বুধবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম : একজন সুবিদ আলীর কথা

মহিউদ্দিন আহমদ

শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম : একজন সুবিদ আলীর কথা

স্পষ্ট মনে আছে মাসটি ছিল আগস্ট; তবে তারিখটি মনে নেই। বছর ১৯৭১, আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধটির পিক পিরিয়ড, ঘটনাস্থল লন্ডন। এক দিন সন্ধ্যায় স্যারের টেলিফোন। স্যার মানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। অনেকেরই এখনো নিশ্চয়ই মনে আছে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের একজন বিচারপতি এবং একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও ভাইস চ্যান্সেলর জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী একাত্তরে ভারতের বাইরে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

আমরা তখন লন্ডনে তার সঙ্গে যারা কাজ করছি এবং পরেও যোগাযোগ রেখেছি, আমাদের সবার কাছে তিনি ‘স্যার’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। স্যার বললেন, যদি ব্যস্ত না থাকেন তাহলে কি সন্ধ্যার দিকে একটু আসতে পারেন? বিচারপতি চৌধুরী বড় ছোট সবার সঙ্গেই বিনয় প্রকাশ করেই কথা বলতেন। তবে তিনি যত বিনয়ের সঙ্গেই বলুন না কেন, যারা তার সঙ্গে পাঁচ-দশ দিন একত্রে থেকেছেন, তারা বিচারপতি চৌধুরীর কোন কথাটি কেমন গুরুত্ব বহন করে, কোন কথাটি কেমন জরুরি তা এই কয়েক দিনের অভিজ্ঞতাতেই বুঝে নিতে পারতেন। আমারও বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজেই তিনি আমাকে ওই সময়ে টেলিফোন করেছেন। ঠিক কয়টার সময় তার বাসায় যাব জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘রাত ১০টার দিকে আসলে চলবে’। এবার তিনি আরও বললেন, আপনার সঙ্গে লুত্ফুল মতিনকেও আসতে বলুন। লুত্ফুল মতিন তখন লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের সদ্য পদত্যাগকারী ডাইরেক্টর। ’৭১-এর ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারে যুক্তরাজ্যের প্রায় ৩০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশির বৃহত্তম সমাবেশে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের আমার সেকেন্ড সেক্রেটারির পদটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিন পর লুত্ফুল মতিনও পদত্যাগ করেছিলেন। তখন আমি থাকি সেন্ট্রাল লন্ডনের কেনসিংটনে। হল্যান্ড রোডে আমার বাসা। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী থাকেন উত্তর লন্ডনে। বাড়িটির ঠিকানা এখনো মনে আছে ২৩, দি গ্রিন। লুত্ফুল মতিনও তখন উত্তর লন্ডনে, ডলিস হিলে থাকতেন মনে পড়ে।

আমরা দুজন লন্ডনের দুই প্রান্ত থেকে আলাদা আলাদাভাবে জনাব চৌধুরীর বাড়িতে নির্ধারিত সময়ে হাজির হলাম। তার বাসায় পৌঁছে দেখি, আমাদেরই প্রায় সমবয়সী এক বন্ধু, ব্রিটেনে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী, ডাক্তার আহমদ হোসেন জোয়ারদার বসার ঘরে স্যারের সঙ্গে কথা বলছেন। ডা. জোয়ারদার তখন লন্ডনের একটি হাসপাতালে কাজ করতেন।

