কুয়াশার সাদা চাদরে মোড়া শীতের সকাল। গায়ের মেঠো পথ ধরে ছোট ছোট পায়ের স্পর্শে জেগে উঠছে নিস্তব্ধ প্রকৃতি। অভিভাবকদের হাত ধরে স্বপ্নের পানে ছুটছে শিশুরা। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আর অজানা জগতের আহ্বান যেন তাদের চোখে এক নতুন আলোর বার্তা ছড়ায়। বই বিতরণের এ দিনটি শুধু শিক্ষার নয়, বরং এক নীরব বিপ্লবের প্রতীক, যেখানে শিশুদের কল্পনায় ফুটে ওঠে অজেয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বছরের শুরুতে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পেতে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের যেন সীমা নেই। তাইতো নতুন বছরের নতুন বইয়ের ঘ্রাণে বিদ্যালয়ের পানে ছুটে আসছে শিক্ষার্থীরা।
পটুয়াখালী জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীর চরইমারশন এলাকা। এখানে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে গড়ে তুলেছে এক অনন্য সৌন্দর্যের মঞ্চ। কিন্তু এই রূপ-লাবণ্যের ছায়ায় লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষার প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা। সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে এখানকার শিশু-কিশোররা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে, এই প্রান্তিক এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে এসেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তাদের আর্থিক সহযোগিতায় স্থাপিত ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল’ আজ এই অঞ্চলের নতুন প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে।
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে শিশু শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে চরইমারশন এলাকার শান্ত পরিবেশে যেন ছড়িয়ে পড়েছে এক আলাদা উদ্দীপনা। বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে আয়োজন করা হয়েছে নতুন বই বিতরণ অনুষ্ঠানের। সূর্যোদয়ের আলো ঠিক যেমন নতুন দিনের বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি নতুন বইয়ের এই উৎসব যেন চরইমারশনের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও বই বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান। তার উপস্থিতি যেন গোটা অনুষ্ঠানে এক আলাদা মাত্রা এনে দেয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাদের উৎসাহিত করেন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বসুন্ধরা গ্রুপ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই স্কুলের মাধ্যমে চরইমারশনের শিশুদের জন্য ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ সুগম হয়েছে। এই শিশুদের চোখে স্বপ্ন বোনার কাজটি বসুন্ধরা গ্রুপ যে কাজ শুরু করেছে, তা আমাদেরও উদ্বুদ্ধ করে। বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই এখানকার শিশুদের জীবনে এসেছে এক আমূল পরিবর্তন। চরইমারশনের মতো দুর্গম এলাকায় যেখানে শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে এখন প্রতিদিন বইয়ের পাতায় আঁকা হয় নতুন স্বপ্ন।
স্থানীয় অভিভাবকরা জানান, তাদের সন্তানদের বই হাতে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্যটি এক সময় ছিল কল্পনার মতো। আজ সেই কল্পনা বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
শিক্ষার্থীর অভিভাবক জহির মাতুব্বর বলেন, আগে আমরা ভাবতাম, আমাদের ছেলে-মেয়েরা কখনো পড়ালেখা করতে পারবে না। কিন্তু এখন তারা নিয়মিত স্কুলে যায়। আজ যখন নতুন বই পেল, তখন তাদের মুখের হাসি দেখে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করি।
এদিকে, বই বিতরণ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেবাশীষ ঘোষ বলেন, বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই এখানকার শিশুদের জীবনে এসেছে এক আমূল পরিবর্তন। চরইমারশনের মতো দুর্গম এলাকায় যেখানে শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। আমরা জানি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল শুধু শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে না, এটি চরইমারশনের মানুষের মনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে।
নতুন বই পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহান মাহমুদ বলে, নতুন বইয়ের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে। এই বইগুলো দিয়ে আমি অনেক কিছু শিখতে পারব। আমার স্বপ্ন আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো।
এ বিষয়ে বসুন্ধরা শুভসংঘের রাঙ্গাবালী শাখার সমন্বয়ক এম সোহেল বলেন, চরইমারশন যেখানে এক সময় শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, সেখানে আজ বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। নতুন বই বিতরণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের শিশুরা শুধু বই পায়নি, তারা পেয়েছে স্বপ্ন দেখার সাহস। বসুন্ধরা গ্রুপের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। শিশুদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তিনি বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের এই উদ্যোগ শুধু বই বিতরণেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদি। চরইমারশনের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে তারা একটি শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলতে চায়।
বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাওহীদ বলেন, শুধু পাঠ্য বই নয়, এখানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের সবদিক থেকে উন্নত করার চেষ্টা করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। নতুন বছরের প্রথম দিকে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার এই আয়োজন যেন চরইমারশনের মানুষকে জানিয়ে দিল, অন্ধকার যত গভীরই হোক, শিক্ষার আলো সেই অন্ধকার দূর করবেই।
বই বিতরণ অনুষ্ঠানে আলোচনা শেষে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে নতুন বই তুলে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান।
এ সময় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেবাশীষ ঘোষ, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিন ফরাজি, উপজেলার কাউখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সালাম, কোড়ালিয়া এরহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সরোয়ার হোসেন, নাগরিক টেলিভিশন ও দেশ রূপান্তরের প্রতিনিধি তুহিন রাজ, নয়া দিগন্তের পায়রা বন্দর প্রতিনিধি রবিন আহম্মেদ, বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের শিক্ষক হাবিবা ও উম্মেহানি প্রমুখ।
বিডি প্রতিদিন/কেএ