কর্মঘণ্টা কমিয়ে ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের অফিস খুলেছে। খুলে দেওয়া হয়েছে শিল্পকারখানাগুলো। গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। তাতে ঘর থেকে বের হয়েছেন নগরবাসী। কেউ অফিসে, কেউ প্রয়োজনীয় কাজ সারতে বেরিয়েছেন। তাতে স্বল্প সময়ে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়। সীমিত সময়ে কারফিউ শিথিলে নগরবাসী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তবে কারফিউ শিথিল থাকলেও সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সার্বক্ষণিক টহলে ছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত বৃহস্পতিবার দিনভর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে রাজধানীতে। এদিন রাতে বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা। তারও আগে বন্ধ হয় মোবাইল ইন্টারনেট। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে না আসায় শুক্রবার রাতে কারফিউ জারি করে সরকার। সারা দেশে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। আর রবিবার, সোমবার ও মঙ্গলবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে এলে কাউফিউ শিথিলের সময়সীমা বাড়ানো হয়। পাশাপাশি সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। খুলে দেওয়া হয় অফিস, ব্যাংক, কারখানাও।
গত কয়েক দিনের তুলনায় গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীতে মানুষের চলাচল বেশি দেখা গেছে। সড়কে মিলেছে রিকশা-সিএনজি। গণপরিবহনও ছিল পর্যাপ্ত। ঢাকার ফার্মগেট, মিরপুর, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, কল্যাণপুর, বনানী, তেজগাঁও, মহাখালীসহ বিভিন্ন রাস্তায় প্রচ- যানজটও দেখা গেছে। মহাখালী থেকে গুলশান-১ নম্বর হয়ে বাড্ডার সড়কেও দেখা গেছে যানজট। একই পরিস্থিতি রামপুরা থেকে নতুনবাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর সড়কেও। আবার কোনো কোনো জায়গায় গণপরিবহন না পাওয়ায় এবং যানজটের কারণে অফিসগামী যাত্রীরা বিপাকে পড়েছেন। গত কয়েক দিনের বন্দিদশা থেকে বের হতে পারায় জনমনে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। কেটে যাচ্ছে শঙ্কাও। সাধারণ মানুষ বলছে, গত কয়েক দিনে সৃষ্ট পরিস্থিতি ছিল ভয়ংকর, আতঙ্কের। কারফিউ জারির পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
শিল্প, পোশাক কারখানা ও ব্যাংক খুলেছে : টানা চার দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল সকাল থেকে শিল্প, পোশাক কারখানা খুলেছে। তিন দিন পর খুলেছে ব্যাংক। শিল্প ও পোশাক কারখানায় উপস্থিতি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা কম থাকলেও ব্যাংকে গ্রাহক ছিল মোটামুটি। দেশব্যাপী সহিংসতার ঘটনায় টানা পাঁচ দিন সারা দেশে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট। ফলে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা?উত্তোলন করতে পারেনি গ্রাহক। এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা গেলেও লম্বা ছুটির কারণে অনেক ব্যাংকের বুথে টাকা ছিল না। ফলে নগদ টাকার সংকটে পড়ে গ্রাহক। তিন দিন পর খোলা হলে ব্যাংকের সব শাখায় গ্রাহকের ভিড় দেখা যায়।
গতকাল সকাল ১১টায় ব্যাংক খোলার পর টাকা তোলা ও জমা দেওয়া শুরু করেন গ্রাহকরা। শাখাগুলোতে খুব কমও না আবার খুব বেশি গ্রাহকও ছিল না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। গতকাল রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন, গুলশান, ভাটারা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য সেবার তুলনায় টাকা তোলা এবং জমা দেওয়া গ্রাহকই ছিল বেশি। এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এশিয়ার বসুন্ধরা শাখার অপারেশন ম্যানেজার শাহিদুল হক গতকাল বলেন, আমাদের ধারণা ছিল কয়েক দিন পর মাত্র চার ঘণ্টার জন্য ব্যাংক খোলার পর গ্রাহকের বিশাল চাপ পড়বে। বাস্তবে তাই হলো। এর মধ্যে যারা এসেছিলেন অধিকাংশই টাকা জমা ও তোলার জন্য।
