সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তন করে আনুপাতিক ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। সেইসঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংবিধান, নির্বাচনি আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা। গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। সেমিনারটির আয়োজন করে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি)। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। প্রধান আলোচক ছিলেন নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও আলোচনায় অংশ নেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ পুরো প্রক্রিয়া সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তিনি আরও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার তথা প্রশাসন ও পুলিশ, রাজনৈতিক দল, ভোটার, গণমাধ্যম- সবার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একটা আলাপ-আলোচনা হতে পারে। আমাদের কতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হবে, ভোটার তালিকা করতে হবে। রাজনৈতিক দল সবাই মতামত ব্যক্ত করুক। কিছু সংস্কারের জন্য সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিশন দেখবে। আমরাও দলগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব নেব। সংখ্যানুপাতিক ভোটের জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন সিদ্ধান্ত দিলে সেভাবে প্রস্তাব করব। সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগামী ১০০ বছর থাকা উচিত। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন ভালো হয়েছে। সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি অভিভাবকের পরিচয় দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচিত হলেও পরে অন্যান্য দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। আজ যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে ২০২৩ সালের জুলাইয়েই এসব সংস্কারের কথা ঘোষণা করেছে বিএনপি। ‘আমাদের সমস্যা অনেক জায়গায়। সব জায়গায় কিছু কিছু নতুন জিনিস সংযুক্ত করা দরকার’ বলে যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স তাঁর বক্তব্যে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু পরিমাণে সংবিধান সংস্কার করা দরকার। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট এবং প্রাদেশিক সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ‘না ভোট’ প্রবর্তন করতে হবে।
প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, সংবিধানে জনগণ ক্ষমতার মালিক। কিন্তু জনগণ কখনো সে মালিকানা ফিরে পেয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যখন যারা ক্ষমতায় আসেন তখন তারা সবকিছু নিজেদের মতো সাজান। নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্যে আসা যায়নি। বরং দলগুলোর প্রতি এক ধরনের অনাস্থা এসেছে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনো সে জায়গায় যায়নি যে দলীয় সরকারের অধীনে তারা সুষ্ঠু ভোট করবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখা জরুরি। সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় ভোট করতে হবে। স্থানীয় সরকার ভোট নির্বাচন কমিশন করবে কি না সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আনুপাতিক ভোট হলেও সবার অংশগ্রহণ থাকবে। ছোট ছোট দল ক্ষমতায় আসতে পারবে। সংবিধানে ৪৮ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক এ সংসদ সদস্য। রাজনৈতিক দলগুলোর সুষ্ঠু নির্বাচন করার আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে দাবি করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, দলগুলো যখন চায় আমি ম্যানিপুলেট করব, তাহলে তা করা যায়। প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। জোনায়েদ সাকি বলেন, তিন থেকে পাঁচটি নির্বাচন নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হতে হবে। মানসিকতার বদল আইন করার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে না। যার ফলে হয়তো আমরা একটা জায়গায় পৌঁছাব, যেখানে দলীয় সরকারে অধীনে ভোট করা সম্ভব।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, কমিশন নিজেই কমিশন। বদিউল আলমকে সরাসরি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে দিলে পারত। সংস্কার শব্দটা বড় করে দেখা দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আইনি যে কাঠামো আছে এগুলো ব্যবহার করে স্বচ্ছ নির্বাচন করা যায়। প্রার্থীরা পছন্দের ডিসি-এসপি নেওয়ার জন্য তদবির করেন।
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রথা বাতিল চেয়েছেন সাবেক শিবির সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক ভোট চেয়েছি আমরা। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচনের জন্য সংবিধানে সংশোধন এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফেরত আনার কথা বলেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে জনগণের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। আরএফইডির সভাপতি একরামুল হকের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান আদিব, আরএফইডির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর প্রমুখ।