মিনিট পাঁচ-দশেক দেশের অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন— এসব নিয়ে আলোচনার পর স্যার বললেন, ডাক্তার জোয়ারদার পাঁচ হাজার পাউন্ড ক্যাশ নিয়ে এসেছেন; এটি রাখুন। এই পাউন্ডগুলো প্রাপ্তির একটি রসিদ দেবেন। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ মিশনের খরচপত্র মেটানো হবে এবং এই মিশন খাতে আর সব খরচের জন্য আমি আরও ‘ফান্ড’ জোগাড় করব। টাকাটা কার কাছ থেকে পেয়েছেন বা কীভাবে জোগাড় করেছেন তা স্যার নিজেই যখন বললেন না, আমরাও জানতে চাইলাম না। তবে রসিদটি কার নামে হবে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। জবাবে স্যার বললেন, জনাব সুবিদ আলীর নামে রসিদটি ইস্যু করবেন। আমি আর লুত্ফুল মতিন কয়েক সেকেন্ড মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকলাম। ব্রিটেনের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রথম সারির অনেকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জানাশোনা, পরিচয় আছে। তবে জনাব সুবিদ আলী বলে কারও নাম কখনো শুনিনি। যে সুবিদ আলী পাঁচ হাজার পাউন্ড দিতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই কোনো হেলাফেলার মানুষ নন বুঝতেই পারছিলাম; তারপরও তার নাম জানি না, নিজেকে অপরাধী মনে করছিলাম। এবার  ঔত্সুক্য আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না বলে স্যারকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম; স্যার, জনাব সুবিদ আলীকে তো চিনলাম না, তিনি কোথায় থাকেন? আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল তিনি হয়তো ব্রিটেনের বাইরের কেউ, কোনো বাঙালি। ইউরোপের প্রায় সব দেশ থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনগুলো স্যারের কাছে টেলিফোন এবং চিঠিতে উপদেশ, নির্দেশ, পরামর্শ চাইত। একবার ভাবলাম ওদের কেউ হয়তো হবেন। ’৭১-এ আমরা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকজন বাংলাদেশির কাছ থেকেও অল্প কিছু টাকা পেয়েছিলাম এখনো আবছা আবছা মনে পড়ে।

স্যার খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, জনাব সুবিদ আলীর সঙ্গে এক দিন আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব; কিন্তু আর কিছু বললেন না। এরপর তো আর কোনো প্রশ্ন বা আলোচনা চলে না। আরও কিছুক্ষণ সময় স্যারের বাসায় কাটিয়ে আমরা তিনজনই রাত সাড়ে ১০টার দিকে একত্রে বেরিয়ে আসলাম। লুত্ফুল মতিন কয়েক দিনের মধ্যেই ডাক্তার জোয়ারদারকে একটি রসিদ ইস্যু করলেন। পাউন্ডগুলো বোধহয় আমার কাছেই থাকল কিছুদিন। এখানে এই ফান্ড এবং বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের একটু পটভূমি বর্ণনা করার প্রয়োজন বোধকরি। ব্রিটেন প্রবাসী প্রায় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রতি সপ্তাহে এক পাউন্ড করে চাঁদা দিতেন। লন্ডনের হামব্রোজ ব্যাংকে এই উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছিল। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ‘ডধৎ ড়হ ডধহঃ’- এর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ এবং ব্রিটিশ ‘হাউস অব কমনস’-এর সদস্য জন স্টোন্হাউজ— এই তিনজন ট্রাস্টি এই ফান্ড পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং অন্য দুজনের যে কোনো একজনের সইতে টাকা পাঠানো যেত। অন্য কোনো বড় ব্যাংক— যেমন লয়েডস, ন্যাশনাল ওয়েস্ট মিনিস্টার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এগুলোতে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়নি। কারণ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চাঁদা গ্রহণ করার জন্য কোনো অ্যাকাউন্ট খুললে এই মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকগুলো পাকিস্তানে তাদের ব্যবসা হারাতে পারে— এ ভয়ে তখন আমাদের অ্যাকাউন্ট গ্রহণ করেনি। ’৭১-এ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের প্রবাসী বাঙালিরা ‘বাংলাদেশ লিবারেশন অ্যাকশন কমিটি’ বা এমন নামের প্রায় একশটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল। যুক্তরাজ্যের যে ছোট শহরে দশ-বারো জনও বাংলাদেশি বাস করতেন, সেখানেও একটি বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়েছিল। তারা এই চাঁদা আদায় করে আমাদের কাছে পাঠালে আমরা ব্যাংকে জমা করে তাদের কাছে রসিদ পাঠিয়ে দিতাম। আবার অনেক কমিটি সরাসরিই ব্যাংকে জমা দিত।

সারা যুক্তরাজ্যে এই একশটি সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় এবং মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য Umbrella সংগঠন হিসেবে ‘স্টিয়ারিং কমিটি’ একটি তো ছিলই। স্যার এই কমিটির অ্যাডভাইজার হিসেবে মুখ্য নির্বাহী ছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কূটনৈতিক ফ্রন্টেও কাজ করার জন্য আলাদা একটি বাংলাদেশ মিশনের প্রয়োজনীয়তা স্যার অনুধাবন করতে থাকলেন। বিশেষ করে দুনিয়ার কয়েকটি পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে কয়েকজন বাঙালি কূটনীতিবিদ পদত্যাগ করে ভারতের বাইরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তম কেন্দ্র লন্ডনে চলে আসার পর প্রশিক্ষিত জনবলের সংস্থানও যখন হলো, তখন স্যার লন্ডন কূটনৈতিক ফ্রন্ট খোলার গুরুত্বারোপ বেশি দেখলেন এবং বুঝলেন। কিন্তু এই মিশনের খরচপাতি কীভাবে চলবে— এই প্রশ্নটিও সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল। স্যার বললেন, হামব্র্রোজ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফান্ডের টাকা, ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধ চালানোর জন্যই দিচ্ছেন। ওই ফান্ড থেকে টাকা নিয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য খরচপাতি মেটানো ঠিক হবে না। তিনি অনেক দিন ধরে আমাদের বলে আসছিলেন, মিশন চালানোর খরচের টাকা তিনি আলাদাভাবে জোগাড় করবেন। ১৯৭১-এর আগস্ট মাসেই বাংলাদেশের এক একনিষ্ঠ বন্ধু ডোনাল্ড চেজওয়ার্থের সহায়তায় ২৪ নম্বর পেমব্র্রিজ গার্ডেনের গ্রাউন্ড ফ্লোরের কয়েকটি কামরা প্রস্তাবিত কূটনৈতিক মিশনের জন্য ভাড়া নিলাম। চিরকুমার চেজওয়ার্থ নিজে এই বাড়িটির দোতলায় একটি ঘরে থাকতেন। TOC ঐ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এ বাড়িটির মালিক ছিল। বাড়িটির অন্যান্য তলায় আরও ভাড়াটিয়া ছিল।

’৭১-এর ২৭ আগস্ট, শুক্রবার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাদের বাংলাদেশ মিশনের কাজ প্রায় তিনশ দেশি-বিদেশি বাঙালি, অবাঙালি, এবং সাংবাদিকের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েই শুরু, মানে উদ্বোধন করলেন। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আমাদের আরও দুই সমর্থক ও বন্ধু সায়মন ড্রিঙ্ক এবং অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসও উপস্থিত ছিলেন, মনে পড়ে। আমাদের ভরসা কিন্তু ওই পাঁচ হাজার পাউন্ড। ইতিমধ্যে ওই পাঁচ হাজার পাউন্ড নিয়ে একটি অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। আমার এবং লুত্ফুল মতিনের যৌথ সইতে এ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উঠানো যেত।

কূটনৈতিক মিশন খোলা হলো বটে, তবে ব্রিটিশ সরকার আমাদের এই মিশনকে স্বীকৃতি দেয়নি। দেবে কী করে, তারা তো বাংলাদেশকেই স্বীকৃতি দেয়নি তখনো। ২৪ নম্বর পেমব্র্রিজ গার্ডেনের চার-পাঁচ তলার এ বাড়িটিতে লন্ডনে আমাদের এই হাইকমিশনের কাজ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯৭২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও চলে কয়েক বছর। পরে এই হাইকমিশন বর্তমান ‘কুইনস গেটে’ স্থানান্তরিত হয়। পেমব্র্রিজ গার্ডেনের ওই বাড়িটি এখন ‘বাংলাদেশ সেন্টার’ হিসেবে পরিচিত।

এই মিশনটি খোলার পরে আফ্রিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের পাকিস্তান দূতাবাস থেকে আরও বেশ কিছু বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমরা পাকিস্তান দূতাবাসে চাকরি করাকালে যে বেতন-ভাতা নিতাম, তার অংশবিশেষ এই সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মিশন থেকে সাবসিসটেন্স অ্যালাউন্স হিসেবে পাচ্ছিলাম। এ মিশনের খরচ যখন বাড়তে থাকল, স্যার আরও কিছু ফান্ড এই মিশনের খরচপাতির জন্য আলাদাভাবে জোগাড় করলেন। কিন্তু সুবিদ আলীর পরিচয় জানার আমাদের যতই ঔত্সুক্য থাকুক না কেন, স্যার নিজে থেকে এই ভদ্রলোকের পরিচয় জানাননি। আমরাও তার কাছ থেকে জানতে চাইনি। ডাক্তার জোয়ারদার আমাদের এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু; কিন্তু নিজ থেকে কোনো দিন তিনিও কিছু বলেননি।

এরপরের ঘটনা আমাদের বিজয় দিবসের তিন সপ্তাহ পর, ১৯৭২-এর ৪ কি ৫ জানুয়ারি বিকালবেলা। লন্ডনের জানুয়ারি শীতকাল; দিন ছোট। ইতিমধ্যে ঘরে বাইরে বাতি জ্বলছে। স্যার তার অফিসে একদিন তার পাশের কামরায় আমার অফিস থেকে আমাকে ডেকে পাঠালেন। তলব পেয়ে তার কামরায় ঢুকতেই দেখলাম, একজন ভদ্রলোক বসে আছেন স্যারের মুখোমুখি। সামনে রাখা দু-তিনটি চেয়ারের একটিতে আমি বসলাম। সেই ভদ্রলোককে আমি আগে কোনো দিন দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। আমি চেয়ারে বসে তার দিকে তাকাতেই স্যার বললেন, সেই পাঁচ হাজার পাউন্ডের চাঁদাটির কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে থাকবে। আমি বললাম, অবশ্যই। ওই টাকা দিয়েই তো আমরা এই জায়গাটিতে আমাদের এই মিনশটি শুরু করলাম। স্যার এবার বললেন, সেই পাঁচ হাজার পাউন্ড যিনি দিয়েছিলেন, তখন তার নাম জনাব সুবিদ আলী বলেছিলাম। এখন সেই সুবিদ আলী আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ইনিই সুবিদ আলী, আপনার পাশের চেয়ারে বসা।

ভদ্রলোক কিন্তু স্যারের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও তার দিকে তাকাচ্ছি মাঝে মাঝে। স্যারের মুখে একটু মিটমিট হাসি। আমি জনাব সুবিদ আলীকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। স্যার এবার একটু শব্দ করে হেসে বললেন, এই জনাব সুবিদ আলী হচ্ছেন জরুহুল ইসলাম, যার নাম আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।

এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। বললাম, নিশ্চয়ই শুনেছি। কোন বাঙালি তার নাম শোনেনি। জনাব সুবিদ আলী নামে জহুরুল ইসলাম সাহেবকে আমাদের ওই দুর্দিনে এমন বড় একটি অঙ্কের চাঁদা দিয়ে সাহায্য করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম। জহুরুল ইসলাম সাহেব একটু বিব্রত হলেন। তিনি বোধহয় এমনিতেই মৃদুভাষী ছিলেন। সেদিন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ বা অন্য কোনো বিষয়ে তার সঙ্গে তেমন প্রাণবন্ত কোনো আলোচনা হলো না, মনে আছে। কিছুক্ষণ পর আমি স্যারের কামরা থেকে বেরিয়ে আসি। বোধহয় তার পরদিন বিকালে স্যার বাংলাদেশের উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তানের বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকার পথে ৮ জানুয়ারিতে লন্ডন পৌঁছলেন, ইতিমধ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন-কলকাতা হয়ে ঢাকায় এক দিন বা দুই দিন আগে স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছে গেছেন।

জহুরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমার এরপর দুবার দেখা হয়েছে। প্রথমবার লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে, ১৯৭২-এর আগস্ট মাসে; বঙ্গবন্ধুর ‘গলস্টোন’ অপারেশনের সময়ে। লন্ডন ক্লিনিকে অপারেশন শেষে বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজেস হোটেলে ফিরে এসেছেন। দুনিয়ার পাঁচ-সাতটি খান্দানী হোটেলের একটি এই ক্ল্যারিজেস হোটেলে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের অন্যসব সদস্যের— বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, কামাল, জামাল, রেহানা, রাসেল— সবার থাকার ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশ সরকার।

জহুরুল ইসলাম সাহেবও তখন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে লন্ডন গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তার ‘সুইটে’ খবর দিলাম। বঙ্গবন্ধু কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে বললেন। বঙ্গবন্ধুর সুইটের সামনের কামরায় হোটেলে আমাদের ক্যাম্প অফিসে জহুরুল ইসলাম সাহেব অপেক্ষা করছেন। এ সময় সেই সময়কার এক ডাকসাইটের সাংবাদিকের ওই কামরায় প্রবেশ। জহুরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে তার কোটের বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাউন্ড নোটের বান্ডিলটি বের করে আনলেন ওই সাংবাদিক। ওই বান্ডিল থেকে গুণে গুণে কিছু পাউন্ড নিজের জন্য আলাদা করে রেখে বাকি বান্ডিলটি ওই একইভাবে আবার জহুরুল ইসলাম সাহেবের পকেটে রেখে দিলেন। জহুরুল ইসলাম সাহেব একটু হাসলেন; কিন্তু কিছুই বললেন না। দুজনের আচরণে আমরা অবাক হলাম; একজন অবলীলায় কীভাবে আরেকজনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বান্ডিল বের করে আনলেন; আর অন্যজন কেমন করে এমন নির্লিপ্ত থাকতে পারলেন। এরপরেরবার নতুন দিল্লি পালাম বিমানবন্দরে, খুব সম্ভব ১৯৭৩ কি ৭৪-এ। আমি তখন নতুন দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি। কয়েক মাস আগে বদলি হয়ে লন্ডন থেকে এসেছি। একজন ভিআইপিকে অভ্যর্থনা জানাতে এয়ারপোর্টে গিয়েছি। অ্যারাইভেল লাউঞ্জের ভিতরে আমাদের বিশিষ্ট মেহমানের জন্য অপেক্ষা করছি। এ সময়ে দেখি জহুরুল ইসলাম সাহেবও লাউঞ্জে ঢুকছেন। তাকেও অভ্যর্থনা জানালাম। আমাকে তার চেনার কথা নয়। আমি তাকে সালাম দিয়ে আমার পরিচয় দিলাম। ১৯৭১-এর তার সেই দানের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি যেমন আগ্রহের সঙ্গে তার সঙ্গে কথা বলছিলাম, তার পক্ষ থেকে তেমন উৎসাহ বা সময় ছিল না। একপর্যায়ে এখানে উল্লেখ করতে পারি যে, ডা. জোয়ারদারের সঙ্গে জহুরুল ইসলাম সাহেবের ঘনিষ্ঠতা ছিল বোধহয় আগে থেকেই।

’৭১-এ ডা. জোয়ারদারই শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম সাহেবকে তার হাসপাতালে একজন রোগী হিসেবে ভর্তি করিয়ে আড়াল করে রেখেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বর্তমান ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসবাসরত, প্রচারবিমুখ ডা. জোয়ারদার দুজনই আলাদাভাবে আমাকে এমনটি বলেছিলেন। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে তিনি দেশের সবচেয়ে ধনবান মানুষের একজন হয়েছিলেন। বাংলাদেশের শিল্প, বাণিজ্যের একজন ‘পাইওনিয়ার’ হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে তার বিরাট ভূমিকা ছিল। তার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ কাজ করছে। তিনি তার নিজ এলাকায় বাজিতপুরে একটি উচ্চমানের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের মতো মহৎ কাজ করেছেন। শহর বাদ দিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে এমন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সাধারণ লোকজনের প্রতি তার ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি এখানে।

রাজনীতিতে জহুরুল ইসলাম সাহেব কার পক্ষে ছিলেন এ বিষয়ে কোনো দিন কিছু কোথাও পড়িনি। তবে ১৯৮৬-এর ৩১ আগস্টে লন্ডন অবজারভার পত্রিকায় আমাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ওপর Leslie Plummer-এর যে বিরাট কাহিনী ‘Love and Graft in the Worlds Poorest Nation’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল, সেখানে জহুরুল ইসলাম সাহেব সম্পর্কে এমন একটি বাক্য আছে— ‘Jahurul Islam was a friend of Mujib, a friend of Zia, a friend of Ershad and he will be a friend of the next fellow’ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বোধহয় এমনই হতে হয়।

জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে বলতে পারব না। তবে লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে বঙ্গবন্ধুর জন্য জহুরুল ইসলাম সাহেবের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করেছি।

জহুরুল ইসলাম সাহেবের অন্য যে পরিচিতি বা এই দেশের অর্থনীতিতে তার যে ভূমিকা, আমি তাকে প্রথম সুবিদ আলী হিসেবে দেখেছি এবং তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। সেই পরিচয়েই আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমি তার মৃত্যুর পর তাকে ওই নামেই জানব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন ফাইন্যান্সিয়ার হিসেবে আমার সে সব স্মৃতি কোনো দিন ভুলতে পারব না।

     লেখক :  পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর