ফুটবলের সূচনালগ্ন থেকেই দেশে দেশে ক্লাবগুলোর মধ্যে মাঠের লড়াইয়ে শক্তিমত্তা প্রদর্শন, প্রাধান্য বিস্তারকে ঘিরে সমর্থক ও ভক্তদের মধ্যে রেষারেষি, অদ্ভুত স্পর্শকাতরতা এবং উন্মাদনা বিষয়টি সচেতন মহলের অজানা নয়। ফুটবলের ‘প্রাণ ভোমরা’ হলো ক্লাব, তারাই ফুটবলের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে সেই শুরু থেকে এবং সেটি অব্যাহত আছে। ক্লাবগুলোর প্রতি সমর্থক ও ভক্তদের ভালোবাসা, দুর্বলতা এবং প্রত্যাশা সব সময়ই বেশি। ‘উই আর দ্য বেস্ট’ স্লোগানটি ক্লাব সংস্কৃতিতে সব সময় আলোচনার একটি অংশ।
জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী ক্লাবগুলোর লক্ষ্য হলো শিরোপার জন্য লড়াই করা, শিরোপা পুনরুদ্ধার, কোনো মৌসুমে ভালো খেলতে না পারলে, সাফল্য না পেলে পরবর্তী মৌসুমে সমর্থক ও গুণমুগ্ধদের প্রত্যাশা যাতে পূরণ করা সম্ভব হয়, এর জন্য বাস্তবধর্মী চিন্তাশীল পরিকল্পনার মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া। শিক্ষা নেয় বিগত মৌসুমের অভিজ্ঞতা থেকে। ক্লাবগুলোর তো দায়বদ্ধতা আছে। আছে দেশের ফুটবলে ‘কমিটমেন্ট’। ভালো ক্লাবগুলো সময়োপযোগী পরিকল্পনা তৈরি করে সব সময়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনে।
ঘরোয়া ফুটবলে ক্লাবগুলোর এক ধরনের রূপ, আবার যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্লাব দেশের প্রতিনিধিত্ব করে, তখন আবার অন্য রূপ—এটিই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যখন প্রতিনিধিত্ব, তখন আর ক্লাবের সমর্থক ও ভক্তদের মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি হয়ে যায় সর্বজনীন। পুরো দেশ ও জাতির। এর সঙ্গে ভর করে জাতীয়তাবোধ। দেশের ভাবমূর্তি এবং পরিচিতি। এমতাবস্থায় দেশের ফুটবল অনুরাগীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে যে ক্লাব, সেদিকে।
কিছুদিন আগে এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগের প্রিলিমিনারি রাউন্ডে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় আবাহনী লিমিটেড এবং কাতারের দোহায় বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংস যথাক্রমে কিরগিজস্তানের সুরাম ইউনাইটেড এবং সিরিয়ার আনকারমা এফসির বিপক্ষে খেলেছে। আবাহনী লিমিটেড দ্বিতীয় পর্বে যেতে পারেনি পরাজিত হওয়ায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের আরেক প্রতিনিধি বসুন্ধরা কিংস মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী ক্লাবটিকে পরাজিত করে দ্বিতীয় পর্বে স্থান করে নিয়েছে। এটি দেশের ফুটবলের গৌরব। বাংলাদেশের গৌরব। এখন বাংলাদেশের বসুন্ধরা কিংস দেশকে চ্যালেঞ্জ লীগের দ্বিতীয় পর্বে প্রতিনিধিত্ব করবে আগামী অক্টোবর মাসের ২৫, ২৮ ও ৩১ তারিখে যথাক্রমে ওমানের আলসির, লেবাননের আল আনসার ও কুয়েতের কুয়েত এএফসির বিপক্ষে। খেলা হবে কুয়েতে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের ফুটবলকে তুলে ধরার একটি চমৎকার সুযোগ। সুযোগ জাতি চরিত্রের প্রতিফলনের।
বাংলাদেশের ফুটবলে বসুন্ধরা কিংসকে বলা হয় অজেয়। এটি তারা অর্জন করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রিমিয়ার লীগে খেলতে নেমে ছয় মৌসুমের মধ্যে একনাগাড়ে পাঁচবার শিরোপা জিতে দেশের ফুটবলে নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। এতে তাদের নামের সঙ্গে ‘পরাশক্তি’ তকমাটা লেগে গেছে আঠার মতো। দেশে দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের বিবর্তনে কিংসের বড় অবদান আছে। ক্লাবটির রোমাঞ্চকর ফুটবলের প্রেমে পড়ে দেশব্যাপী বিশাল এক সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। মানুষ চাচ্ছে বসুন্ধরা কিংসের কাছ থেকে ধ্রুপদি লড়াই দেখতে। বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি মো. ইমরুল হাসান ২ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠকে বলেছেন, নতুন আর্জেন্টাইন কোচ মারিও গোমেজের হাত ধরে কিংসকে চেনারূপে ফেরানোর বিষয়ে তিনি আশাবাদী। তাঁর কথা হলো, আমরা শুধু গত মৌসুমে সাফল্য পাইনি। সাফল্যের চেয়েও যেটি পীড়া দিয়েছে, সেটি হচ্ছে বসুন্ধরা কিংস চেনারূপে ছিল না। আমরা চাচ্ছি আগে যেভাবে খেলেছে দল, সেটি যেন ফিরিয়ে আনতে পারি। সেই উদ্দেশ্যে লাতিন কোচ এনেছি।
দোহায় দলের সঙ্গে কিংসের বিদেশি কোচ যোগ দেননি। এটি তো হৈচৈয়ের কোনো বিষয় নয়। ‘এবার বুঝবে কিংস কত ধানে কত চাল’। কিংস মাঠে দল নামাবে কিভাবে? আসলে সবকিছুই কিন্তু অজ্ঞতা, না জানা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে কিংসের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য প্রচারণার অংশ। এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগের প্রিলিমিনারি পর্যায়ের খেলায় অনেক অনেক লাইসেন্সধারী কোচের প্রয়োজন নেই। কিংসের স্থানীয় কোচরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। খেলোয়াড়রা দলীয় খেলার মাধ্যমে সাফল্য নিশ্চিত করে দেশবাসীর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। ক্লাবটি যে ক্রমেই জনপ্রিয়তার দৌড়ে এগিয়ে চলেছে, তার প্রমাণ হলো ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ‘ইউটিউবে’ দোহায় অনুষ্ঠিত খেলা দেখেছে। বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করায় বাংলাদেশের কাতার দূতাবাস বসুন্ধরা কিংস দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের সংবর্ধনা দিয়েছে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সভায় নারী জাতীয় দল ও নারী অনূর্ধ্ব-২০ দলের কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানানো হয়েছে। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, এএফসি চ্যালেঞ্জ লীগে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বসুন্ধরা কিংস যে দ্বিতীয় রাউন্ডে ‘কোয়ালিফাই’ করল, এ ক্ষেত্রে অভিনন্দন জানানো তো দূরের কথা, কোনো রকম উচ্চবাচ্য করা হয়নি। কোনো ক্লাব কোনো ক্লাবের সাফল্যকে হিংসার চোখে দেখতে পারে। নিজেদের মধ্যে বিভাজন থাকতে পারে, কিন্তু ফুটবল ফেডারেশন তো দেশের ফুটবলের অভিভাবক। অভিভাবকের জন্য তো সবাই সমান। পরিষদের চেয়ারে বসে তো নীচতা ও নোংরামির সুযোগ থাকার কথা নয়। কেন এই হীনম্মন্যতা এবং পরশ্রীকাতরতা? ফুটবল আর কতকাল অতীতের বিশ্রী মানসিকতার পৃষ্ঠপোষকতা করবে? মানুষ কিন্তু উদ্যমী তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে বাফুফের এই নির্বাচিত কমিটি থেকে অনেক কিছুই প্রত্যাশা করেছে। এখনো করছে। তাবিথ আউয়াল সভাপতি হিসেবে তো সবকিছু একা করতে পারবেন না। তিনি করবেনও না। তাঁর সেই পরিপক্বতা আছে। তাঁকে তো সঠিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামনে সময় আসছে। সবকিছু কিন্তু জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়।
অভ্যন্তরীণ নোংরা রাজনীতি পরিত্যাগের এখনই সময়। শালীনতা ও শিষ্টাচারের দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তির দরকার আছে ফুটবলের। নতুবা ফুটবল ৫৪ বছর ধরে যে ‘কানামাছি’ খেলার মধ্যে আছে—এই খেলা পরিত্যাগ করতে পারবে না। ক্রমেই ফুটবলে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। বাড়ছে বিভাজন এবং বিরোধ। বাড়ছে ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন। একসঙ্গে এক পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করেও একে অপরকে এত হিংসা করা কেন? বসুন্ধরা কিংসের সবচেয়ে বড় দোষ হলো তারা দেশের ফুটবলে এমন সব কাজ করে চলেছে, যা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়—আর এখান থেকেই তাদের বিপক্ষে বিরুদ্ধাচরণের জন্ম। ফুটবলে নেই পরিশীলিত সংস্কৃতির চর্চা। নেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসম্মত সংস্কৃতির চর্চা। বাস্তবতা বিবেচনা না করে অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বড় বিপদের কারণ হবে। এটি ভাবা হচ্ছে। অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া হচ্ছে না। ফুটবলে নেই বাস্তবসম্মত নীতি, সঠিক নির্দেশনা ও সর্বস্তরের সম্মিলিত উদ্যোগ। কেউ কেউ ভাবেন তিনি এবং তাঁরা ছাড়া উপায় নেই।
বসুন্ধরা কিংসের বিপক্ষে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাফুফের কার্যনির্বাহী পরিষদের কয়েকজন কর্মকর্তা সাবেক খেলোয়াড় এবং কিছু সংগঠক হৈচৈয়ের জন্ম দিয়েছিলেন এই বলে যে বসুন্ধরা কিংস জাতীয় দলের অনুশীলনের জন্য খেলোয়াড় ছাড়তে চাইছে না ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলার জন্য। এ ক্ষেত্রে আইন কী বলে? এগুলো অনেকের জানা সত্ত্বেও প্রচারের আলোতে স্থান করার জন্য বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা। এই বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগে আমার কলামে বিস্তারিতভাবে লিখেছি। আর তাই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে চাচ্ছি না। বসুন্ধরা কিংস কর্তৃপক্ষ কখনো কিন্তু বলেনি তারা খেলোয়াড় ছাড়বে না। বসুন্ধরা কিংস ফিফার বেঁধে দেওয়া নিয়মের আগেই খেলোয়াড়দের (জাতীয় ও অনূর্ধ্ব-২৩ দলের) ‘রিলিজ’ করে দিয়েছে এবং তাঁরা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে দেশের বাইরে খেলতে চলে গেছেন।
ফুটবলে বিভাজনরেখা শাণিত হওয়া উচিত নয়। ফুটবলে দরকার ঐকমত্য এবং সবাই সবাইকে বোঝার চেষ্টা করা। সংগঠকদের মধ্যে চিন্তার খুবই প্রয়োজন। তা না হলে পুরনো দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়া যাবে না। সাংবাদিকরা জনগণের চাহিদার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পেশাগতভাবে তাঁরা সত্যের প্রতি অনুগত, ঘটনার প্রতি দায়বদ্ধ—এটাই গণমানুষের বিশ্বাস।
ফুটবলে সমস্যা হলো, অসুখের আগে প্রতিরোধের চেয়ে রোগ-পরবর্তী ওষুধের কথাই বেশি। ‘কিউর’ বেশি, ‘প্রিভেনশন’ কম। অন্তর্ভুক্তিমূলক ফুটবল চত্বরের দেখা মেলেনি গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও। ফুটবল প্রশাসন সব সময় দ্বিধা, অস্পষ্টতা ও সমন্বয়হীনতার এক সংকটময় ধাঁধায় আটকে আছে। যেখানে অন্যরা ফুটবলকে অন্যভাবে ভাবছে, সেখানে দেশে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের একটির পর একটি উদ্যোগ।
বসুন্ধরা কিংস বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ খেলোয়াড় কিউবা মিচেলকে দলে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অনূর্ধ্ব-২১ সাদারল্যান্ড দলে তিনি খেলেছেন। বসুন্ধরা কিংস কেন এই খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, কেন তাঁর ক্যারিয়ার নষ্ট করে দিতে চাইছে, এটি নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক দিন ধরে কথার লড়াই চলেছে—কিউবা মিচেল তাঁর বক্তব্য দেওয়ার পরও। সমস্যা হলো কিউবা মিচেল যদি আবার রবসনের মতো এক পর্যায়ে দলের বাঘ হয়ে দাঁড়ান, তাহলে কী হবে? অন্য কেউ কিউবা মিচেলের প্রতি উৎসাহ দেখিয়েছে এমন খবর তো কোথাও দেখিনি। অযথা নেতিবাচক প্রচারণার জন্ম দিয়ে নিজস্ব দুর্বলতাগুলো থেকে ফুটবল অনুরাগীদের দৃষ্টি অন্যদিকে ধাবিত না করার চেষ্টাই বাঞ্ছনীয়। ফুটবলে ব্যক্তিস্বার্থ, ক্লাবস্বার্থের খেলা অনেক বেশি জমজমাট। জাতীয় স্বার্থের খেলাকে ম্রিয়মাণ করে রাখা হয়েছে। মাঠের বাইরে আত্মঘাতী খেলার পরিণাম নিয়ে ভাবা উচিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও একটি দৈনিকে চোখে পড়েছে, অভিজ্ঞ আর্জেন্টাইন কোচ মারিও গোমেজের সঙ্গে বসুন্ধরা কিংসের চুক্তি স্বাক্ষরের পর মন্তব্য হলো ‘দেখা যাক কত দিন টেকেন এই কোচ।’ লেখা হয়েছে কিংসের হেড কোচ তো আর্জেন্টাইন, কিংসের যারা ব্রাজিল সমর্থক, তাদের উচিত হবে কিংসকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে ভাবা। হায় রে, ব্রাজিলের হেড কোচ তো এখন ইতালিয়ান কার্লো আনচেলত্তি। প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্টে যোগ্যতা এবং প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আবেগ আর উচ্ছ্বাস নয়।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া