চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে চার বছরে নানা অনিয়ম, নিয়োগ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা সঙ্গী করে মেয়াদ শেষ করলেন অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। দীর্ঘ চার বছরে ৫ শত শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রথম এই নারী উপাচার্য। আর এ নিয়োগে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এসব নিয়োগে মিডিয়া হিসেবে কাজ করেছে নিজ কন্যা ও ভাতিজা। শেষ কর্ম দিবসেও ৩৭ জনকে নিয়োগ বিতর্কের জন্ম দিয়ে ইতি টানলেন ভিসির চেয়ার। গত ১৯ মার্চ নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের।
চবির নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের নিয়োগের বিষয়ে বলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ হবে। এখন থেকে যারা যোগ্য এবং মেধাবী তারাই নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাবে।
এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কথা বলেননি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কেএম নূর আহমদকে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি) কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বিধিমালা- কোনো কিছুরই ধার ধারেননি তিনি। ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের উপাচার্য হিসেবে ৪ বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়। এসব নিয়োগ ও অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তীব্র আন্দোলনেও নিয়োগ থেকে বিরত থাকেননি তিনি। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে- উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী, ঊর্ধ্বতন সহকারী, নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস পিয়ন, বুক বাইন্ডার, কম্পিউটার ল্যাব সহকারী, ভোজনালয় সহকারী, পেশ ইমাম, ঝাড়ুদার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে ৬ মাসের জন্য এসব নিয়োগ দিয়ে যান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী নিয়োগের জন্য অনুসরণ করতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। এর মধ্যে শূন্য পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, প্রার্থীদের আবেদন যাচাই, মৌখিক অথবা ব্যবহারিক পরীক্ষা, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশের পর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট যাচাই-বাছাই শেষে নিয়োগের অনুমোদন দেয়। অথচ অধ্যাপক শিরীণ আখতার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দায়িত্বের শেষদিন কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দিয়েছেন কয়েক ডজন নিয়োগ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে বিধি বহির্ভূতভাবে শতাধিক নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এসব নিয়োগে রয়েছে বড় আকারের দেনদরবার। চট্টগ্রামের স্থানীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা এসব নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর গুণগান গাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক নেতাদেরও দিয়েছেন প্রাধান্য। এর আগে ২০২২ সালের ৫ মার্চ চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট। সেসময় শিক্ষক নিয়োগে লবিংয়ের ৫টি ফোনালাপ ফাঁস হয়। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারীকে বলতে শোনা যায়- শিক্ষক পদে ১৬ লাখ, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী পদে ১২ লাখ এবং চতুর্থ কর্মচারী পদে ৮ লাখ টাকা লাগবে নিয়োগ পেতে। এছাড়া চট্টগ্রামের হলে ১৬ লাখ এবং চট্টগ্রামের বাইরের হলে ২০ লাখ টাকা লাগে শিক্ষক হতে। এমন চাঞ্চল্যকর অডিও ফাঁস হওয়ার পরে ফার্সি বিভাগের নিয়োগটি বাতিল হলেও এরপরও থেমে ছিলো না নিয়োগ-বাণিজ্য। ২০২২ সালের ৬ আগস্ট আরও দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়, এতে দেখা যায় নিম্নমান সহকারী পদের কর্মচারী মানিক চন্দ্র দাস নিজেকে সেকশন অফিসার পরিচয় দিয়ে তিন চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেছেন। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যদিও ২০১৮ সাল থেকে দৈনিক মজুরি কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
২০১৯ সালের ৪ নভেম্বরে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। শিরীণ আখতারের সময়ে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ১৩০ জন শিক্ষক এবং ২৩৮ জন কর্মচারী নিয়োগে পেয়েছেন। অপরদিকে কোনোপ্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ১১৫ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৫৭ জন। সর্বমোট ৫৪০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে গেছেন অধ্যাপক শিরীণ আখতার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য সহযোগী অধ্যাপক ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব বলেন, উপাচার্য বারবার বলতেন আমাদের অসংখ্য লোকের প্রয়োজন। কিন্তু ইউজিসি লোকবল দিচ্ছে না, তাই আমি লোক পাঠাচ্ছি। তখন আমরা ৫৪৫তম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে। একটি কমিটি করা হয়েছিল, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদে দেখবেন আসলেই কত লোক প্রয়োজন। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুসারে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু তিনি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত না মেনে অপ্রয়োজনীয় নিয়োগ দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ না হওয়ায় অসংখ্য মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ বা আবেদন করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। পাশাপাশি এখানে সিন্ডিকেটের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সেটিও মান্য করা হয়নি। তাই বলা যায় এসব নিয়োগ অপ্রয়োজনীয় এবং প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল হক বলেন, তিনি (উপাচার্য) নিশ্চিত ছিলেন তিনি আর নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কেউ আসলে নিয়োগ দেয় না। তিনি উপাচার্যের পদকে ব্যবহার করে এবং অনেকটা খাটো করে এ নিয়োগগুলো দিয়েছেন।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল