাণ বাড়ানো আর অকল্যাণ দূর করা। আলোচ্য প্রবন্ধে ‘রোজা ও তাকওয়ার আলোকে মানবিক ব্যাংকিং’ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

রামাদান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজই হলো রোজা বা সিয়াম। আর সিয়াম হলো ফজরের উদয়লগ্ন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহ পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা। সিয়াম পালন তথা রোজা ফরজ এবং এটি ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার। নির্দিষ্ট কয়েক দিন মাত্র (আল-বাকারাহ : ১৮৩-১৮৪)

তাকওয়ার পরিচয় : তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়, পরহেজগারি, বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি প্রভৃতি। আল্লাহর ভয়ে সব অবৈধ কাজ থেকে বিরত হয়ে বৈধ জীবন পরিচালনার নাম তাকওয়া। একবার উমর (রা.) উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে তিনি বললেন, উমর, আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথ অতিক্রম করেননি। উমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ, করেছি। উবাই (রা.) বললেন, আপনি তখন কী করেছেন? উমর (রা.) বললেন, আমি সতর্ক হয়ে পথ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছি। উবাই (রা.) বললেন, এটাই তাকওয়া।

মানবিক ব্যাংকিং কী? : ব্যাংকিং নীতি ও পদ্ধতি যদি মানবতার কল্যাণের জন্য এবং অকল্যাণ দূর করার উদ্দেশ্যে হয়, তাকে মানবিক ব্যাংকিং বলা হয়। মুমিনের প্রতিটি আর্থিক কারবারের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তে থাকবে মানবতার কল্যাণ। রসুল (সা.) বলেন, ‘দীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বলেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রসুলের জন্য, মুসলিম নেতাদের জন্য এবং তাদের সাধারণ জনগণের জন্য।’ (সহিহ মুসলিম) এ হাদিস থেকে জানা যায়, মানবতার কল্যাণ কামনা দীনের অন্তর্ভুক্ত। এ কল্যাণ কামনা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানবতার কল্যাণই হচ্ছে মানবিক ব্যাংকিং।

রোজা ও তাকওয়ার আলোকে মানবিক ব্যাংকিং : রোজা ও তাকওয়া আমাদের মানবিক ব্যাংকিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়। মানবিক ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে রোজা ও তাকওয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের সম্পদকে জাতীয় আর্থিক প্রবাহে আনা। আল কোরআনের সূরা আল-হুজুরাতের ১৩নং আয়াতে এ ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে।

সঞ্চয়কারীর সম্পদকে মানবতার কল্যাণকর খাতে বৈধ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করা।

বিনিয়োগের খাত ও পদ্ধতি নির্বাচনে মানুষের জরুরিয়াত বা জরুরি প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। সব মানুষের জরুরি চাহিদা পূরণের পরই পর্যায়ক্রমে Complementary  (হাজিয়াত) ও decorative (তাহসিনিয়াত) চাহিদা পূরণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি শরিয়ার লক্ষ্য (মাকাসিদে শরিয়া)  সহায়ক। মানবতার জন্য ক্ষতিকর কোনো খাতে বিনিয়োগ না করা।  তামাক, মাদক, জুয়া অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা। সমাজের স্বল্প বিত্ত সাধারণ মানুষের সম্পদ অল্প কিছু লোকের হাতে জমা করা যাবে না। সুদি লেনদেনে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই মানবিক ব্যাংকিং জনগণের ছোট-বড় সব ধরনের সঞ্চয় সংগ্রহ করে তা সার্বজনীন কল্যাণে লাগায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মাঝে আবর্তিত না হয়।’ (আল-হাশর : ০৭)

অর্থসম্পদ, মানব সম্পদ ও বস্তুগত সম্পদ ব্যবহারে নৈতিক শৃঙ্খলার অনুসরণ। এটি না হলে বঞ্চিত মানুষের দুর্দশা বাড়ে। মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য মানুষের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত স্বভাব ও অভ্যাসের উন্নয়ন প্রয়োজন। তাই মানবিক ব্যাংকিং কর্মকৌশল নির্ধারণে মানবতার নৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেবে।

তাকওয়া মানে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, যেমন- সহিহ আল-বুখারি ও সহিহ মুসলিমে তিন ব্যক্তির অত্যধিক ইবাদতের সংকল্প করার পর নবী (সা.) তাকওয়ার সংজ্ঞা দিলেন। মানবিক ব্যাংকিং অর্থনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করবেন।

রোজা মানুষকে ভোগবাদী না হয়ে সহমর্মী হওয়ার শিক্ষা দেয়। এ মাসের নামই সহমর্মিতার মাস। মানবিক ব্যাংকিং ৯৯% সম্পদকে ১% মানুষের কাছে তথা ৬২টি পরিবারের হাতে পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে দেয় না। সারা বিশ্ব বর্তমানে মানবিক ব্যাংকিংয়ের দিকে এগিয়ে আসছে। আল্লাহতায়ালা আমাদের রোজা ও তাকওয়ার আলোকে মানবিক ব্যাংকিংয়ের প্রচার, প্রসার ও সহযোগিতার তাওফিক দিন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর