দুনিয়াজুড়ে দেশে দেশে ফুটবল সংস্কৃতির অভিভাবক হলো ক্লাব। সেই প্রথম থেকেই ফুটবলকে লালন-পালন, নতুন প্রতিভার বিকাশ, ধারাবাহিকতার সঙ্গে খেলোয়াড় সৃষ্টি এবং খেলাকে জনপ্রিয় করার পেছনে ফুটবলের প্রাণভোমরা ক্লাবগুলোর অবদান সব সময় স্মরণীয়। খেলোয়াড় তৈরি করে ক্লাবগুলো তাদের ‘সার্ভিস’ নেয়, পাশাপাশি প্রয়োজনে জাতীয় দলকে খেলোয়াড় জোগান দিয়ে সাহায্য করে।
খেলোয়াড় জন্মগ্রহণ করে না। খেলোয়াড় তৈরি করতে হয়। আর এই কাজটি করে ক্লাব তাদের একাডেমির আওতায় পরিকল্পনামাফিক প্রশিক্ষণের (আবাসিক/অনাবাসিক) মাধ্যমে। পেশাদার ফুটবলে এই কর্মসূচি ক্লাবগুলোর দায়বদ্ধতার মধ্যেই পড়ে। বাংলাদেশে এবারই প্রথম বসুন্ধরা গ্রুপের ক্লাব বসুন্ধরা কিংস তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বয়সভিত্তিক তিনটি গ্রুপে ভাগ করে ৬-১১, ১১-১৫ ও ১৫-১৮ অনুশীলন শুরু করতে যাচ্ছে।
আজ ৪ সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে অনাবাসিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। প্রতিটি সেশন হবে ছয় মাসের। অনুশীলন হবে সপ্তাহে তিন দিন। কিংসের একাডেমির স্লোগান হলো ‘আজকের ফুটবল আগামীকালের পেশা’।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, আর্সেনাল, ম্যানসিটি প্রভৃতি একাডেমির কার্যক্রম তো ফুটবল দুনিয়ার আলোচিত এবং অনুকরণীয়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ক্লাবগুলো কখনো পরিকল্পনামাফিক একদম ‘এন্ট্রি লেবেল’ থেকে খেলোয়াড় সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়নি। স্থানীয় রেডিমেট এবং বাফুফের অনুমোদিত খেলোয়াড়রাই ভরসা। এতে দেশের ফুটবল স্বাবলম্বী হতে পারেনি। গত ৫৩ বছরের ফুটবল মাঠের ছবি দেশের ফুটবলের সঙ্গে প্রতারণা করার দলিল।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় বসুন্ধরা কিংসের ফুটবলে আগমন সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের সঙ্গে বিকশিত হতে পেরেছে বলেই ক্লাবটি দেশের ফুটবলের প্রেক্ষাপট এবং রং পাল্টে দিয়েছে। প্রথম থেকেই হেঁটেছে ফুটবলে সংস্কারের পথ ধরে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমে ক্লাবটি দেশের মানচিত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এবং এর বাইরে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে একমাত্র ‘সত্যিকারের পেশাজীবী’ ক্লাব হিসেবে আলোচনার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। ঘরোয়া পেশাদার ফুটবল লড়াইয়ে সাফল্যের ক্ষেত্রে অতীতের সব ধরনের রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। আধুনিক চিন্তা-ভাবনায় উজ্জীবিত ক্লাবটি প্রথম থেকেই দেশের ক্লাব ফুটবলে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। ক্লাবটি হতে পেরেছে অন্যান্য ক্লাবের কাছে আদর্শ এবং অনুকরণীয়। ক্লাবটি শুধু দেশের ফুটবলে সেরা আসনে অধিষ্ঠিত হয়নি, খেলারজগতে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই ‘ব্র্যান্ডিং’ অর্থের অঙ্কে মাপা যায় না।
বসুন্ধরা কিংসের জন্ম ২০১৬ সালে। ক্লাবটি প্রথম বছর পাইওনিয়ার লীগ খেলতে নেমেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এর পরের বছর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন (২০১৭) লীগে অংশগ্রহণের সব শর্ত পূরণের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন লীগে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লীগে অংশগ্রহণ (২০১৮-২০১৯) নিশ্চিত করে। এদিকে ২০১৭ সাল থেকে গ্রুপ ফুটবল অন্তপ্রাণ মো. ইমরুল হাসানকে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করে সব দায়দায়িত্ব অর্পণ করে। সেই থেকে এই স্বপ্নচারী মানুষটি দেশের সেরা দল বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি, সুশাসন এবং শতভাগ পেশাদারির মোড়কে নিজে এবং তাঁর সহকর্মীদের মুড়িয়ে।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের মানোন্নয়ন, ক্রীড়াচর্চাকে পৃষ্ঠপোষকতা এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পেছনে আছে গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের খেলাধুলার প্রতি গভীর অনুরাগ এবং ভালোবাসা। নিজে একসময় হকি খেলেছেন। আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যরাও ক্রীড়ানুরাগী। দেশের ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে তাঁদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ‘ভিশন’ এবং স্বপ্ন আছে। প্রথম থেকেই আহমেদ আকবর সোবহান বলেছেন, ‘জাতির অগ্রগতির অংশীদার হিসেবে দেশের খেলাধুলার পরিধি ও পরিসরের বৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণে সহায়তা করতে বসুন্ধরা গ্রুপ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
