রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বেণিপুরে জঙ্গি আস্তানায় চালানো পুলিশের অপারেশন ‘সান ডেভিল’-এ ছয়জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন জঙ্গি এবং একজন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য। আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই শিশুকে। সুমাইয়া নামের এক নারী জঙ্গি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। নিহত সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস।
গতকাল দুপুরে অপারেশন ‘সান ডেভিল’ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর পরই জঙ্গিদের লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায় পুলিশ। আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয় ১১টি বোমা, পিস্তল, গুলি, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, জিহাদি বই, পুলিশের পোশাকের থানকাপড়। বুধবার রাত আড়াইটা থেকে এ অভিযান শুরু হয়। বৃহস্পতিবার সারা দিন অভিযান শেষে রাত ৮টার দিকে অভিযানটি স্থগিত ঘোষণা করেন রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মাসুদুর রহমান। ঘটনাস্থলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। আলোস্বল্পতার কারণে আপাতত অপারেশনটি স্থগিত করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে আবার অভিযান শুরু হবে।’
রাজশাহী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী জানান, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বুধবার রাত আড়াইটার দিকে মাঠের মধ্যে থাকা বাড়িটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ওই বাড়ির ভিতর থেকে কয়েকজন বের হয়ে এসে ‘বিস্ফোরণ’ ঘটান। জঙ্গিদের ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণের’ সময় একজন নারী ও পুরুষ দৌড়ে গিয়ে কাছে থাকা ফায়ার সার্ভিসের সদস্য আবদুল মতিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গোদাগাড়ী ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ফায়ারম্যান আবদুল মতিন। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন ওই আস্তানায় থাকা পাঁচ জঙ্গি। এ ঘটনায় আহত হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী, গোদাগাড়ী থানার এএসআই উৎপল কুমার ও কনস্টেবল তৌহিদুল ইসলাম। নিহত জঙ্গিরা হলেন সাজ্জাদ আলী (৫০), তার স্ত্রী বেলি বেগম (৪৫), ছেলে আল আমিন (২৫), মেয়ে কারিমা খাতুন (১৭) এবং বহিরাগত যুবক আশরাফুল। সাজ্জাদ ও বেলি ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মতিনকে কুপিয়ে জখম করেন। সাজ্জাদের আরেক মেয়ে সুমাইয়া তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সুমাইয়ার দুই সন্তান জুবায়ের (৭) ও দেড় মাস বয়সী আফিয়াকে পুলিশ ওই আস্তানা থেকে উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, ওই বাড়িটি কাপড় ব্যবসায়ী সাজ্জাদ আলীর। দেড় মাস আগে ফসলের মাঠে তিনি মাটি আর টিন দিয়ে বাড়িটি বানান। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি দিয়ে বাড়ির মাটি গলানোর চেষ্টা করেন। গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সি বলেন, সাজ্জাদের মেয়ে সুমাইয়ার স্বামী জহুরুল ইসলাম নব্য জেএমবির সদস্য। ছয় মাস আগে নাশকতার মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে জহুরুল গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। জহুরুলের শ্বশুর সাজ্জাদ একসময় জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে জামাতার উৎসাহে তিনি নব্য জেএমবির কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে দ্বিতীয় দিনের মতো এ অভিযান শুরু হয় বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে আসা ১২ সদস্যের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ও স্থানীয় পুলিশ মিলে অভিযানটি চালায়। অভিযান শুরুর পর বিকট শব্দে কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানোর কারণে এই শব্দ বলে জানায় পুলিশ।
জামায়াত থেকে নব্য জেএমবি : বেণিপুরের জঙ্গি আস্তানায় ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণ’ ঘটিয়ে নিহত পাঁচজনের মধ্যে চারজন একই পরিবারের সদস্য। পরিবারের কর্তা সাজ্জাদ আলী জামায়াতের রাজনীতি থেকে নব্য জেএমবির কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ জানায়, স্ত্রীর সূত্রে তিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া জমিতে মাস দেড়েক আগে বাড়িটি বানান। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেখানেই থাকতেন। গোদাগাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিফজুর আলম মুন্সি বলেন, জহুরুলের শ্বশুর সাজ্জাদ একসময় জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে জামাতার উৎসাহে তিনি নব্য জেএমবির কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। সাজ্জাদ ও তার ছেলে আল আমিন ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন। এই পরিবারটি যে এমন কাণ্ড ঘটাবে, পুলিশ ধারণাই করতে পারেনি। স্থানীয়রা জানান, দুই বছর আগে থেকে সাজ্জাদের চলাফেরা সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। বাড়িতে অপরিচিত লোকের আনাগোনা বেড়ে যায়।
লাশ নেবেন না মা : নিহত পাঁচ জঙ্গির লাশ গ্রহণ না করার কথা জানিয়েছেন সাজ্জাদের মা মারজান বেওয়া। বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘ছেলে, ছেলের বউ সবাই দেশবিরোধী কাজ করেছে। আমি তাদের লাশ নেব না। পুলিশ যা ইচ্ছা করুক।’ মারজান বেওয়া ছোট ছেলে মুক্তার আলীর সঙ্গে হাবাসপুরে থাকেন। অতিরিক্ত ডিআইজি নিশারুল আরিফ জানান, লাশ নেওয়ার জন্য সাজ্জাদের স্ত্রী বেলির মা ও সাজ্জাদের ভাই মিনারুলকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রাজশাহী শাখার মাধ্যমে লাশগুলো সমাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মতিনের বাড়িতে কান্নার রোল : কান্না থামছে না ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান আবদুল মতিনের স্ত্রী-সন্তানের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন অসহায় পরিবারটি। গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের ভাটা গ্রামে আবদুল মতিনের বাড়িতে গেলে তার স্ত্রী তানজিলা বেগম জানান, স্বামীর এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। বাবাকে হারিয়ে তার সন্তানদেরও একই অবস্থা। মেয়ে জেসমিন আরা (১৫) নবম শ্রেণির ছাত্রী। ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল মারুফ (১০) ষষ্ঠ শ্রেণির। বাবার মৃত্যুতে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মতিন নিহতের ঘটনায় রাজশাহী ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় উপ-পরিচালক নুরুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স পরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল নেওয়াজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে কমিটি গঠনের কথা জানান। কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। এর আগে তিনি নিহত মতিনের লাশ দেখতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে যান। এ সময় তার পরিবারকে ২০ হাজার টাকার অনুদান দেন। এ ছাড়া পুলিশ সদর দফতর থেকে মতিনের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।