খুলেছে পোশাক কারখানা : কারফিউয়ের কারণে বন্ধ থাকার পর গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে এবং গতকাল ঢাকা ও গাজীপুরের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা খুলেছে। গত মঙ্গলবার রাতে বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান কচির নেতৃত্বে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে তার বাসভবনে বৈঠক করেন। এ সময় পোশাক কারখানাগুলো যাতে নিরাপদে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে পারে সে জন্য সহযোগিতা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, বিজিএমইএ সদস্য সকল কারখানার শ্রমিক ভাইবোন, মিড লেভেল কমীরা এবং ব্যবস্থাপকরা গতকাল থেকে কাজে যোগ দিয়েছেন। এদিকে দেশের অধিকাংশ শিল্পকারখানাও গতকাল চালু হয়েছে।
সরগরম ছিল সচিবালয় : টানা পাঁচ দিন পর গতকাল সকাল থেকেই কর্মকর্তা কর্মচারীদের কারণে সরগরম ছিল প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ও। তবে প্রবেশে ছিল বেশ কড়াকড়ি। সকাল ১১টা থেকে অফিস শুরু হলেও যথা সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ সচিবকে উপস্থিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়াও এদিন অধিকাংশ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও অফিস করেছেন। এদিকে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রটিতে সকাল থেকে প্রবেশে ব্যাপক তল্লাশি করা হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল জোরদার। সচিবালয়ের সামনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়। এ ছাড়া গাড়ি ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি কম লক্ষ্য করা গেছে।
ঢাকা থেকে ছেড়েছে দূরপাল্লার বাস : সীমিত যাত্রী নিয়ে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে গেছে দূরপাল্লার বাস। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া যাত্রীদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কাজে এসে কারফিউতে আটকা পড়েছিলেন। গতকাল রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা যায়, বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে। তবে যাত্রীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ চিকিৎসা নিতে ঢাকায় এসেছিলেন, কেউ আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে কেউবা ব্যক্তিগত কাজে। তারা সবাই কারফিউতে ঢাকায় আটকা পড়েছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তারা।
এদিকে স্বল্প সময়ে স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ফিরেছে ঢাকার বাইরের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো। রাজশাহী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কারফিউ শিথিল থাকায় রাজশাহীতে জনজীবন ছিল স্বাভাবিক। সকাল থেকে নগরীতে চলাচল করেছে বিভিন্ন যানবাহন। ছেড়ে গেছে দূরপাল্লার বাসও। গন্তব্যে যেতে বাস টার্মিনালে ভিড় ছিল মানুষের। এদিনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সেনা সদস্যদের টহল ছিল জোরদার। স্বাভাবিক চলাফেরা ছিল রংপুরেও। নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গতকাল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল হওয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে রংপুর। দুপুরে নগরীর প্রধান সড়কে ছিল যানজট। অফিস আদালতে লোকজনের উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক। দূরপাল্লার এবং আন্তনগর বাস চলাচল শুরু হওয়ায় যাত্রীদের মাঝে ছিল স্বস্তি। গতকাল রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসব দৃশ্য দেখা গেছে। টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলে গতকাল সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করার পর জনজীবন স্বাভাবিক হয়েছে। সকাল থেকেই সরকারি সময়সূচি অনুযায়ী অফিস এবং ব্যাংকের শাখাগুলোর খুলেছে। স্বাভাবিকভাবে চলছে অফিস ও ব্যাংকের কার্যক্রম। সেবা নিতে এসে কাউকে ভোগান্তিতে পড়তে দেখা যায়নি। এদিকে শহরের সব দোকানপাট ও শপিং মল এবং বিপণিবিতানগুলো খুলেছে।