হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ, যা একই সঙ্গে আর্থিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিকতার আলোয় উদ্ভাসিত। এমন সমন্বয় অন্য কোনো ইবাদতের ভেতর পাওয়া যায় না। যদিও হজের নিয়ত, কাফেলাবদ্ধ হওয়া ও পরিকল্পনা ব্যক্তি করে থাকে, তবু আল্লাহর তাওফিক হলেই করা যায়। হজের জন্য শরিয়ত আর্থিক সামর্থ্যের শর্তারোপ করেছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে টাকা নয়, হজের জন্য প্রয়োজন সৌভাগ্যের; নতুবা জেদ্দা ও রিয়াদের বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত এবং আমেরিকা ও ইউরোপের শতকোটি টাকার মালিকরা হজ ও বায়তুল্লাহর দর্শন থেকে বঞ্চিত হতো না।
সত্য হলো আল্লাহর ভালোবাসার আগুন, অন্তরের জ্বালা ও ব্যাকুলতা একটি আল্লাহ প্রদত্ত উপহার, যা তিনি তাঁর প্রকৃত প্রেমিকদের দিয়ে থাকেন। ব্যথিত হৃদয় ও ব্যাকুল প্রাণকে আল্লাহর তাঁর কাছে ডেকে নেন। একজন হাজির প্রতিটি আচরণে এক ধরনের পাগলামি প্রকাশ পায়, তার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে প্রজ্ঞার ঝলক দেখা যায়। হাজি যখন মিকাত থেকে কাফন সদৃশ দুটি সাদা চাদর পরিধান করে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ (আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির)—এই ঈমানী স্লোগান দিয়ে রওনা হয়, তখন আকাশের ফেরেশতারা পর্যন্ত তাকে হিংসা করতে থাকেন।
যখন একজন হাজি ঘরবাড়ির আরাম-আয়েশ ছেড়ে, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে এসে, এলোমেলো চুল আর কাঁপা কাঁপা হাতে অশ্রুসিক্ত চোখে নিজের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে ডাকে, তখন আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় ঢেউ উঠে যায়। এ সময় একজন মুমিন বান্দা বৈধ যা কিছু চায় তা সঙ্গে সঙ্গে কবুল করে নেওয়া হয়। দয়ালু আল্লাহ বান্দার শূন্য ঝুলি ক্ষমা ও অনুগ্রহে ভরে দেন। ফলে ভিক্ষুকরা রাজা হয়ে যায় আর দরিদ্র হয় মুকুটধারী।
কোনো একজন প্রেমিক দরবেশ বলেন, ‘আমি আমার চোখকে ঈর্ষা করি, কারণ সে তোমার সৌন্দর্য দেখেছে। আমি আমার পায়ে লুটিয়ে পড়তে চাই, কারণ সে তোমার গলিতে হেঁটে গেছে। আমি আমার হাতে চুমু খেতে চাই, কারণ সে তোমার আঁচল ধরে নিজের দিকে টেনেছে।’
বর্তমানে মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আধুনিক বিমান অথবা আরামদায়ক গাড়িতে আরোহণ করে পবিত্র ভূমিতে উপস্থিত হয়। কিন্তু অতীতে নিষ্কলুষ প্রেমে পূর্ণ কাবার দর্শনার্থীরা হাজার হাজার মাইলের ধুলাবালি গায়ে মাখার পর হজের সৌভাগ্য অর্জন করত এবং দৃষ্টিকে আল্লাহর প্রেমে অভিষিক্ত করত।
হজের সফরে একজন মানুষের চিন্তাভাবনায় নতুন ঈমানী দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়। তাঁর বিবেক প্রশ্ন তোলে—পাথরের তৈরি এক ভবনের চারপাশে ঘোরার অর্থ কী? সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানোর ফল কী? কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ) চুমু খাওয়ার প্রয়োজন কী? প্রতীকী স্তম্ভে কঙ্কর নিক্ষেপ করলে শয়তান কি সত্যিই মারা যাবে? লাখ লাখ পশু জবাই করার পেছনে উদ্দেশ্যই বা কী? এমন শত শত প্রশ্ন এসে অন্তর্জগৎ এলোমেলো করে দেয়। এসব প্রশ্নের উত্তর যুক্তিবাদী বুদ্ধির কাছে নেই, তবে প্রেম আর আত্মোৎসর্গের ধারায় এর জবাব মেলে। আল্লামা ইকবাল বলেন ‘যুক্তি তো কেবল সমালোচনাতেই ব্যস্ত, আর প্রেম—তার ওপর রাখো কাজের ভিত।’
ভালোবাসা বলে, ইহরাম কাফনের কাপড় নয়, বরং এটি প্রিয়তমের প্রেমের পোশাক। যে পোশাক পরেছিলেন ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ.), এটা পরিধান করেছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ (সা.)। হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) চুম্বন করার অর্থ শুধু এটুকুই নয় যে এটি জান্নাত থেকে এসেছে, বরং এটি সেই স্থান, যেখানে প্রিয় নবী (সা.) চুমু দিয়েছেন। তাঁর অনুকরণে আমরা চুমু খাই। সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো মনে করিয়ে দেয় মহীয়সী নারী হাজেরা (আ.)-কে। যিনি তাঁর প্রভুর প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস, নির্ভরতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রমাণ করেছিলেন। শয়তানের প্রতীকী স্তম্ভে কঙ্কর নিক্ষেপ করা কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। আর তা এ কথার প্রতীক যে পার্থিব সম্পর্ক ও ভালোবাসাগুলোও আল্লাহর আদেশের কাছে অবনত হয়ে থাকবে। জীবজন্তুর গলায় ছুরি চালানো আসলে নিজের নফস ও কামনা-বাসনার কোরবানি দেওয়া। আল্লামা ড. ইকবাল বলেন, ‘বুদ্ধি, হৃদয় এবং দৃষ্টির প্রথম পথপ্রদর্শক ভালোবাসা যদি প্রেম না থাকে, তবে শরিয়ত ও দ্বিন হয়ে যায় কেবল কল্পনার মূর্তি।’
আকবর ইলাহাবাদী চমৎকার বলেছেন, ‘ভালোবাসা অত্যন্ত সংবেদনশীল, যুক্তির ভার সে বহন করতে পারে না।’
আল্লাহ তাআলা সবার ওপর দয়া করুন। এই বরকতময়, সৌভাগ্যমণ্ডিত ও রহমতের সফরে শামিল করে নিন। আমিন।
বিডি প্রতিদিন/কেএ