জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-পীড়নের মুখেও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল দেশের শত শত ক্যাম্পাস সাংবাদিক। কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে নিপীড়নের চিত্র যারা বিশ্ব দরবারের কাছে তুলে ধরেছিলেন সেই ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা আজও অবহেলিত। নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, নেই ন্যূনতম বেতন কাঠামো, নিরাপত্তা কিংবা পেশাগত সুযোগ-সুবিধা।
রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ আয়োজিত "কেউ কেউ কথা রাখে” শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা উঠে আসে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে এএফপির সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী মাজেদ বলেন, বর্তমানকে ভবিষ্যতের জন্য ডকুমেন্ট করার দায়িত্ব ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা দারুণভাবে পালন করেছে। বহিরাগত এনে ছাত্রলীগ যখন ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালিয়েছে, তখন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। অথচ এক বছর পেরিয়ে গেলেও তারা এখনও অধিকার থেকে বঞ্চিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগান্তর প্রতিবেদক মোছাদ্দেকুর রহমান বলেন, যখন জাতির বিবেকেরা নীরব ছিলেন, তখন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা লাঠিপেটা খেয়ে, পেট্রোল বোমার আওতায় থেকেও প্রতিবাদের চিত্র তুলে ধরেছে। অথচ অভ্যুত্থানের পর তাদের অবস্থান নিয়ে কেউ কথা বলেনি, কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। আমরা স্বীকৃতি চাই না, চাই ন্যূনতম বেতন স্কেল, ন্যায্য নিরাপত্তা ও পেশাগত সুযোগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (ডুজা) সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি বলেন, রিপোর্ট একটু এদিক-সেদিক হলেই ক্যাম্পাস রিপোর্টারদের চাকরি যায় যায় অবস্থা হয়। নেই কোনো বেতন কাঠামো, নেই নিরাপত্তা বা সুবিধা।
ডুজার দপ্তর সম্পাদক তাওসিফুল ইসলাম বলেন, ১৯ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভৎস চিত্র আমাদের চোখের সামনে ছিল। আমরা বাড়ি ফিরিনি। শাহবাগ ও সায়েন্স ল্যাবের ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম আমরাই। কিন্তু এই সাহসিকতার কোনো মূল্য আজও দেয়া হয়নি।
ডেইলি স্টার বাংলার সাহিত্য সম্পাদক ইমরান মাহফুজ বলেন, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ হয়নি। অথচ ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে হল বন্ধ করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় ক্যাম্পাসেই। সেই বর্বরতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিল আমার ক্যাম্পাস সাংবাদিক ভাইয়েরা। কিন্তু আজো তারা ঠিকমতো বেতন পায় না। মিডিয়াগুলো তাদের দিয়ে দিনরাত কাজ করায়, কিন্তু ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাও দেয় না।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ULAB)-এর অধ্যাপক ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বিকাশে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের অবদান অনস্বীকার্য। ২০২৪-এর অভ্যুত্থানে তারা কেবল সংবাদ পরিবেশন করেনি, বরং ইতিহাসের জীবন্ত দলিল তৈরি করেছে। অথচ তাদের জন্য কোনো পুরস্কার, বৃত্তি বা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু হয়নি-;এটি জাতীয় দুর্ভাগ্য।
তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এটি শুধু সাংবাদিকদের জন্য নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্যও অপরিহার্য।
যাত্রাবাড়ী জামেয়া ইসলামিয়া মাদানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক রিদুয়ান হাসান বলেন,২০১৮ ও ২০২২ সালের নির্বাচনের সময় বিভিন্ন মিডিয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে মিথ্যা প্রচার চালিয়েছিল- ‘আলেম সমাজ সরকারে থাকবে’ ইত্যাদি। ২০২৪-এর অভ্যুত্থানেও তারা আন্দোলন ভাঙতে মিথ্যা ছড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাস সাংবাদিক ভাইয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য প্রকাশ করেছে। অথচ এখন কয়জন তাদের কথা মনে রেখেছে?
আলোচনার শেষে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের মুখপাত্র আশরেফা খাতুন ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিয়ে বলেন, যারা রক্ত আর শব্দ দিয়ে ইতিহাস লিখেছেন, আমরা তাদের ভুলিনি। এই সভা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা প্রকাশের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত