নানান জল্পনাকল্পনা মাড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে ৯ সেপ্টেম্বর। নির্বাচন ঘিরে এখন শেষ মুহূর্তের প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা। ক্যাম্পাসজুড়ে চলছে প্রার্থীদের লিফলেট বিতরণ এবং ভোট প্রার্থনা। আচরণবিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্যাম্পাস ও হল এলাকায় কোনো স্থাপনা বা দেয়ালে পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিল লাগানোর সুযোগ নেই। ফলে প্রার্থীরা ক্যাম্পাসে হেঁটে হেঁটে ছাত্রছাত্রীদের কাছে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। আবাসিক হলগুলোতেও শিক্ষার্থীদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন তারা। তবে এরই মধ্যে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেক প্রার্থী। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে দিয়েছেন হুঁশিয়ারিও। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল বলা হয়েছে- ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে সাইবার বুলিং কিংবা কোনো অপপ্রচারের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। গতকাল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচারণায় সরব থাকতে দেখা গেছে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেন গতকাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকাররম ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এ নির্বাচন ষড়যন্ত্রের মুখে পড়লে জাতীয় নির্বাচনও ষড়যন্ত্রের মুখে পড়বে। ডাকসু নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে সরকারের কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন তিনি। ভোট নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, নির্বাচন ঘিরে মব তৈরি ও সাইবার বুলিংয়ের শঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন দুর্বল ভূমিকা পালন করছে এবং প্রশাসন সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আবিদ মন্তব্য করেন- নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্বই প্রমাণ করে যে ডাকসু নির্বাচন ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
গতকাল নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম ডাকসু নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, এ নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করলে পরিণতি শেখ হাসিনার থেকেও খারাপ হবে।
তিনি দাবি করেন, সাইবার বুলিং, প্রোপাগান্ডা এবং বহিরাগতদের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব বিষয়ে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, ভোট বানচালের চেষ্টা চলছে। তবে সব প্রার্থী দায়িত্বশীল আচরণ করলে কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। গতকাল ফেসবুক পোস্ট দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের ভিপি প্রার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঐতিহাসিক ৯ দফার ঘোষক আবদুল কাদের আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমার ডাকসুতে জিতা (বিজয়ী) লাগবে না, কেবল বেঁচে থাকতে চাই। এতটুকু দয়া অন্তত আমাকে দেখানোর অনুরোধ।’
প্রচারণায় অংশ নিয়ে গতকাল স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, প্রচারণা চালাতে গিয়ে কিছুটা সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। আচরণবিধির কারণে ক্যাম্পাসে পোস্টার, লিফলেট লাগানোর সুযোগ নেই। লিফলেট শিক্ষার্থীদের হলে হলে গিয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু মেয়ে হয়ে তো ছেলেদের হলে গিয়ে এ প্রচারণা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। নারী ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিজয়ী হলে ছাত্রী হলের বিভিন্ন সমস্যা প্রথমেই সমাধান করতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে গতকাল প্রচারণা চালান বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার। মোকাররম ভবনে প্রচারণাকালে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ২০১৯ সালের মতো কারচুপি হলে শিক্ষার্থীরা এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করবে। তিনি অভিযোগ করেন, ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে এবং প্রার্থীদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। প্রশাসন এসব ঠেকাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রার্থীদের প্রচারণাকালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতীতের কর্মকাণ্ড নিয়ে সাইবার বুলিং এবং ব্যক্তিগত চরিত্র হননের চেষ্টা এবং বিশেষ করে নারী প্রার্থীদের নিয়েও নানাভাবে সাইবার বুলিংয়ের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারণাকালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতীতের কর্মকাণ্ড নিয়ে সাইবার বুলিং এবং ব্যক্তিগত চরিত্র হননের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিশেষত ছাত্রী প্রার্থীদের নিয়েও নানাভাবে সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা ঘটছে, যা মানবাধিকার পরিপন্থি। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে রিটার্নিং কর্মকর্তারা কর্তৃক গঠিত ডাকসু আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এবং সাইবার নিয়ন্ত্রণ সেলের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, রিটার্নিং কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে সাইবার বুলিং কিংবা অপপ্রচারের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
ছাত্র অধিকার পরিষদের ইশতেহার ঘোষণা : মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা সমুন্নত রাখা, ডাকসুকে নিয়মিত ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্তি, রেজিস্ট্রার বিল্ডিং সংস্কারসহ ১৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদে নির্বাচনি প্যানেল ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ, ভোট ফর চেঞ্জ’। মধুর ক্যান্টিনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এই ইশতেহার ঘোষণা করেন জোটের ভিপি প্রার্থী বিন ইয়ামিন মোল্লা। এই জোটের ইশতেহারে রয়েছে- ডাকসুকে নিয়মিত ক্যালেন্ডার ইভেন্টে পরিণত করা; শিক্ষার্থীদের দাবি One student, One bed, one table এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করা; খাবারের মান উন্নত করা, প্রয়োজনে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা; ফুল ফ্রি স্কলারশিপ ফর এভরি স্টুডেন্ট বাস্তবায়নে কাজ করা; বিদ্যমান গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে আরও উন্নত ও আধুনিক করা; আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন পর্যাপ্ত লাইব্রেরি ও ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবস্থা চালু করা; রেজিস্ট্রার বিল্ডিংকে অটোমেশন ও ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনা; বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধ বহিরাগত ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ; বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্টেশন সংকট সমাধান করা; মেডিকেল সেন্টারে আধুনিক সেবা নিশ্চিত ও হল এলাকায় ফার্মেসি স্থাপন করা।
ডাকসু নিউজের সঙ্গে সংযুক্ত হবে : ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য’ করতে শিক্ষকদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক প্যানেল গঠন করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘এবার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নতুন ভোটার। তাই ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রথমবারের মতো বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যানদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের ভোটদানে উৎসাহিত করবেন।’
টানা ৩৪ ঘণ্টা ঢাবির প্রবেশপথে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ : নির্বাচন উপলক্ষে আগামী সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টা থেকে টানা ৩৪ ঘণ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রবেশপথ সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৬টা পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জারি করা এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরা স্ব স্ব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয়পত্রের ফটোকপি প্রদর্শন করে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন (অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, রোগী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সাংবাদিক ও ফায়ার সার্ভিসের যানবাহন) ব্যতীত অন্য কোনো যানবাহন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবে না।
এতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই সময়ে নিজ নিজ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করা হলো। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরিবারের সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত নয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়, তারা জরুরি প্রয়োজনে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করতে চাইলে প্রক্টর অফিস থেকে নিরাপত্তা পাস সংগ্রহ করতে হবে। এ বিষয়ে সবার সার্বিক সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করা হয়েছে।