মো. ইমরুল হাসানের সঙ্গে একদিন ফুটবল নিয়ে কথা হচ্ছিল। বললেন, “আমরা চ্যাম্পিয়নশিপ লীগে তখন চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছি। পেশাদার লীগের জন্য দল গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছি। একদিন চেয়ারম্যান স্যার জানতে চাইলেন আমরা দল নামালে কি মানুষ খেলা দেখতে আসবে। বললাম, নতুন কিছু করতে হবে। বিশ্বকাপে খেলা ফুটবলার, দেশের ভালো খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠন করতে পারলে আবার মানুষ ফুটবল মাঠে ফিরে আসবে। চেয়ারম্যান স্যার এগিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত দিলেন। এরপরের ইতিহাস তো সবার সামনেই ঘটেছে। আরেকটি ঘটনা বলি, প্রিমিয়ার লীগে খেলতে নামব। একদিন ভয়ে ভয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান স্যারের কাছে বললাম, প্র্যাকটিস মাঠের জন্য সাত-আট বিঘা জমি হলেই চলবে। তাঁর আগ্রহ এবং উৎসাহে এটা হয়েছিল ৫০ বিঘা। শেষে তো ৩০০ বিঘার বিশাল ‘মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্স’। বিভিন্ন খেলা একই জায়গায়। সত্যি ‘আগামী এখানেই।’”
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রথম পেশাদার ক্লাব হিসেবে বসুন্ধরা কিংসের ভেন্যুতে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার উদ্বোধন করেন গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। আধুনিক এই ফুটবল অ্যারেনা শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য এটি অনেক প্রাপ্তি এবং গর্বের বিষয়। আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যারেনা উদ্বোধনের পর গ্রুপের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমরা যে ইনডোর একাডেমি করতে যাচ্ছি, সেখানে চেষ্টা করব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাব থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিতে। ইউরোপের অনেক ক্লাব ফ্র্যাঞ্চাইজি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।’ তিনি আরো বলেছেন, “আশা করি এক বছরের মধ্যে কিংস অ্যারেনায় আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া আশা করছি ২০২৪ সালের ‘থার্ড কোয়ার্টারে’ সম্ভব হবে কিংস একাডেমির কার্যক্রম যদি আবাসিক না হয় অনাবাসিকভাবে বয়সভিত্তিক গ্রুপের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।”
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে। ২০২৪ সালের ৬ জুন পর্যন্ত এই অ্যারেনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। আর বয়সভিত্তিক তিনটি গ্রুপকে নিয়ে অনুশীলন শুরু হতে যাচ্ছে আজ ৪ অক্টোবর থেকে।
একাডেমির গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সব সময় কথা বলেছেন কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসান। সম্প্রতি মিডিয়াকে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা অনেক, কিন্তু আমরা বাফুফে বা ক্লাব সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে পারিনি। ফুটবলের নতুন করে জাগরণের জন্য জাতীয় দলের সাফল্য অপরিহার্য। সেখানে আমরা পিছিয়ে পড়েছি আমাদের পাইপলাইন সমৃদ্ধ না হওয়ায়। সেই চিন্তা থেকেই এই একাডেমির চেষ্টা, যদিও এখনই এটিকে পূর্ণাঙ্গ একাডেমি বলছি না অনাবাসিকভাবে শুরু করায়। ভবিষ্যতে ডরমিটরিও হবে। কিংসের ক্লাব ভবন সম্পন্ন হওয়ার পর তা আবাসিক করার পাশাপাশি বাইরের কোনো একাডেমির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সেখানকার কোচদের আনার পরিকল্পনা আমাদের আছে।’
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া